ঢাকাকে ঘিরে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন গড়ে তুলছে সরকার। মেট্রোর প্রথম লাইনের কাজ চলছে। আরো দুটি শুরুর অপেক্ষায়। মেট্রোরেলের পাশাপাশি রাজধানীতে আরো ১১টি সাবওয়ে লাইন (পাতাল রেল) গড়ে তুলতে চায় সরকার। এরই মধ্যে রুটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে কৌশলগত পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, টঙ্গী থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে প্রথম সাবওয়ে লাইন। ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইনটি নির্মাণে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা)। এ হিসাবে প্রতি কিলোমিটার সাবওয়ে নির্মাণে ২৭২ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা খরচ হবে।
ঢাকার ১১টি সাবওয়ে লাইনের মধ্যে সবার আগে নির্মাণ করা হবে সাবওয়ের রুটও। ঝিলমিল থেকে তেঘরিয়া বাজার, মুসলিম নগর, সদরঘাট, গুলিস্তান, কাকরাইল, হাতিরঝিল, বিজি প্রেস, ভাসানটেক, কালশী, উত্তরা সেক্টর ১৭ হয়ে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত যাবে এ পাতাল রেলপথটি। দৈর্ঘ্য ২৯ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। এ রেলপথটিতে স্টেশন হবে ২৭টি। সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাতাল রেলপথটি নির্মাণে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কৌশলগত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যেই লাইনটি বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ার কথা। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, ২০৩০ সালের আগে হয়তো এর কাজ শুরু করাই সম্ভব হবে না।
মেট্রোরেল ও সাবওয়ে সমজাতীয় যোগাযোগ অবকাঠামো। সাবওয়ে সাধারণত মাটির নিচে গড়ে তোলা হয়। নির্মাণে ব্যবহার করা হয় অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। স্বভাবতই এর নির্মাণ ব্যয়ও হয় অনেক বেশি। সাধারণত এক কিলোমিটার সাবওয়ে লাইন নির্মাণে অন্তত ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে নির্মিত সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো দেশ ও প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোতে পাতাল রেলের নির্মাণ ব্যয় আরো বেশি। সিঙ্গাপুরের ডাউনটাউন এমআরটি লাইন (পুরোটাই পাতালপথে) নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয়েছে ৪৯৩ মিলিয়ন ডলার। আর হংকংয়ের শা তিন সেন্ট্রাল লিংক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয়েছে ৫৮৬ মিলিয়ন ডলার। এখন পর্যন্ত প্রাক্কলিত হিসাব বলছে, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের তুলনায় বাংলাদেশে সাবওয়ে নির্মাণে খরচ কম হবে।
ঢাকায় সাবওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটি এজন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের আওতায় গতকাল ঢাকার একটি হোটেলে ‘ঢাকা সাবওয়ে প্রজেক্ট’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে ঢাকাকে ঘিরে সব মিলিয়ে ২৫৮ কিলোমিটার সাবওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কথা জানায় সেতু কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০২ কিলোমিটার, ২০৪০ সালের মধ্যে আরো ৮৫ কিলোমিটার এবং শেষ ধাপে ২০৫০ সালের মধ্যে ৭১ কিলোমিটার সাবওয়ে লাইন নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানায় সংস্থাটি।
সব মিলিয়ে সাবওয়ের রুট চিহ্নিত করা হয়েছে ১১টি। এর মধ্যে গাবতলী থেকে ভোলাব পর্যন্ত রুট বি, কেরানীগঞ্জ থেকে পূর্ব নন্দীপাড়া পর্যন্ত রুট ডি, গাবতলী থেকে বসুন্ধরা রিভারভিউ পর্যন্ত রুট জি, হাজারীবাগ থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত রুট জে, ঝিলমিল থেকে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত রুট ও, শাহ কবির মাজার রোড থেকে সদরঘাট পর্যন্ত রুট পি, কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর পর্যন্ত রুট এস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রুট টি, তেঘরিয়া বাজার থেকে বন্দর পর্যন্ত রুট ইউ, টঙ্গী জংশন থেকে কোনাবাড়ি পর্যন্ত রুট ভি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাবতলী পর্যন্ত রুট ডব্লিউ চিহ্নিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পুরো সাবওয়ে নেটওয়ার্কে স্টেশনের সংখ্যা হবে ২১৫টি। সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের সভাপতিত্বে গতকালের সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, সাবওয়ে নির্মিত হলে ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ৪০ লাখ মানুষ মাটির নিচে স্থানান্তর হবে এবং মাটির উপরিভাগ যানজট ও জনজটমুক্ত থাকবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের সব কাজের উদ্দেশ্য জনকল্যাণ। জনস্বার্থে কাজ করতে হবে, কমাতে হবে জনভোগান্তি। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন একই ধরনের প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বাড়াতে হবে সমন্বয়। কাজের গুণগত মান সুরক্ষার পাশাপাশি নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। তা না হলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায় এবং সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ পড়বে। এছাড়া প্রকল্প গ্রহণের আগে এর প্রয়োজনীয়তা এবং কার্যকারিতার বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
ঢাকায় সাবওয়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অ্যান্ড প্রিলিমিনারি ডিজাইন ফর কনস্ট্রাকশন অব ঢাকা সাবওয়ে’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এজন্য ব্যয় হচ্ছে ৩২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সাবওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যে স্পেনের কোম্পানি টিপসার নেতৃত্বে যৌথভাবে জাপানের প্যাডকো, বিসিএল অ্যাসোসিয়েটস, কেএসসি ও বেটস সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী, ২৩৮ কিলোমিটার সাবওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ ৯০ কিলোমিটার সাবওয়ে নির্মাণে প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন করবে এসব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে প্রকল্পটির কাজ ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী জুলাইয়ে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।-বণিকবার্তা অনলাইন