‘একটা বাইসাইকেল আর হাতে স্মার্টফোন থাকলেই হয়, এই সময়ে (লকডাউনে) না খেয়ে মরতে হবে না। আমি এভাবেই টিকে আছি।’ কথাগুলো বলছিলেন ফুডপান্ডার ডেলিভারিম্যান সোহাগ। শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) বিকালে রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের ফাস্টফুড শপ পিজা মাস্টারের সামনে কথা হয় সোহাগের সঙ্গে। তখন তিনি ওই ফাস্টফুড শপ থেকে গ্রাহকের অর্ডারের খাবার নিতে এসেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, গত বছর লকডাউন শুরুর পর থেকে খাবারের ডেলিভারি সার্ভিস ফুডপান্ডায় জয়েন করেন তিনি। খাবার ডেলিভারির কাজ করে ঢাকায় টিকে আছেন বলেও জানান।
সোহাগ মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্সে পড়ছেন। থাকেন মিরপুর-১৩ নম্বরে। ডেলিভারির কাজ করেন মিরপুর এলাকায়। সোহাগ জানান, প্রতি ডেলিভারিতে তিনি পান ৪০ টাকা করে। তিনি সিনিয়র হওয়ায় এই রেটটা পান। আরেক ক্যাটাগরিতে অন্যরা পান প্রতি ডেলিভারিতে ২৮ টাকা করে। সোহাগ বলেন, ‘বেশিক্ষণ কাজের সুযোগ থাকলেও আমি তিন ঘণ্টা করে কাজ করি। এই তিন ঘণ্টায় কমপক্ষে গড়ে আমার ৩০০ টাকা আয় হয়। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।’ বেশি কাজ করে ক্লান্ত হয়ে গেলে পড়াশুনা করা যায় না বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, তার মতো অনেকেই কাজ করেন ফুডপান্ডায়। গত বছরের লকডাউনের পর বেশি বেড়েছে ডেলিভারিম্যানের সংখ্যা। প্রতিদিনই খবর পাই, নতুন নতুন ছেলেরা আসছে ফুডপান্ডায় ডেলিভারিম্যান হিসেবে। পিজা মাস্টারের স্বত্বাধিকারী জানালেন, তার প্রতিষ্ঠানে বসে খাওয়া-দাওয়া করার সুযোগ নেই। তিনি হোম ডেলিভারি দেন। নিজেদের ডেলিভারিম্যানের পাশাপাশি ফুডপান্ডা, পাঠাও, সহজ ফুড, হাংরিনাকি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস নিয়ে থাকেন। লকডাউনের শুরুতে খাবারের অর্ডার বেশি এলেও রোজায় একটু কমেছে বলে জানান। পিজা মাস্টার থেকে প্রতিদিন ফুডপান্ডায় অন্তত ১৫টি এবং পাঠাওয়ে ১-২টা অর্ডার আসে। পিজা মাস্টারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ওয়াও পিজা (মিরপুর ১৪) থেকে প্রতিদিন গড়ে ২০টি অর্ডার আসে পাঠাও থেকে, ৪-৫টা ফুডপান্ডা থেকে আসে। রোজার আগে এই সংখ্যা বেশি ছিল বলে তিনি জানান। শুধু খাবার পরিবহনই নয়, গ্রোসারি (নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য) ডেলিভারিতে এখন প্রচুর কর্মী কাজ করছেন। ডেলিভারি খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে। করোনার কারণে লকডাউনের এই সময়ে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বন্ধ থাকা এবং ই-কমার্স চালু থাকায় ডেলিভারিম্যানদের চাহিদা বেড়েছে। গ্রোসারি, ইফতারি, সেহরি ইত্যাদির ডেলিভারি বেড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বেশিরভাগ ডেলিভারিম্যানকে দেখা যায়, পিঠে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বাসা-বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। পণ্য ডেলিভারির সময় চট করে পকেট থেকে বা মোবাইল হোল্ডার থেকে স্মার্টফোন বের করে বলছেন বিলের পরিমাণ। আর আগে মূল্য পরিশোধ করা থাকলে পণ্য বুঝিয়ে দিয়ে সাইকেলে প্যাডেল মেরে চলে যাচ্ছেন আরেক গন্তব্যে। কখনও কখনও মোটরবাইকেও ডেলিভারিম্যানরা যান পণ্য পৌঁছে দিতে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইফুড সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘লকডাউনের আগে আমাদের প্রতিদিন ডেলিভারি ছিল ১২-১৩ হাজার। লকডাউনের শুরুতে তা পৌঁছে যায় ১৫ হাজারে। আর রোজার সময় এখন ১৬ হাজার হচ্ছে। এরমধ্যে আছে গ্রোসারি, ইফতার, সেহরিসহ অন্যান্য খাবার দাবার।’ তিনি জানান, ইফুডের বর্তমানে নিজস্ব ডেলিভারিম্যানের সংখ্যা ৬ হাজার। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। করোনাকালে তারা ডেলভারিম্যানের সংখ্যা বেশ বাড়িয়েছেন বলে জানান। তিনি উল্লেখ করেন, নতুন শহরে সেবা চালু করার কারণে ডেলিভারিম্যান হায়ার করা হয়। ডেলিভারিম্যান নিয়োগ একটা চলমান প্রক্রিয়া। সব সময়ই চলে বলে তিনি জানান।
চলমান লকডাউনে রাইডশেয়ারিং অ্যাপ উবার মোটরবাইকের মাধ্যমে তাদের সেবা উবার কানেক্ট চালু রেখেছে। এটি মূলত প্যাকেজ সার্ভিস। জানতে চাইলে উবারের মুখপাত্র জানান, উবার মটো চালকরা আয়ের উৎস হিসেবে উবার কানেক্ট সেবার সুযোগ নিতে পারছেন। অনেকেই কাজ করছেন। যেকেউই হালনাগাদ কাগজপত্র (এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি) নিয়ে উবারের এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বাড়তি আয় করতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহজ ফুডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা এম কাদির জানান, ‘এই সময়ে সহজের ডেলিভারির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, লোকবলও দ্বিগুণ করতে হয়েছে।’
করোনাকালে ই-কমার্স খাতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছর করোনার সময় লকডাউনে আটকে পড়ে প্রচুর মানুষ অনলাইন থেকে কেনাকাটা করেছেন। এক বছরেরও বেশি সময় কম-বেশি এটা চলেছে। এবার লকডাউন শুরু হলে লোকজন আবারও অনলাইনমুখী হয়েছেন। অনেকের মধ্যে অভ্যাস তৈরি হয়েছে অনলাইনে কেনাকাটায়। তবে এই প্রবৃদ্ধির বড় অংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে ডেলিভারি সার্ভিস বেড়েছে। যারা এই খাতে কাজ করছেন, তাদের বেশিরভাগেরই অভিমতÍ ডেলিভারি আগের থেকে তিন গুণ বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লকডাউনে ডেলিভারি খাতের প্রবৃদ্ধি অন্তত ৩০০ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুরিয়ার ও লজিস্টিকস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ইকুরিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী বিপ্লব ঘোষ রাহুল জানান, করোনার আগে সারা দেশ মিলিয়ে আমাদের ডেলিভারিম্যানের সংখ্যা ছিল দেড় হাজারের মতো। ঈদের আগে তা ৩ হাজার করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরই মধ্যে ২ হাজার ৩০০ ডেলিভারিম্যান আমাদের রয়েছে। এরমধ্যে ফিক্সড আছে, কিছু ভেরিয়েবল রিসোর্স আছে। করোনার মধ্যেই প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ ডেলিভারিম্যান আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তিনি জানান, গ্রোসারি ডেলিভারি সবেচেয়ে বেশি বেড়েছে। গ্রোসারিকে দুই ভাগে ভাগ করে তিনি উল্লেখ করেন, একটা হলো পেরিশেবল গ্রোসারি, যেমন- মাছ, মাংস। এটা বিভিন্নভাবে হয়। এটার ডেলিভারি বেশি হয় না, সবার এই ডেলিভারি করার সক্ষমতাও নেই। এটা কম পরিমাণে হয়। আর ননপেরিশেবল যেমন- চাল, ডালের ডেলিভারি বেশি বেড়েছে। আমরা মাংস ডেলিভারি করি। বাংলা ক্যাট থেকে প্রতি সপ্তাহে আমরা ১৫ থেকে ১৬ হাজার কেজি মাংস ডেলিভারির অর্ডার পাই। এ কারণে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ডেলিভারি বাড়ছে। ডেলিভারি বাড়ছে মানে এই খাতে কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
গত বছর করোনা শুরু হলে লকডাউনে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম চালডাল ডট কম ডেলিভারিম্যান হিসেবে সংশ্লিষ্ট এলাকার রিকশাওয়ালাদের নিয়োগ দিয়েছিল। রিকশাওয়ালারা ওই সময় কর্মহীন হয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থায় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় চালডাল। চালডালের রয়েছে নিজস্ব ডেলিভারিম্যান। তারা বিভিন্নভাবে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ ফাস্টফুড শপের রয়েছে নিজস্ব ডেলিভারিম্যান। শপের আশেপাশের এলাকায় দ্রুত খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজস্ব ডেলিভারিম্যানরাই কাজ করে। একটু দূরে হলে বা অর্ডার বেশি পড়লে তখন ডেলিভারি সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভিস নেওয়া হয়।-বাংলাট্রিবিউন