এ বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য আরেকটি অনিবার্য পন্থা হলো- ধৈর্য এবং সালাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং সর্বাঙ্গীণভাবে জীবনকে আল্লাহ অভিমুখীকরণে সচেষ্ট থাকা, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। মুমিনদের ওপরে বিপদ আপতিত হলে তারা বলে, আমরা তো আল্লাহরই জন্য এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৫৩, ১৫৬)।
সৎকর্মের প্রতিযোগিতায় আত্মনিয়োগকরণ : এ সময় আমাদেরকে অধিক হারে সৎকর্ম করতে হবে। কারণ সৎকর্মপরায়ণরাই প্রকৃত অর্থে সফলকাম, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সব মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে তারা নয়’ (সূরা আসর, আয়াত : ২-৩)। তিনি আরো বলেন, ‘সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্মকে অপহত করে দেয়। তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে জনপদ ধ্বংস করবেন অথচ এর অধিবাসীরা পুণ্যবান’ (সূরা হুদ, আয়াত-১১৪, ১১৭)। এবং সৎকর্মশীলদের প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়, যেমনÑ আল্লাহ তায়ালা জাকারিয়া আ:-এর দোয়া কবুলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম, কারণ তাঁরা সৎকর্মের প্রতিযোগিতা করত।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-৯০)
বিশেষ ও সাধারণ দান-সদকার মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ : বিশ্ব মহামারীর এ আপদঘন অবস্থায় ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র অনুক্রমিকভাবে সব পর্যায় থেকেই প্রকাশ্যে বা সঙ্গোপনে সাধারণ দান-সদকা বাড়াতে হবে এবং পরহিতৈষণায় দ্বিগুণ উৎসাহে এগিয়ে আসতে হবে। ফলে সব প্রকার শঙ্কা, ভয় ও দুশ্চিন্তা হবে বিদূরিত-নির্বাসিত। ইমাম ইবনে কায়্যিম রহ: বলেন, বিভিন্ন রকম দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবেলায় সদকার রয়েছে অবাক করার মতো ভূমিকা। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালা নানা রকম বিপদ-আপদ থেকে সদকাকারীকে সুরক্ষা দান করেন। যদিও সে পাপিষ্ঠ, অত্যাচারী কিংবা আল্লাহকে অস্বীকারকারী হয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের কাছে এটি পরীক্ষিত (আল-ওয়াবিল আস-সাইয়েব মিনাল কালিমিত ত্বয়িব, পৃষ্ঠা-৩১)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে ধনৈশ্বর্য ব্যয় করে অতঃপর খোঁটা ও গঞ্জনা দিয়ে বেড়ায় না, মহান প্রতিপালকের কাছে রয়েছে তাদের জন্য যথাযথ পুরস্কার। আর তারা অবশ্যই নিঃশঙ্ক ও নিশ্চিন্ত জীবনের অধিকারী হবে’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৬২)। উপরন্তু যারা সব প্রকার স্বার্থপরতামুক্ত হয়ে পরার্থপরতায় নিয়োজিত হয়, স্বয়ং অল্লাহ তায়ালা তাদের সার্থ সুরক্ষায় সমবস্থ ও সমাগত হন। আবু হুরায়রা রা: থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছেÑ ‘আল্লাহ তায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দা-সংস্থানে ব্যাপৃত থাকেন যতক্ষণ বান্দা ভ্রাতৃসংস্থানে নিবেদিত থাকে’ (সহিহ মুসলিম-২৬৯৯)। উপরন্তু হাদিসে সদকা দ্বারা চিকিৎসা গ্রহণের নির্দেশনাও পাওয়া যায়, রাসূল সা: বলেন, ‘তোমরা সদকা দ্বারা চিকিৎসা গ্রহণ করো’ (ইবনে মুফলিহ, আল-ফুরুউ, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-১৪৪)। এক হাদিসে মহামারীকে আল্লাহর আজাব বলা হয়েছে, বর্তমান করোনা যদি আল্লাহর আজাবও হয় তবুও সদকার দ্বারা এটি তিরোহিত হতে পারে। কেননা রাসূল সা: বলেন, ‘সদকা প্রভুর ক্রোধকে প্রশমিত করে’ (তিরমিজি-৬৬৪)। অপর বর্ণনায়Ñ ‘সঙ্গোপন দান-সদকায় প্রভুর সংক্ষুব্ধতা নির্বাপিত হয়’ (ত্বাবারানি, আল-মুজামুল কাবির, হাদিস-৭৯৩৯)।
সুতরাং করোনা পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়া শ্রমজীবী, দিনমজুর, ছিন্নমূলসহ সব অনানুষ্ঠানিক কর্মজীবী মানুষের প্রতি হতে হবে সদয় ও সিদ্ধহস্ত। তবে দানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের আনুপূর্বিকতা নির্ণয়ে অবশ্যই আল-কুরআনের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন এবং মুসাফিরদের জন্য করো’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২১৫)। এ ছাড়া রয়েছে জাকাতের নির্দিষ্ট গ্রহীতা বা প্রাপ্যজন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সাদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্তাকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের জন্য, দাসত্ব থেকে মুক্তি প্রার্থী দাসের জন্য, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথ ও মুসাফিরদের জন্য’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত-৬০)। জাকাতের অর্থ এই আট শ্রেণী ব্যতিরেকে অন্য কাউকে দেয়া বিধেয় নয়।
অশিষ্ট-অশ্লীল প্রতিসারণ ও বেশি করে তাওবা-ইস্তিগফার করা : এ সময়ে আমাদের যাপিত জীবনের দৈনিকতায় রাসূলের সুন্নাহকে প্রাধিকার দেয়া এবং অধিকহারে মহামহিম আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। কারণ আল-কুরআনে ঘোষিত হয়েছেÑ ‘আল্লাহ এমন নন যে তুমি তাদের মধ্যে থাকা অবস্থায় তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। আবার তিনি এমনও নন যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনায় নিরত থাকা অবস্থায় তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত-৩৩)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো ও তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করো, তিনি তোমাদেরকে এক নির্দিষ্ট কালের জন্য উত্তম জীবন উপভোগ করতে দেবেন’ (সূরা হুদ, আয়াত-৩)। এ আজাব থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে স্বীকৃত অন্যায় এবং অপর কর্তৃক সংঘটিত অন্যায়ের প্রতি নির্লিপ্তের অপরাধ থেকে একনিষ্ঠ তাওবা করতে হবে। তাওবা অর্থ কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি আর কখনো ঘটবে না মর্মে আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। ব্যক্তি থেকে বিশ্বময় সর্বত্র সুদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, মদ-জুয়া, জুলুম-নিপীড়ন, ধর্ষণ-অশ্লীলতা স্বাভাবিক ও সাবলীল রূপ পরিগ্রহ করায় আমাদের প্রিয় বসুন্ধরা আজ ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এই ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবীর সম্মুখে দাঁড়িয়েও হতদরিদ্র মানুষের ক্ষুণিœœবারণের জন্য সরকারি ত্রাণের চাল ও তেল চুরির মতো অবিমৃশ্যকারিতার পাশাপাশি আমাদেরকে হত্যা, ধর্ষণের মতো লোমহর্ষক সংবাদও দেখতে হচ্ছে। এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতির সুযোগে গ্রামে গ্রামে বেড়ে গেছে মহাজনী সুদ-ব্যবসার প্রকোপ। এক দরিদ্রই অপর দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কাছে নিতে চাচ্ছে বাড়তি সুযোগ। মানবীয় সুকুমারবৃত্তিগুলো যেন ধ্বংসাভিমুখী অভিযাত্রায় নিয়ত ধাবমান। এর কারণ অনুসন্ধিৎসায় আমাদের সমাজ কারিগরদের সংবিৎশক্তিকে এখনই পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে কাক্সিক্ষত মানের মুমিন হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে করোনার মতো হাজার দুর্যোগ মোকাবেলা করাও কঠিন হবে না। তাই গঠনমূলক এবং দমনমূলক কর্মসূচির আওতায় এখনই সব অন্যায়-অনিয়ম কঠোর হস্তে প্রতিহত করতে না পারলে মহাবিপর্যয় থেকে আমরা কেউই রক্ষা পাবো না।
আল্লাহ-নির্ভরতাসহ বস্তুজাত উপকরণ গ্রহণ : এ দুর্বিষহ অবস্থায় নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে স্বাস্থ্যসহায়ক প্রয়োজনীয় উপায় অবলম্বন সাপেক্ষে যথার্থ অর্থেই মহান রাব্বুল আলামিনের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। কারণ বস্তুজাত সব উপায় অবলম্বনের বৈধতা কোনোভাবেই শর্তনিরপেক্ষ নয়। বরং এ ক্ষেত্রে দৃঢ়চিত্তে এই বিশ্বাস ধারণ করতে হবে যে, আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তা প্রতিহত করার শক্তি কারো নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন’ (সূরা ইনসান, আয়াত-৩০) যে আল্লাহর ওপরে নির্ভরশীল, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’ (সূরা তালাক, আয়াত-৩)। ‘আল্লাহ তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের পছন্দ করেন’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৫৯)। ‘একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা রাখতে হবে, তিনিই আমাদেরকে এ কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি দেবেন, প্রকৃত প্রস্তাবে তিনিই সব দুঃখ ক্লেশ থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত-৬৪)।
স্মর্তব্য, সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন, প্রচলিত সব চিকিৎসা গ্রহণ এবং আল্লাহর দরবারে অশ্রুবিগলিত নয়নে প্রার্থনা করার পরও যদি তাকদিরে মৃত্যুর অমোঘ ফায়সালা থাকে তাহলে সন্তুষ্টচিত্তে শাহাদাতের এ সওদা কবুল করতে হবে। আশা করতে হবে, আল্লাহ তায়ালা যেন ইয়াওমে মাহশারে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ, মুয়াজ ইবনে জাবাল, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা: ও তৎসঙ্গীয় অন্য সাহাবিদের সাথে শাহাদাতের অনন্য মর্যাদায় আমাকেও অভিষিক্ত করুন। আমীন। লেখক : অধ্যাপক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া