ভারতে কোভিড মহামারি শুরু হওয়ার পর গত চব্বিশ ঘন্টায় একলাফে প্রায় নতুন চার হাজার করোনা পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছেন – এবং মারাও গেছেন প্রায় দুশোর কাছাকাছি।
নতুন আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যুর হিসেব – দুদিক থেকেই যে কোনও একদিনে ভারতে এটি নতুন রেকর্ড, আর সেই রেকর্ড গত পাঁচ-ছদিন ধরে ক্রমাগতই ভাঙছে।
এর মধ্যে গত চব্বিশ ঘন্টায় শুধু মহারাষ্ট্রেই দেড় হাজারের বেশি এবং তামিল নাডুতে সোয়া পাঁচশো নতুন রোগীর সন্ধান মিলেছে।
দুই দফায় চল্লিশ দিনের লকডাউন শেষে ভারত যখন কিছুটা শিথিল তৃতীয় পর্বের লকডাউনে প্রবেশ করেছে, তখন সে দেশে এই ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ কীসের ইঙ্গিত?
বস্তুত মার্চের গোড়ায় ভারতে যে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা রোজ মাত্র দুটো কি তিনটে করে বাড়ছিল, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এসে সেটা এখন বাড়ছে বাইশশো কি আড়াই হাজার করে।
আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, গত চব্বিশ ঘন্টায় সব রেকর্ড ভেঙে শুধু এক দিনেই ৩৯০০ নতুন রোগী পাওয়া গেছে – আর মারাও গেছেন অন্তত ১৯৫জন।
নতুন রোগীদের বেশির ভাগই শনাক্ত হয়েছেন মহারাষ্ট্রে – ভারতে করোনাভাইরাসের পটভূমিতে যে রাজ্যটির হাল সবচেয়ে খারাপ।
সেই সঙ্গে দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে তামিলনাডু ও পাঞ্জাবেও।
তাহলে কি শুরু হয়ে গেছে ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন‘?
কিন্তু একদিনে হঠাৎ করে এতটা বৃদ্ধি – তাহলে কি ভারত এই ভাইরাসের ‘কমিউনিটি সংক্রমণ’ পর্বে ঢুকে পড়েছে?
নামী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড: বি কে পল ভারতের নীতি আয়োগের সদস্য এবং করোনা মোকাবেলায় তৈরি এমপাওয়ারড কমিটিরও প্রধান।
তিনি কিন্তু বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, “ভারতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে কি না আমি সে ব্যাপারে মন্তব্য করব না।”
“তবে এটা মনে রাখতে হবে ভারত কিন্তু এখনও একটা কনটেইনমেন্ট স্ট্র্যাটেজি নিয়েই এগোচ্ছে, আর সেটা দিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে।”
“যদি আমরা কমিউনিটি সংক্রমণে ঢুকে পড়তাম – তাহলে আমাদের মিটিগেশন স্ট্র্যাটেজিতে ঝুঁকতে হতো, অর্থাৎ মৃত্যুর সংখ্যা যতটা কম রাখা যায় সেটা দেখতে হতো।”
“তবে এখনও আমরা স্থানীয় ভাবে, কনট্যাক্টদের ট্রেস করে ও বিভিন্ন জোনে ভাগ করেই রোগটাকে আটকাতে পারছি।”
‘দিন দশেকেই মোট রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়াবে‘
ব্রুকিংস ইন্ডিয়ার গবেষণা প্রধান ড: শামিকা রাভি আবার মনে করছেন, এপ্রিল থেকে ভারতের করোনাভাইরাস ড্যাশবোর্ডে যে ইঙ্গিতগুলো দেখা যাচ্ছে তাতে এই আচমকা সার্জ বা বৃদ্ধি অস্বাভাবিক কিছু নয়।
শবরং চলতি মে মাসের মাঝামাঝি – অর্থাৎ আর দিন দশেকের ভেতরেই ভারতে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে তার বিশ্বাস।
ড: রাভির কথায়, “শুরুতে যেমন একটা পাল্টা যুক্তি দেওয়া হচ্ছিল যে সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকলে এতদিনে মোট রোগীর সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়ে যেত। তবে সরকারও চুপচাপ বসে থাকেনি, মানুষও অনেক সাবধানতা দেখিয়েছে।”
“তবু তারপরও এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে যে ট্রেন্ড আমরা দেখছি তাতে মে-র মাঝামাঝি রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজারের কাছাকাছি হওয়ার কথা, কারণ এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথের প্রকৃতিটাই তাই।”
“এখন সেটা হবে কি না, তা অনেকটা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলো কতটা শক্ত হাতে কনটেইনমেন্ট বলবৎ করতে পারে – আর তাই সতর্ক নজর রাখতে হবে মুম্বাই, পুনে, সুরাট বা আহমেদাবাদের মতো হটস্পটগুলোর ওপর।”
মদের দোকান খোলার পর দিল্লিতে ক্রেতাদের লাইন
তবু শিথিল লকডাউন, মদ কিনতে ভিড়
কিন্তু গতকাল থেকে শুরু হওয়া তৃতীয় পর্বের লকডাউনে উল্টে অনেক কিছুই শিথিল করা হয়েছে।
যেমন দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর বা কলকাতায় দেড়মাস বাদে খোলা মদের দোকানগুলোয় পছন্দের পানীয় কিনতে ভিড় করেছেন হাজার হাজার মানুষ।
ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন সরাসরি বলছেন, “রেড জোনের ভেতরে আমরা যারা আছি তাদের এখনও স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার সময় কিন্তু আসেনি।”
“আর মদের দোকানের সামনে যে দৃশ্য আমরা কাল দেখেছি, তাতে বলতেই হচ্ছে রাজ্য সরকারগুলোকে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন পরিষেবা আমরা খুলব, আর কোনটা খুলব না।”
মদ কিনতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে দিল্লি সরকার আজ রাতারাতি অ্যালকোহলের ওপর ৭০% বাড়তি কর বসিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পেশাল করোনা ট্যাক্স’।
মদের দাম বাড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বা অন্ধ্রও – কিন্তু তারপরও দোকানের সামনে গাদাগাদি ভিড় এতটুকুও কমেনি।
যেন মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ নিয়ে সাধারণ ভারতীয়রা এতটুকুও বিচলিত নন!-শুভজ্যোতি ঘোষবিবিসি বাংলা, দিল্লি