অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো চীন, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া। চীনের উৎপাদন ২০ লাখ টনের বেশি। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে দেশটির মাছ উৎপাদনের তথ্য পুনর্মূল্যায়ন করা শুরু হয়। ফলে ২০১৭ সালে তাদের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়। উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতের উৎপাদন ছাড়িয়েছে ১৭ লাখ টন। চীনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণে ভারতের প্রবৃদ্ধি এখন শীর্ষে। এর পরই অবস্থান বাংলাদেশের, যেখানে বছরে মাছের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া কোনো দেশেরই প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় নেই। মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার প্রবৃদ্ধিতে স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ২৮ লাখ ৯৯ হাজার টন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছাড়িয়েছে ৪৫ লাখ ৩ হাজার টন। ফলে এক দশকে মাছ উৎপাদন বেড়েছে ১৬ লাখ টন বা প্রায় ৫৫ শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আবার অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনও বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার টন, পরের অর্থবছরে ১০ লাখ ৪৮ হাজার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ লাখ ৬৩ হাজার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ লাখ ১৭ হাজার ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ লাখ ৩৬ হাজার টন। ফলে পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার টন। এ সময়ে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশের এমন অর্জনের মধ্যেই শুরু হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২১। ‘বেশি বেশি মাছ চাষ করি, বেকারত্ব দূর করি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ২৮ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্ব্বর পর্যন্ত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন করবে মৎস্য অধিদপ্তর।
চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। শুধু তা-ই নয়, কয়েক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য আহরণে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি গত পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতেও বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২০-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, মৎস্য উৎপাদনে শীর্ষে থাকা চীনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে দ্বিতীয় অবস্থানে তুলে এনেছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য এখন আন্তর্জাতিক পরিম-লে স্বীকৃত। মৎস্য খাত বাংলাদেশে একটি স্বর্ণালি অধ্যায় সৃষ্টি করছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। এছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম। ইলিশ উৎপাদনে প্রথম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ। উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশের আরো একটি সফলতা যুক্ত হয়েছে। কেননা বিশ্বব্যাপী মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ধীরগতিসম্পন্ন। সেখানে বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবেই এগিয়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা হচ্ছে ভাতে-মাছে বাঙালির চিরন্তন বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশের মৎস্য খাতকে যেভাবে বিকশিত করা হয়েছে, এ ধারাকে অব্যাহত রেখে মৎস্যসম্পদে বিশ্বে আমরা অনন্য অসাধারণ জায়গায় পৌঁছে যাব। এ লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য খাতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে এবারের মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন হতে যাচ্ছে। দেশের মানুষের কাছে যে মাছগুলো দুর্লভ ছিল, সেগুলো ফিরে এসেছে। বিলুপ্তপ্রায় ৩১ প্রজাতির দেশীয় মাছকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মৎস্যজাত পণ্য তৈরি খাতকেও সরকার উৎসাহিত করছে। দেশের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় অঞ্চল তথা হাওর অঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চলে ভিন্ন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। মাছকে নিরাপদ রাখার জন্য অভয়াশ্রম সংরক্ষণ ও স¤প্রসারণ করছে সরকার। নদীতে যাতে মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং মাছ বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমন্বিতভাবে কাজ করছেন। মৎস্য খাতে উপযুক্ত পদক্ষেপের কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ, সামুদ্রিক মাছ ও অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদের বিস্তার ঘটছে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট উৎপাদিত মাছের সিংহভাগ উৎপাদন হয়েছে বদ্ধ জলাশয়ে। মূলত চাষকৃত বা পুকুর, আধা-বদ্ধ জলাশয়, বাঁওড় এবং চিংড়ি খামার, কাঁকড়া, পেন ও কেজ কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত হচ্ছে ৫৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় বা নদী ও মোহনা, সুন্দরবন, বিল, কাপ্তাই লেক এবং প্লাবনভূমি ও হাওর। এখানে উৎপাদন হচ্ছে দেশের মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ২৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। এছাড়া সামুদ্রিক মাছের অবদান ১৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য আহরণের উৎস হিসেবে নদী থেকে মাছ আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টন, বিলে এক লাখ টন, কাপ্তাই লেকে সাড়ে ১০ হাজার টন, প্লাবনভূমিতে উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৮১ হাজার টন। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের সঠিক মাত্রায় পানিপ্রবাহ ও উন্নত পরিবেশ না পাওয়ার কারণে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মাছের বসবাস ও খাবার উৎপাদন ক্ষমতাও অনেকটা হারিয়েছে নদীগুলো। তাই নদীতে এখন প্রাকৃতিকভাবে মাছ উৎপাদন তো হচ্ছেই না, মাছের পোনা ছাড়লেও পরিকল্পনামাফিক উৎপাদন হয় না।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মাছের অভয়াশ্রম ও প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ এবং মৎস্য আইন বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া পোনা অবমুক্তি, বিল নার্সারি স্থাপন, পোনা সংরক্ষণ কর্মসূচি, মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষ নিবিড়করণ, সমাজভিত্তিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ এবং মাছচাষীদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে মাছের উৎপাদন বাড়ছে। তবে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য আহরণ হিসেবে নদী, কাপ্তাই লেক ও বিলে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সারা বিশ্বেই মাছ উৎপাদনে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উৎস হলো নদী। কিন্তু মাছ উৎপাদনে আমরা নদীকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। এক সময় নদীতে ২৯০ প্রজাতির মাছ পাওয়া গেলেও এখন তা ১০০টিতে নেমে এসেছে। নদীতে মাছের উৎপাদন বাড়াতে সবার আগে নদীগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহের পাশাপাশি পানি দূষণমুক্ত করতে হবে। এটা হলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পোনা ছেড়ে কিংবা প্রাকৃতিক উপায়ে মাছ চাষ বাড়ানো সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণেই নদী থেকে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, নদীদূষণের কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। নদীশাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে যত্রতত্র বাঁধ দেয়ার ফলে প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি কোনোভাবেই বিল-বাঁওড় বা প্লাবনভূমিতে প্রবেশ করতে পারছে না। এসব নদীতে প্যানকালচার ইউনিটের আওতায় মাছ চাষ করতে গিয়ে নদী ও খাল-বিলে বাঁধ দিয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের অবাধ বিচরণে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে মাছের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে পানিপ্রবাহ কম থাকলে সেখানে দূষণের কারণে মাছের খাবার উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এছাড়াও নদীতে প্রজনন মৌসুমে প্রজননক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার ও মাছের আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। ১০-১২ প্রজাতির চাষকৃত মাছের পরিবর্তে অধিক পুষ্টি ও খনিজ সমৃদ্ধ নদীকেন্দ্রিক মাছ উৎপাদনে জোর দিতে তাই নদীর সঙ্গে জলাশয় বিশেষ করে খাল-বিল সংযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্চায় স্থানীয় শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। তা না হলে চাষকৃত মাছের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে।