সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের উদ্যোগে ‘প্যাশেন্ট অ্যাওয়ারনেস অন দ্য ন্যাশনাল ইউজ অ্যান্টিবায়োটিক অ্যান্ড ইটস রেজিস্ট্যান্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ব্যবস্থাপত্র দেয়ার প্রবণতার বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, রোগের ধরন ও নাম উল্লেখ না করে ব্যবস্থাপত্র দেয়ায় রোগীদের অন্ধকারে রাখা হয়। ৭৬ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে লিখিত ব্যবস্থাপত্র দেয়া হলেও ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মৌখিক এবং ১৯ শতাংশের ক্ষেত্রে সরাসরি ওষুধ দেয়া হয়। এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকে সরাসরি ওষুধ দেয়া হয় ৫৯ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে। ৫৫ শতাংশ ফার্মেসি সরাসরি ব্যবস্থাপত্র দেয়, ৪৫ শতাংশ ক্রেতাকে সরাসরি ওষুধ দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমেই কমে আসছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। হ্রাস পেয়েছে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতাও। এ অবস্থায় রোগীদের ওপর রিজার্ভ (প্রচলিত নয় এমন) অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ বেড়ে গেছে। এতে দ্রুত কার্যক্ষমতা হারাতে বসেছে বাকি সব ধরনের ওষুধ। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এরই মধ্যে রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকের বড় চারটি ধরন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে সেফেপিম নামক রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, ৪৯ শতাংশ। এছাড়া লিনেজোলিড ২৩ শতাংশ, টিজেসাইলিন ২০ শতাংশ ও কোলেস্টিন ৮ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে মেডিসিন, সার্জারি, আইসিইউ, বার্ন ও অন্যান্য ইউনিটে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্য তথ্য ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইকিউভিআইএ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ওষুধ বিক্রির তথ্য সংকলন ও বিশ্লেষণ করে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রি হয়েছে ২৪ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার। এর মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ৩০ শতাংশের মতো বলে জানিয়েছেন ওষুধ শিল্পসংশ্লিষ্টরা। এ হিসাবে দেশে বছরে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয় প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণাটি পরিচালনায় দেশের চার বিভাগের (ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম) চারটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চারটি জেলা হাসপাতাল, আটটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আটটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, আটটি কমিউনিটি ক্লিনিক, চারটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ১২টি ফার্মেসিতে আসা ৪৮০ জন সেবাপ্রত্যাশীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্য পেশাজীবী, চিকিৎসক, ওষুধবিক্রেতা, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ফার্মাসিস্ট, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং কৃষি, পশু ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাসহ ১০৫ জনের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। চলতি মাসে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গবেষণায় ৪৬ ধরনের রোগের কথা উল্লেখ করা হলেও সবচেয়ে বেশি রোগী ছিলেন জ্বর, দুর্বলতা, সর্দি, ঠা-া লাগা, গলা ব্যথা, পাতলা পায়খানা ও মাথাব্যথার। এসব রোগের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়েই উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। ফলে তাৎক্ষণিক উপশম হলেও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রথমে প্রাথমিক পর্যায়ের অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হলেও বাংলাদেশে চূড়ান্ত মাত্রার দেয়া হয় বলে জানান গবেষক দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ টি এম জাফরুল আজিম। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা ছাড়া ব্যবস্থাপত্র দেয়া মানে রোগের নাম ও ধরন উল্লেখ না করা। অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের জন্যও রয়েছে এবং ব্যাকটেরিয়ার জন্যও রয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে কাজ করবে কিনা তার জন্য পরীক্ষা দরকার। শুধু অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে নয়, সব ওষুধের ক্ষেত্রে এমনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।’ গবেষণাটিতে কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে একজন চিকিৎসক দিনে সর্বোচ্চ ৩০ জন রোগী দেখতে পারেন। কিন্তু কোনো কোনো সময় তাকে শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়। সব হাসপাতালে পরীক্ষার সুযোগ থাকে না। এছাড়া সম্পদ ও লোকবলের সংকট রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা সঠিকভাবে তার সমস্যা বলতে পারেন না। আর পরীক্ষা ছাড়া রোগের সঠিক নির্ণয় সম্ভব নয়। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে চিকিৎসা দেয়া হয়। সব চিকিৎসার ক্ষেত্রে পরীক্ষা জরুরি নয়।
গবেষণায় বলা হয়, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ৬৩ শতাংশ, জেলা হাসপাতালে ৪৮ শতাংশ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫১ শতাংশ, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ৫১ শতাংশ, কমিউনিটি ক্লিনিকে ৮৫ শতাংশ, বেসরকারি হাসপাতালে ৫৬ শতাংশ, ফার্মেসিতে ৭৮ শতাংশ এবং অন্যান্য চিকিৎসা দেয়া ব্যক্তিরা ৫০ শতাংশ রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে রোগের নাম ও ধরন উল্লেখ করা হয় না।
পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধার অভাবে সরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা করা হয় না বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে সরকারি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখিত পরীক্ষার বেশির ভাগ বেসরকারিভাবে করতে হয়। অনেক পরীক্ষা আবার অপ্রয়োজনীয়ও হয়ে থাকে। বেসরকারিভাবে পরীক্ষা করলে তাতে সরকারি চিকিৎসকরা কমিশন পান। নামমাত্র মূল্য নেয়ায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় রোগের পরীক্ষা করা গেলে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ঘটত বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারি হাসপাতালে অনেক ভিড় থাকে এবং রোগীও নিরীক্ষণের সেই সুযোগ দেয় না বলে মন্তব্য করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম বিপ্লব। তিনি বলেন, ‘বহির্বিভাগের রোগীদের ক্ষেত্রে সময় ও সম্পদের স্বল্পতার কারণে পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু গবেষণায় যতটা বলা হচ্ছে ততটা নয়। ব্যবস্থাপনারও কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসকস্বল্পতা ও অন্যান্য লোকবল সংকট না থাকলেও এমন হতো না।’
তবে গবেষণায় এমন চিত্রই উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন গবেষণা দলের সদস্য ও ফোকাল পারসন মহানামব্রত দাস। বেশ কয়েকবার গবেষণাটি যাচাই-বাছাই এবং ফলাফলের বিস্তর ব্যাখ্যা যোগ করা হলেও ফলফলের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদাৎ হোসেন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘শিগগিরই গবেষণাটি প্রকাশ করা হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬১৮। যাতে ২৬ হাজার ৮৯২ জন চিকিৎসক সেবা দিয়ে থাকেন। ২০১৮ সালে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জেলা হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৫ কোটি রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ বলেন, ‘শুধু উপজেলা, ইউনিয়ন বা কমিউনিটি ক্লিনিক নয়, দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতেই অনেক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে কিছু সরকারি মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। আর বহুল পরিচিত সংক্রামক ব্যাধি নিরীক্ষণের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বহির্বিভাগে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার ব্যবস্থা একটি ব্যাপক বিষয়। এর জন্য বৃহৎ পরিসরে লোকবল ও ব্যবস্থা থাকতে হবে। বহির্বিভাগের একজন রোগীকে দেখতে ৮-১০ মিনিট হলো আদর্শ সময়। কিন্তু রোগীর চাপে তা হয় না।’