শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৯ অপরাহ্ন

শুধু বেসরকারি ঋণ প্রবাহে স্থবিরতা কাটছে না

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২ মার্চ, ২০২১

টানা দশ বছরের স্থবিরতা ভেঙে করোনাকালেই বেশ খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের শেয়ার বাজার। প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রবাস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি। রফতানি আয়ও হয়েছে মন্দের ভালো। শুধু তাই নয়, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ খাতই সচল হয়েছে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে কোনও গতি আসেনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা এখনও যায়নি, একই কারণে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি ব্যবসা-বাণিজ্য। গতি ফেরেনি আমদানি-রফতানিতেও। ফলে নানা অনিশ্চয়তায় নতুন করে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না উদ্যোক্তারা। এতে করে কমেছে ঋণের চাহিদা।
জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যাংকই এখন নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যেটুকু ঋণ দেওয়া হচ্ছে তা খুবই সতর্কতার সঙ্গে। কারণ, এখন ঋণ আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। বেসরকারি খাতে এত কম প্রবৃদ্ধি এর আগে কখনও হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৫২২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৪১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, মহামারির কারণে অধিকাংশ ব্যাংক দেখেশুনে বিনিয়োগ করছে। অনেকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। যে কারণে ঋণের প্রবৃদ্ধি রেকর্ড পরিমাণ কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হলে তবেই ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে আসবেন। কিন্তু এখন ব্যবসায়ীরা ব্যাংকবিমুখ। যে কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে।
আবার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা টিকে রাখার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে সংকটে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করছেন। এমন অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসতে চাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার গ্রাহকও পাচ্ছে না। ফলে ঋণ প্রবাহে কমে গেছে গতি। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএ’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা এখনও টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। অনেকেই ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন বলেও জানান তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে টিকে থাকাই দায়, সেখানে ঋণের বোঝা মাথায় নিতে কে চায়?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগেরই ঋণ আমানতের অনুপাত ৮০ শতাংশের নিচে রয়েছে। ৫১টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমার মধ্যে রয়েছে। অগ্রণী, রূপালী, সোনালীসহ ৫ ব্যাংকের এডিআর ৬০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। মাত্র সাতটি ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য দুই লাখ চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আলোচিত সময়ে ব্যাংক খাতে অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এ অংক অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেশি। অতিরিক্ত তারল্য থেকে বাচার জন্য ভালো গ্রাহক খুঁজছে অনেক ব্যাংক। তারল্যের চাপ সামলাতে কোনও কোনও ব্যাংক সুদ হারও কমিয়েছে। এদিকে চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) জুলাই-ডিসেম্বর এই ছয় মাসের সার্বিক অর্থনীতি পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বাজারে অর্থ সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেসরকারি ঋণ চাহিদা বাড়েনি। প্রতিবেদনে অর্থনীতির সূচক বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। এজন্য অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে ইতিবাচক ধারা বইছে। অর্থনীতিতে সুবাতাস হচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৩৪৫ কোটি মার্কিন ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। একই সময়ে বৈদেশিক সহায়তা এসেছে ২০৪ কোটি ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এই সময়ে ১৫ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয় শিল্প খাতে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম। পাশাপাশি এই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। আদায় পরিস্থিতি গত অর্থবছরের এই সময়ের তুলনায় ৪৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কম ছিল। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম হওয়ার কারণে এই সময়ে বিনিয়োগ কমেছে। পাশাপাশি শিল্প-কারখানাও পুরোদমে চালু হয়নি। শিল্প খাতের উৎপাদন পরিস্থিতি বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যম ও বড় পর্যায়ের শিল্প প্রতিষ্ঠানে চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে উৎপাদনের সূচক ৪৪০ দশমিক ২১ পয়েন্টে উঠেছে। ২০১৯ সালের এই সময়ে এই খাতে উৎপাদনের সূচক ছিল ৪১১ দশমিক ৬০ পয়েন্ট। উদ্যোক্তাদের মতে, লকডাউন তুলে নেওয়ার পর ধীরে ধীরে দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিকতা ফিরে পাচ্ছে। এমনকি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান এখনও পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতায় কাজ করছে না। এছাড়া আরও অনেক খাত এখনো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা ফিরে পায়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমেছে। শুধু ডিসেম্বর টু ডিসেম্বর মাসভিত্তিক মূল্যস্ফীতির হারও কমেছে। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনাকালে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে গত বছরে ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছে মুদ্রা সরবরাহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জুলাই থেকে নভেম্বর এই সময়ে আমদানি কমেছে ২১১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় আমদানি কমেছে ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ।-বাংলাট্রিবিউন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com