দেশের বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সহজ প্রাপ্যতা ও দাম স্থিতিশীল রাখতে গত কয়েক মাসে ৫ নিত্যপণ্যের ওপর কর মওকুফ করেছে সরকার। কর মওকুফ পাওয়া ৫ পণ্য হলো- চাল, পিয়াজ, ভোজ্য তেল, চিনি ও ডাল।
এ কারণে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বি ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। তবে সরকার কর মওকুফ করলেও এর সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা। অবশ্য ক্রেতারা বি ত হলেও এ মওকুফের ফায়দা লুটছে কিছু মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ী চক্র। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জোরপূর্বক ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের উচ্চমূল্য আদায় করছেন এবং কর মওকুফের এ সুযোগের অপব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ জানিয়েছেন এনবি আর কর্মকর্তারা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য নির্ধারণ ও তদারকির জন্য জাতীয় পর্যায়ে গঠিত সমিতির মতে, কর মওকুফের ফলে মূল্যহ্রাসের সুবিধা ভোগ করার অধিকার প্রত্যেক ক্রেতার পাওয়া উচিত। কিন্তু করের পরিমাণ কমানোর পরে স্থানীয় বাজারে মূল্য হ্রাসের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ করছে না।
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সঠিক কর নিরূপণের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এ যাবত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে আমার মনে হয় না। অসাধু ব্যবসায়ীদের সুযোগ গ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকা- রোধ করা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কর মূল্যের সঙ্গে স্থানীয় বাজারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাসের একটি সম্পর্ক রয়েছে। কর মূল্য বৃদ্ধি পেলে তাৎক্ষণিকভাবে তা পণ্যের বাজার মূল্যকে প্রভাবিত করে। অপরদিকে কর মূল্য কমে গেলে বাজার মূল্যের ওপর এর প্রতিফলন ঘটতে অনেক সময় লাগে। এর জন্য দোকানদারদের সরাসরি দোষারোপ করা যায় না, কারণ পণ্য গুদামজাত করার ক্ষেত্রে কিছু বাজারনীতি থাকে। শুল্ক মওকুফের পর বর্তমানে আমদানির ক্ষেত্রে চালে ২৫.৭৫, পিয়াজে ১০, চিনিতে ৬০, ও ভোজ্য তেলে ১৯ শতাংশ কর প্রযোজ্য হয়ে থাকে। পাশাপাশি হলুদ, মটর ডাল আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য ছিল। সেটাও আসন্ন রমজানে ডাল ও বেসনের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সম্প্রতি আমদানি শুল্ক মওকুফ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর)। হলুদ মটর ডাল মূলত বেসন তৈরির প্রধান কাঁচামাল হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ই জানুয়ারি স্থানীয় বাজারে চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য একটি দর নির্ণয় সভায় এনবি আর চাল আমদানির জন্য ধার্যকৃত করের পরিমাণ ৬২.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫.৭৫ শতাংশ করেছে। কিন্তু করের হার কমানোর পরেও মূল্যের ওপর কোনো প্রভাব না পড়ায় সরকার চালের কর ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এনবি আর’র শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চাল আমদানির ক্ষেত্রে কর মওকুফ বাস্তবায়নের পর ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত এনবি আর’র রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ১৪৩ কোটি টাকা। গত ৭ই জানুয়ারি থেকে ২৩শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৫.৭৫ শতাংশ কর প্রদান হারে মোট আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৩২৮.২৮ টন চাল, যার মূল্যমান ৯৯১ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, এই সমপরিমাণ চাল যদি ৬২.৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের মাধ্যমে আমদানি করা হতো, তাহলে জাতীয় কোষাগারে আরো ১৪৩ কোটি টাকা কর মূল্য জমা পড়তো।
এদিকে, ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের পিয়াজ আমদানিকারকরা গত বছর ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ কর মওকুফ সুবিধা পেয়েছে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৬৮ টন পিয়াজ আমদানি করা হয়েছে, যার কর মূল্য ৮২২ কোটি টাকা এবং এর ফলে রাজস্ব খাতে ৪১ কোটি টাকার ঘাটতি হয়েছে।
স্থানীয় বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি সরকার পাম ও সয়াবিন তেল বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করে দেয়। সরাসরি মিল থেকে সংগ্রহের ক্ষেত্রে, ডিস্ট্রিবিউটরদের জন্য এবং খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার লিটার প্রতি সয়াবিন তেলের দাম সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে যথাক্রমে ১০৭ টাকা, ১১০ টাকা এবং ১১৫ টাকা। যদিও ক্রেতারা অভিযোগ করছেন যে, এখনও দোকানদাররা এমআরপি না মেনে তাদের কাছে অধিক মূল্যে তেল বিক্রি করছেন।
এনবি আর কর্মকর্তারা জানান, কর মওকুফের কারণে সরকার প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বি ত হলেও সাধারণ ভোক্তারা নয়, এ মওকুফের ফায়দা লুটছে অসৎ ব্যবসায়ীরা। যদিও কর মওকুফের কারণে সরকার কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বের এক সমীক্ষা মতে, বিভিন্ন খাতে কর মওকুফের কারণে বাংলাদেশ মোট জিডিপি’র প্রায় ২.৫ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এনবি আর’র মতে, বর্তমানে আরো বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে কর মওকুফ করা হয়েছে। ফলে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্যের চেয়ে আরো বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এনবি আর দীর্ঘদিন যাবত অপরিহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল, পিয়াজ, চিনি, ভোজ্য তেল ও ডালের ওপর কর মওকুফের এ সুবিধা প্রদান করে আসছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দর অস্থিতিশীল হলেই আদেশ জারির মাধ্যমে কর মওকুফের ঘোষণা প্রদান করে থাকে এনবি আর। কিন্তু কর কমানোর কোনো প্রভাব বাজারে পড়ে না। অথচ দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম কমানোর জন্য সরকারের কাছে কর মওকুফ করে থাকে।