ফরিদপুর জেলার সরকারি স্লোগান ‘সোনালি আঁশে ভরপুর, ভালোবাসি ফরিদপুর’। সোনালি আঁশের স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে ফরিদপুরের চাষিরা। ফরিদপুরের পাট গুণে ও মানে দেশ সেরা। তাই এ জেলার ব্র্যান্ডিং হিসেবে পাট সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে। ফরিদপুরে এবার ৮৬ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হচ্ছে।
ফরিদপুর জেলা সদর, নগরকান্দা, বোয়ালমারী, মধুখালী ও সালথা উপজেলার গ্রামগুলোর সবুজ শ্যামল বিস্তীর্ণ মাঠে চলতি মৌসুমে মাথা ছাড়িয়ে উচ্চতায় বেড়ে ওঠা পাট ক্ষেতের সতেজতা ছড়ানো সবুজের আবির-রাঙা এ পরিবেশ চোখের সামনে তুলে ধরেছে শ্যামল বাংলার প্রাকৃতিক মুগ্ধতা। এ বছর পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ মৌসুমে সঠিক সময়ে পরিমাণ মতো বৃষ্টি অনুকূলে না থাকলেও পাটের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। ফরিদপুরের নয় উপজেলার মধ্যে মূলত পাঁচটি উপজেলায় পাট চাষ বেশি হয়। চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পাটের চাষ হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার বোয়ালমারী উপজেলার চতুল ইউনিয়নের বাইখির, ধুলপুকুরিয়া, বনচাকী গ্রামে পাট ক্ষেতে পরিচর্যা শেষে অনেক কৃষক পাট কাটতে শুরু করেছেন। অনেকেই আবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়া নগরকান্দা, সালথা, মধুখালীর বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামগুলোর ক্ষেতে একই দৃশ্য চোখে পড়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকায়ও চোখে পড়ে সবুজের দ্যুতি ছড়ানো এ দৃশ্য। সবুজ পাট গাছগুলো সোনালি স্বপ্ন দেখাচ্ছে ফরিদপুর অঞ্চলের কৃষকদের। আর কৃষক আশা করছেন, বাম্পার ফলন ও ন্যায্য দামের।
নগরকান্দা উপজেলার শশা গ্রামের চাষি রফিক সেখ বলেন, একটা সময় পাটই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসার ফসল। বাপ-চাচারা কত কষ্ট করে আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে পাট চাষ করতেন। পানিতে ডুবে ডুবে জাগ দিতেন, ভালোভাবে পঁচলে তারপর মাচা পেতে আঁশ ছড়াতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সব কিছু নাই হয়ে গেল। ইদানীং আবারও পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধিতে আনন্দে এ পাটচাষি বলেন, কত মায়া লাগে, চিকন গাছে কচি কচি পাতা। পাট গাছ তো আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। কানাইপুর ইউনিয়নের করিমপুর গ্রামের কৃষক আবদুল জলিল বলেন, গত বছর ফলন ভালো হওয়ায় এবং চাষিরা ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা এবারও পাট চাষের দিকে ঝুঁকেছে।
তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সঠিক সময় জমিতে বীজ বপন করার সুযোগ পাওয়ায় পাটের বাম্পার ফলন হবে। বাজারে ভালো দাম পেলেই সার্থক হবে পরিশ্রম। বৃষ্টিপাতের চলমান ধারা বর্ষা পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে এবারও পাট পচাতে পানি নিয়ে তেমন চিন্তা করতে হবে না বলে জানান বোয়ালমারী উপজেলার টোংরাইল গ্রামের স্বপন বিশ্বাস, কপিল বিশ্বাস ও পাটচাষি উত্তম বিশ্বাস। এখন অপেক্ষা কেবল পাট গাছ থেকে সোনালি আঁশ ছাড়িয়ে তা বাজারে বিক্রি করা। সেখানে ন্যায্য দাম মিললেই কৃষকদের মুখে লেগে থাকা হাসিটা আরও রঙিন হবে। সীমানা ছাড়িয়ে যাবে সবুজ পাটগাছের সোনালি আঁশ ঘিরে তাদের স্বপ্নের বিস্তৃতি। সালথা উপজেলার পাটচাষি বিনয় মন্ডল বলেন, ফলনের পাশাপাশি দামও যদি ভালো পাওয়া যায়, তবে আগামীতে আরও বাড়বে পরিবেশবান্ধব এ আঁশ ফসলের আবাদ। সালথা, নগরকান্দা,বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা এলাকার একাধিক পাটচাষি জানান, উপজেলাগুলোর সব ইউনিয়ন এলাকার মাঠে পাট দেখলে বোঝা যায় ফলন কেমন হবে। জমিতে যেভাবে পাট গাছ দাঁড়িয়ে আছে তাতে কৃষকের মন জুড়িয়ে যায়। ইতোমধ্যে সব এলাকার জমিতে পাট ৫/৬ ফুট লম্বা হয়েছে। অনেক এলাকায় কৃষকেরা গাছ পাট কাটতে শুরু করেছেন। কয়েক দিনের মধ্যে পাট পরিপক্ব হলে কৃষকেরা পুরোদমে পাট কাটতে শুরু করবেন। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও পাটচাষিরা নিজস্ব উদ্যোগে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করে আগাম পাট বীজ বপন করেন। সে কারণেই আজ মাঠের পর মাঠ সোনালি আঁশ পাট। মধুখালী উপজেলার ব্যাসদী গ্রামের পাটচাষি লাভলু মিয়া, হাকিম সেক দুই একর করে পাট চাষ করেছেন। তারা জানান, সেচ দিয়ে পাট বীজ বপন করেছি। বৃষ্টির অপেক্ষা না করে পাটের জমিতে দুই বার সেচ দিয়েছি। পাটের যে অবস্থা আমরা বাম্পার ফলনের আশা করি। গত বছর পাটের যে দাম পেয়েছি তাতে লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা করেন তারা।
মেগচামী গ্রামের পাটচাষি সোহরাব শেখ জানান, আমার দুই একর জমিতে পাট রয়েছে। ভালো পাট জন্মেছে। দাম ভালো পেলে খুশি হবো। মধুখালী বাজারের বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ মিয়া জানান, এ অঞ্চলের পাটের আঁশের মান ভালো হওয়ায় মিল মালিকদের কাছে পাটের চাহিদা রয়েছে।
মধুখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আলভী রহমান বলেন, চলতি বছর আবহাওয়া পাটচাষের উপযোগী হওয়ায় এ বছর পাটের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। মধুখালীর লক্ষ্যমাত্রা আট হাজার ৩৫২ হেক্টর থাকলেও পাট বীজ বপন হয়েছে আট হাজার ৫৫২ হেক্টর জমিতে। ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. হযরত আলী বলেন, চলতি মৌসুমে ফরিদপুর জেলার নয়টি উপজেলায় ৮৬ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হচ্ছে। পাট আবাদের শুরুতে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল কৃষকেরা। অনেকেই সেচের মাধ্যমে পাট আবাদ করে। তবে সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত পাটের বাম্পার ফলন হবে বলে তিনি আশাবাদী।
তিনি আরও বলেন, এ জেলার চাষিরা মূলত দুই জাতের পাট তোষা ও মেস্তা জাত আবাদ করে থাকে। এর মধ্যে তোষা জাতটি চাষিদের কাছে অধিক প্রিয়। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, গুণে ও মানে ফরিদপুরের পাট দেশ সেরা। ফরিদপুর অঞ্চলের পাটের আঁশে বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। ফরিদপুর জেলা পাটের জন্য খ্যাত। এ কারণে জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে পাটকেই বেছে নেয়া হয়েছে। এছাড়া ফরিদপুর জেলার স্লোগান পাটকে নিয়েই ‘সোনালি আঁশে ভরপুর, ভালোবাসি ফরিদপুর’।