রাসূলুল্লাহ সা: অনেক কথা কিয়ামতের আলামত ও কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত হওয়া ফিৎনার বিবরণ হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর এ জাতীয় হাদিসগুলো বুঝতে না পারার কারণে দু’টি সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এক. যারা হাদিসগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের অনেকের মতে ঈসা ইবনে মরিয়াম আলাইহিস সাল্লাম ও ইমাম মাহদির আগমনের আগে ইসলামের বিজয় সম্বন্ধে হতাশা দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, ‘অনেক ধার্মিক লোকের মনেও (শেষ যুগ সম্পর্কে) একটি বিভ্রান্তিমূলক ধারণা দানা বেঁধে আছে। অন্য ভাষায় জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তি বদ্ধমূল হয়ে আছে। সে বিভ্রান্তিটি হলো- ইসলামের ভবিষ্যৎ পরিপূর্ণ অন্ধকার না হলেও প্রায় অন্ধকার। এ ধারণা তাদের মনে সৃষ্টি হয়েছে ফিৎনা-ফ্যাসাদ ও কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে বর্ণিত কিছু হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যার কারণে।এ কারণেই আমাদের আল কুরআনে, মহানবীর সুন্নাহয়, জাতির ইতিহাসে, প্রকৃত বাস্তবতায়, আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানে- যে বিধানের কোনো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয় না- ইসলাম প্রতিষ্ঠার যেসব সুসংবাদ রয়েছে তার প্রকৃতি উদঘাটন ও উদ্ভাসিত করতে হবে।
ইসলামের প্রত্যেক দাঈকে আল্লাহর ওয়াদা সম্পর্কে পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। আল্লাহর শেষ রিসালত ও চিরঞ্জীব দাওয়াতের উজ্জ¦ল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্ণ আশাবাদী হতে হবে। মনের ভেতর থেকে সব রকমের নৈরাশ্যতা-যা কিনা এক ধরনের কুফরি-ঝেড়ে ফেলতে হবে। হতাশা ও হীনম্মন্যতা- যা এক ধরনের বিভ্রান্তি- দূর করতে হবে।’ দুই. রাসূলুল্লাহ সা: যেসব কাজ ও বিষয়কে কিয়ামতের আলামত হিসেবে চিতি করেছেন সেসব বিষয় ও কাজকে অনেকেই -ইসলামি শরিয়তের উসূল না জানার কারণে- হারাম বলে মনে করেন। এ দেশের একজন প্রখ্যাত আলেম একবার আমার সামনে গান হারাম প্রমাণ করার জন্য নি¤েœর হাদিসটিকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন।
‘আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি নবী সা: থেকে বর্ণনা করেন, নবী সা: বলেন, আমি সেই সত্তার নামে শপথ করে বলছি দুনিয়া ততক্ষণ পর্যন্ত শেষ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এ উম্মাহর মধ্যে চন্দ্রগ্রহণ, আকৃতি-বিকৃতি ও পাথর বৃষ্টির ঘটনা ঘটবে। তখন জিজ্ঞাসা করা হলো হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ! এটা কখন ঘটবে? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, যখন দেখবে নারীরা ঘোড়ার জিনের ওপর আরোহণ করে ঘোড়া দৌড়াচ্ছে, আর গায়িকাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, মিথ্যা সাক্ষী দেয়া হচ্ছে, মুসল্লিরা মুশরিকদের স্বর্ণ ও রূপার পাত্রে পান করছে, পুরুষরা যৌন ব্যাপারে পুরুষের ওপর আর নারীরা নারীদের ওপর নির্ভর করছে…।
আমি ওই আলেমের এ বক্তব্য শুনে বললাম। এ হাদিস প্রমাণ করে যে, কেয়ামতের আগে গান-বাজনা বৃদ্ধি পাবে। গায়ক-গায়িকার সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু কোনো কিছু কেয়ামতের আলামত হলেই তা হারাম বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ, হাদিস শরিফে কিয়ামতের আগে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এমন কথা আছে। নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া কিয়ামতের আলমত বলে নারী-পুরুষের জন্য হারাম হবে না। তেমনিভাবে হাদিস শরিফে কিয়ামতের আগে পৃথিবী তার অভ্যন্তর থেকে খনিজ সম্পদ বের করে দেবে এমন কথাও আছে; তাই বলে খনিজ সম্পদ মানুষের জন্য হারাম হবে না। হাদিস শরিফে কিয়ামতের আগে লেখালেখি বেড়ে যাবে এমন কথাও আছে, তাই বলে লেখালেখি মানুষের জন্য হারাম হবে না।… তারপর আমি বললাম, কিয়ামতের আগে গান-বাজনা ও গায়ক-গায়িকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া সংক্রান্ত যত হাদিস আছে অনেক মুহাদ্দিসের মতে তার একটি হাদিসও সহিহ নয়। তা ছাড়া এ হাদিসগুলো গান-বাজনা অকাট্যভাবে হারাম প্রমাণও করে না। তবে গান-বাজনা হারাম প্রমাণ করার জন্য অনেকেই আল কুরআনের কয়েকটি আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কিছু হাদিস ব্যবহার করেছেন। আপনি ইচ্ছা করলে সেগুলো বলতে পারেন।… আমার এ ধরনের কথায় ওই আলেম নীরব হয়ে গেলেন। মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সা: যেসব জিনিস কিয়ামতের আগে কিয়ামতের আলামত হিসেবে সংঘটিত হবে বলে জানিয়েছেন সেসব কাজ দুই ধরনের।
ক) তার মধ্যে কিছু কাজ আছে যা আসলেই হারাম। তা কিয়ামতের আলামত হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় হারাম। কিয়ামতের আলমত হওয়ার কারণেই হারাম নয়। তবে হাদিস থেকে জানা যায় যে, এই হারাম কাজগুলো কিয়ামতের আগে বেশি পরিমাণে সংঘটিত হবে। যেমন- যেনা-ব্যভিচার বেড়ে যাওয়া, মাদক দ্রব্যের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
খ) আর কিছু কাজ আছে যা শরিয়তের দৃষ্টিতে আসলে হারাম নয়। সেগুলো কিয়ামতের আলমত হোক বা না হোক হারাম নয়। সুতরাং তা কিয়ামতের আগে বেশি হবে বলে তা হারাম হতে পারে না। এর একটি উদাহরণ হলো- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের আলামতের মধে কিছু আলামত হলো জ্ঞান উঠে যাওয়া আর অজ্ঞতা বিকশিত হওয়া। যেনা বেড়ে যাওয়া। মাদকদ্রব্য পান করতে থাকা। পুরুষদের চলে যাওয়া নারীদের বাকি থাকা; এমনকি পঞ্চাশজন নারীর জন্য একজন কাইয়্যিম বাকি থাকবে।’
এ হাদিসে কিয়ামতের আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যেনা-ব্যভিচার বৃদ্ধি পাওয়া ও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াকে। এই উভয় জিনিস বৃদ্ধি পাক আর না পাক সর্বাবস্থায় তা হারাম। অন্যদিকে কিয়ামতে আলামত হিসেবে এ হাদিসে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াকেও উল্লেখ করা হয়েছে। নারী এমন একটি বিষয় যা বৃদ্ধি পাক আর না পাক সর্বাবস্থায় পুরুষদের জন্য হালাল। সুতরাং বুঝা গেল কিয়ামতের আলামত হিসেবে নারীর সংখ্যা বেড়ে গেলেই নারী-পুরুষের জন্য হারাম হতে পারে না। এখান থেকে এ কথাও বুঝা গেল যে, কোনো কিছু কিয়ামতের আলমত হলেই তা হারাম হয়ে যায় না।
এর আরেকটি উদাহরণ হলো- হাদিসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের কিছু আলামত হলো (তার পূর্বে) সম্পদ উপচে পড়বে বা বৃদ্ধি পাবে, কলম জাহির হবে বা লেখালেখি বৃদ্ধি পাবে, আর ব্যবসা বেড়ে যাবে।’ এ হাদিসে উল্লিখিত বিষয়গুলো কিয়ামতের আলামত হলেও তার একটিও শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম নয়। লেখক: ইসলামিক স্কলার ও অধ্যাপক ,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া