রেমিট্যান্স-রিজার্ভের রেকর্ডে বছর শেষ হয়েছে গত ২০২০ সাল। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে কিনা তা নিয়ে আছে চলছে অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনার আশাবাদ নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২০ সাল। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট করে দেয়। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও ভিন্ন কিছু ছিল না। বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের তখন মাথায় হাত। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সচল রাখতে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসে সরকার। ২১টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনায় ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে বিভিন্ন খাত। অর্থনীতিতে ফিরতে থাকে গতি। এদিকে, প্রণোদনা প্যাকেজের পর দেশের অর্থনীতিতে আশার আলো হয়ে দাঁড়ায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বছরের প্রথম ১১ মাসে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১ হাজার ৯৮৯ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে যেকোনো অর্থবছর বা পঞ্জিকা বছরে রেমিট্যান্স আহরণের রেকর্ড। এই রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই তড়তড় করে বেড়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। বিদায়ী বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে এই রিজার্ভ আট আটটি নতুন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। বছর শেষের মাত্র একদিন আগেও নতুন রেকর্ড গড়ে ৪৩ বিলিয়নের মাইলফলকে শেষ হয় ২০২০ সাল। ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ: করোনাকালীন কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে সরকার মোট ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। শুরুটা হয়েছিল রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রণোদনার ঘোষণা দেন। পরে ৫ এপ্রিল বিভিন্ন খাতের জন্য আরও ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত শিল্প, কৃষি থেকে শুরু করে সব খাতকে অন্তর্ভুক্ত করে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির জন্য এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা খুবই প্রয়োজন ছিল। এই প্রণোদনা প্যাকেজের কারণেই ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে ভুগতে থাকা পোশাক কারখানাগুলোর শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। করোনার আঘাতে পথে বসতে থাকা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন।
একবছরে রেমিট্যান্স ছাড়াচ্ছে ২ হাজার কোটি ডলার: করোনাকালে দেশের অর্থনীতির যে সূচকটি ছিল সবচেয়ে ইতিবাচক ধারায়, সেটি রেমিট্যান্সের প্রবাহ। বিদায়ী এই বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশে এসেছে ১ হাজার ৯৮৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। ১১ মাসের এই রেমিট্যান্স এর আগের যেকোনো অর্থবছর কিংবা পঞ্জিকা বছরের চেয়েও বেশি। ডিসেম্বরের রেমিট্যান্স যুক্ত হলে এ বছরের মোট রেমিট্যান্স নিশ্চিতভাবেই পেরিয়ে যাবে ২ হাজার কোটি মার্কিন বা ২০ বিলিয়ন ডলারের ল্যান্ডমার্ক।
এক পঞ্জিকাবর্ষে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে এর আগে রেকর্ড ছিল ২০১৯ সালের। ওই বছরে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। অর্থবছরের ক্ষেত্রে এই রেকর্ডটি আছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের দখলে। সবশেষ এই অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত কয়েক মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারা অব্যাহত থাকলে চলমান ২০২০-২১ অর্থবছরও রেমিট্যান্সে নতুন রেকর্ড গড়বে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
৪৩ বিলিয়ন ডলারের নতুন উচ্চতায় রিজার্ভ: করোনার অভিঘাতের মধ্যেও অর্থনীতির আর যে সূচকটিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গিয়েছে, সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থির ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে। ২ বছর ৯ মাস পর এসে করোনাকালের মধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারার ঢেউ লাগে রিজার্ভে। ৪ জুন প্রথমবারের মতো ৩৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় রিজার্ভ। এর পরের সাত মাসেরও কম সময়ে রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে আরও ৯ বিলিয়ন ডলার।
চলতি বছরের ৪ জুনের পর গত ২৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারে, গত ৩০ জুন ৩৬ বিলিয়ন ডলারে ও গত ২৮ জুলাই ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নতুন উচ্চতায় পৌঁছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৩৮ দশমিক ১৫ বিলিয়ন, ১ সেপ্টেম্বর ৩৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে ও গত ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। এরপর গত ৩০ অক্টোবর ৪১ বিলিয়ন ডলার, গত ১৫ ডিসেম্বর ৪২ বিলিয়ন ডলারে এবং সবশেষ ৩০ ডিসেম্বর ৪৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছায় এই রিজার্ভ।
১১ মাসে রেমিট্যান্সের ধারা: গত ২০২০ সালে জানুয়ারি মাসে দেশে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠান ১৬৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ওই সময় একমাসে রেমিট্যান্স প্রবাহে এটিই ছিল রেকর্ড। এরপর ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলের দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কমÍ ফেব্রুয়ারিতে ১৪৫ কোটি ২০ কোটি ডলার, মার্চে ১২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার ও এপ্রিলে ১০৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। তবে মে মাস থেকে এই রেমিট্যান্সও নতুন নতুন রেকর্ড গড়তে থাকে।
মে মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে রেকর্ড ১৭৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। জুনে তা আরও বেড়ে ১৮৩ কোটি ১০ লাখ ডলারে উন্নীত হয়। জুলাই মাসে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স ছাড়িয়ে ছায় ২০০ কোটি ডলারের ল্যান্ডমার্ক। ওই মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৬০ কোটি ডলার। এখন পর্যন্ত একমাসে রেমিট্যান্স আহরণের এটিই রেকর্ড। এর পরের চার মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা কমে গেলেও চার মাসের রেমিট্যান্সই জুনের চেয়েও বেশি। এর মধ্যে আগস্টে ১৯৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার, অক্টোবরে ২১১ কোটি ২০ লাখ ডলার ও নভেম্বরে ২০৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে।
প্রণোদনা-রেমিট্যান্স-রিজার্ভে অর্থনীতিবিদদের স্বস্তি: অর্থনীতিতে করোনাকালের ধাক্কা সামলাতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বলে মন্তব্য অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানের। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, করোনা সংকট মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। করোনাকালীন অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এই প্রণোদনা প্যাকেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বড় শিল্প খাত কেবল নয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে কৃষিজীবীরাও উপকৃত হয়েছেন এই প্যাকেজে। সঠিক ব্যক্তিরাই প্রণোদনা প্যাকেজ পাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকলেও সার্বিকভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ দেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছে এই রেমিট্যান্স। এরকম রেমিট্যান্স প্রবাহ না থাকলে দেশের অর্থনীতির ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ত।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, করোনার ধাক্কায় সারাবিশ্বের অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা। এ অবস্থায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারের ল্যান্ডমার্কে উন্নীত হয়েছে। এই অর্জন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, প্রবাসফেরত কর্মীর সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেনি। আশঙ্কা করা হয়েছিল অর্থনৈতিক মন্দা এবং করোনার প্রভাবে প্রধান কর্মী নিয়োগকারী দেশসমূহের শ্রমবাজার বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে অনেক বিদেশি কর্মী বেকার হয়ে পড়বে। কিন্তু আশার কথা হলো, এখন পর্যন্ত ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেনি। এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশস্থ মিশন ও দূতাবাস একযোগে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।তিনি বলেন, ‘প্রবাসী কর্মীদের একটি অংশ দেশে ফেরত এসেছে। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফেরত এসেছে। তাদের অনেকে কাজের মেয়াদ শেষে বা কাজ না থাকায় দেশে ফেরত এসেছে।’
এ সময় মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শামসুল আলম, ওয়েজ অনার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, বোয়েসেল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল হাসান বাদল এবং মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শহীদুল আলম ও খাদিজা বেগম উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক শ্রমবাজার আজ প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ একটি চ্যালেঞ্জ। তারপরেও আমরা আশাবাদী। অর্থনৈতিক মন্দার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কর্মী নিয়োগকারী দেশের উন্নয়ন কর্মকা-ে অবশ্যই কর্মী প্রয়োজন হবে এবং শ্রমবাজার আবার স্বাভাবিক হবে। এই প্রত্যাশায় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে আমাদের কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সার্টিফিকেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো রেমিট্যান্স। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ হলো ১৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রথম ৫ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১০.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় ৪১.৩৩ শতাংশ। এই বিপুল অংকের রেমিট্যান্সের জন্য তিনি দেশপ্রেমিক প্রবাসী কর্মীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। মন্ত্রী এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রেমিট্যান্সের ২ শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তার এই দূরদর্শী নির্দেশনা রেমিট্যান্স প্রবাহের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ।