অগ্নিঝরা মার্চ মাস মার্চের ২১ তারিখ আজ। একাত্তরে এ দিনটি বড়ই উত্তাল ছিল। দিকে দিকে ‘সাত কোটি মানুষের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে’ এমন দৃপ্ত শপথে নিনাদ বেজে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়হিয়া খানের সাথে এক অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হন। এ দিনের বৈঠককালে একমাত্র তাজউদ্দিন আহমদই বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন। আর ইয়াহিয়ার সথে ছিলেন তার আইন উপদেষ্টা বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস এবং সামরিক উপদেষ্টাগণ। এদিনও ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টারা শেখ মুজিবের সাথে তার চার দফা দাবি নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠক থেকে ফিরে এসে শেখ মুজিব তার বাসভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনারা আমার কাছে একটা কথাই বার বার বলেছেন যে, আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসুক। কিন্তু আমি বার বার বলেছি, এতকিছু হবার পরে আমার কাছে ঐ চার দফা ছাড়া আর কোনো কথা নেই। আমার আর বলার কিছু নেই। আলোচনা সফল করতে হলে এখন প্রেসিডেন্টকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনার পর ফিরে এসে শেখ মুজিব বেশ মুক্তকণ্ঠেই কথাগুলো বলেছিলেন। এদিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচী থেকে ঢাকা আসেন। তার সাথে ছিলেন পাঞ্জাবের তরুণ পিপলস পার্টির নেতা গোলাম মোস্তফা খার ও সিন্ধুর জাম সদেক আলী। মোস্তফা খার ভুট্টোর আমলেই পাঞ্জাবের গবর্নর হয়েছিলেন। পরে ভুট্টোর সাথে মত দ্বৈততার কারণে আলাদা হয়ে যান। এই দু’জন সহকর্মী ছাড়া ভুট্টো আরো ১০ জন উপদেষ্টা এবং মরুভূমির দস্যুদের চেহারার মতো একজন কমান্ডো দেহরক্ষী নিয়ে এসেছিলেন। তারা সবাই ছিলেন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রধারী। ভুট্টোর দল প্রেসিডেন্ট হাউজের মাত্র একশ’ গজ দূরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন হোটেল) উঠেছিলেন। বিকেলে ভুট্টো যখন হোটেলের লনে এসে বাইরে জমায়েত জনগণের প্রতি হাত নেড়ে শুভেচ্ছা দেখানোর কসরত করছিলেন, তখন জনতার কেউ তার প্রতি জুতো ছুঁড়ে মারেন। রাতে ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে আলাদা এক বৈঠকে মিলিত হন এবং নৈশভোজ করেন। এর আগে একই দিন সকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড শেখ মুজিবের বাসভবনে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তিনি শেখ মুজিবকে চট্টগ্রাম থেকে প্রায় দু’শ চল্লিশ কিলোমিটার দক্ষিণে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের বুকের সেন্টমার্টিন দ্বীপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দেবার প্রস্তাব করে বলেন, এতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা লভের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিপাবলিকান দলীয় রিচার্ড এম নিক্সন। আমেরিকার রিপাবলিকান দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই পাকিস্তানসহ বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকারসমূহের পতন ঘটানো হয়েছে। যাইহোক শেখ মুজিব ভুট্টোর ঢাকা সফর বিষয়ে নির্বিকার থাকেন। তিনি ইয়াহিয়ার সাথে তার বৈঠক প্রসঙ্গে বলেন, এই বৈঠক আশ্চর্যজনক বা আকস্মিক কিছু নয়। প্রেসিডেন্ট ও আমি এখানে যতক্ষণ আছি ততক্ষণ প্রয়োজনের স্বার্থে যেকোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজনে মিলিত হতে পারি। শেখ মুজিব দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ নয়া ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। একে কোনোক্রমেই বিকৃত করতে দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাংলা কারো উপনিবেশ নয়। এখানে আর কাউকে বাজার সৃষ্টি করতে দেয়া যাবে না। পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনজীবী কে ব্রোহী এদিন শেখ মুজিবের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। এদিন ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীতে স্বাধীনতার দাবিতে এক অভিনব জাহাজ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার পুরুষ ও নারী আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করা শ্লোগানে এই বর্ণাঢ্য মিছিলে শরিক হয়। ডেমরা থেকে মুন্সীগঞ্জের নৌপথে পাঁচটি জাহাজ বিক্ষোভকারীদের বহন করে। বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠি, বাঁশ, বল্লম, রড ও খুন্তা-কুড়াল ছিলো। জয়দেবপুর সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতা এম এ মোত্তালেব এদিন এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, জয়দেবপুরে সান্ধ্য আইন চলাকালে পাঞ্জাবি সামরিক কনভয় জয়দেবপুর সামরিক কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।