শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫২ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
জব্দ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর রিট আরেক হত্যা মামলায় সাবেক বিচারপতি মানিককে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে মানহানির মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান উৎপাদনে ফিরলো কর্ণফুলী পেপার মিল ২০৫০ সালের মধ্যে ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণে দিল্লিতে মেয়ের সঙ্গে থাকছেন শেখ হাসিনা, দলবল নিয়ে ঘুরছেন পার্কে পিআইবির নতুন ডিজি ফারুক ওয়াসিফ, সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের এমডি এম আবদুল্লাহ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পোশাক শিল্প আইন আপনার হাতে তুলে নেয়ার কারো কোনো অধিকার নেই :স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দেয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বললেন মির্জা ফখরুল

ফুলগাজীর দুঃখ মুহুরী নদী

সাইফুল ইসলাম মজুমদার ফুলগাজী (ফেনী) :
  • আপডেট সময় রবিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত মূহুরী নদী। নদীর দুই পাশের জায়গা প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে পাকা স্থাপনা নির্মান করায় পরিবর্তন হয়ে গেছে মূহুরীর গতিপথ। নানা ধরনের দূষণে মূহুরী নদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। মূহুরী নদী সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বর্তমান অবস্থা:
মুহুরী নদী পরশুরাম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে নেমে এসেছে। এটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। ৬২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৭১ মিটার প্রস্থের মুহুরী নদীর প্রকৃতি সর্পিলাকার। মুহুরি নদী ত্রিপুরার লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করে মতাইছড়াসহ অর্ধশতাধিক ছড়া-খাল অতিক্রম করে পরশুরামের নিজ কালিকাপুর-মাঝিরখালি গ্রাম দিয়ে বিলোনিয়া সীমান্তে বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে। পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও সোনাগাজি উপজেলার বুক চিরে ফেনী নদীর সাথে মিলিত হয়ে মূহুরী নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। পাহাড়ী বন্যার প্রবল চাপে নদীবাঁধ ভেঙ্গে ও নদীর পাড় দখল করে বিভিন্ন স্থানে স্থাপনা নির্মান করায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। গতিপথ পরিবর্তনের ফলে ভারতের ভিতরে বিশাল আয়তনের চর সৃষ্টি করে মূল অবস্থান থেকে সরে আসে মূহুরী নদী। বাংলাদেশ অংশে নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে চরের পরিধি ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে যে চরের সৃষ্টি হয়েছে, সেটি মুহুরীর চর নামে পরিচিত। এই চরের বিস্তৃতি ৯২.৩৩ একর। অমীমাংসিত এ চর নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বহুবার সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। দুই দেশের রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায়ের প্রচেষ্টায় মুহুরীর চরের সমস্যা প্রায় সমাধানের পথে। এছাড়াও মুহুরী নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে ফুলগাজী-পরশুরামের শতাধিক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অপরদিকে ভারতের উজানে সামান্য বৃষ্টি হলে প্রবল পানির চাপে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও কয়েকবার একই স্থান দিয়ে ও বিভিন্ন নতুন নতুন স্থান দিয়ে বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়। গত ২৬ আগষ্ট সদ্য মেরামতকৃত স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিলে নেমে আসে জনদূর্ভোগ। পানির শ্রোত কমে গেলে ভাঙ্গন স্থানে নামমাত্র মেরামত করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিযুক্ত ঠিকাদার। কিন্তু ফের দূর্দশা দেখা দেয় ৫ সেপ্টেম্বর রবিবার। সকাল থেকে মুহুরী নদীর পানি কানায় কানায় ভরপুর হয়ে ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঘনিয়ামোড়া সদ্য মেরামতকৃত স্থানে আবারো ভাঙ্গন দেখা দেয়। ফলে পানির প্রবল শ্রোতে মুহুর্তের মধ্যে রাস্তা-ঘাট, মাছের ঘেরসহ, সদ্য রোপনকৃত আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এছাড়াও ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কে পানি কোমর পরিমান হয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
অর্থনীতিতে ভূমিকা:
মূহুরী নদীকে ফেনীর ‘প্রাণ’ বলা হয়। এ নদীকে কেন্দ্র করেই পরশুরাম বাজার, ফুলগাজী বাজারসহ ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও সোনাগাজি উপজেলায় গড়ে উঠেছে অধিকাংশ হাটবাজার। ফেনীর মানুষের মাছের চাহিদার সিংহভাগই আসে মুহুরী নদী থেকে। সোনাগাজীর মুহুরী প্রকল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য জোন হিসেবেও মুহুরী প্রকল্পের পরিচিতি রয়েছে। মুহুরী সেচ প্রকল্পের সুবাদে ফেনী এখন সুজলা-সুফলা। বর্ষার পানি সংরক্ষণ করে শুকনো মৌসুমে ২৩ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে চাষাবাদ করা হয়। প্রতি বছর অতিরিক্ত পাওয়া যায় প্রায় ৮১ হাজার টনের মতো খাদ্যশস্য। এতে বদলে গেছে গোটা জেলার জনজীবন। এছাড়া মূহুরী নদীর সিলিকাসমৃদ্ধ বালু ‘সোনার খনি’ হিসেবে খ্যাত। পাকা ঘর-বাড়ি ও স্থাপনা নির্মানে এ বালুর চাহিদা সর্বত্র। অতীতে নদীর বিভিন্ন স্থানে ১২ টি বালু মহালের ইজারা দিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। তবে ১ দশক ধরে এসব বালু মহাল ইজারা দেয়নি জেলা প্রশাসন। বর্তমানে পরশুরাম-ফুলগাজী উপজেলায় ২টি বালুঘাটের ইজারা রয়েছে। ইজারাবিহীন নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধভাবে এখনো বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালীরা।
দখলদারদের কানামাছি খেলা:
মুহুরী নদীর অন্তত ২৮ কি:মি: বাঁধের দুই পাশেই দখলদারদের রাজত্ব চলছে। চর ও পাড় দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে স’মিল দোকানপাট, ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। প্রভাবশালী চক্র ফুলগাজী বাজারের দুই পাশে পাকা ঘর, দোকানপাট, এবং বিভিন্ন জায়গায় নদী পাড়ে স্থ্পানা নির্মান ও পাকা ঘর নির্মান করে ভাড়া দিয়েছে। এছাড়াও দেড়পাড়া সহ বিভিন্ন স্থানে বিশাল আয়তনের চর দখল করে চাষাবাদ করছে প্রভাবশালীরা।
নদী দূষণ:
ভয়াবহ দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মুহুরী নদী। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে নদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী মাছ। মৎস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত মূহুরী নদী প্রায় মাছশূন্য হয়ে পড়েছে। এক সময় এ নদীতে বোয়াল, চিতল,গলদা চিংড়ি,পাবদা, পুঁটি, গজার, শোল, মাগুর, কৈ’সহ দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ পাওয়া যেত। ময়লা আবর্জনা ফেলে নদীর স্বাভাবিক গতিরোধ, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, কৃষি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারসহ নানা কারণে মূহুরী নদীর মাছ উৎপাদনের প্রজনন কেন্দ্রগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে মূহুরী নদী একেবারে মৎস্যশূন্য হয়ে যাবে বলে শংকা প্রকাশ করেছেন মৎস্য সংশ্লিষ্টরা। মূহুরী নদীর মাছ কমে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী বেশকিছু জেলে পরিবারে চলছে দুর্দিন।
মূহুরী বাঁধ প্রকল্প:
২০০৪ সালে প্রায় দেড়’শ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্বাবধানে মুহুরী, কহুয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প বাঁধের কাজ শুরু হয়। প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল থেকে রক্ষা ও বছরে অতিরিক্ত প্রায় ৪১ হাজার টন ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে এ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে শেষ হয়। তবে এ প্রকল্প কোনো কাজে আসেনি পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার মানুষের। প্রকল্প বাঁধ নির্মাণ যেভাবে করার কথা ছিল সেভাবে না করে (এলাইনমেন্ট) পরিবর্তন করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করায় নদীর পাড় থেকে ১শ’ মিটার দূরত্বে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, নদীর পাড় ঘেঁষে মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণ, দীর্ঘদিন নদীতে ড্রেজিং না করা, নদী ভাঙনের পর সময়মতো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না করে বাঁধ নির্মাণ, নদী দখল করে অবৈধভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং নদীর অনেক স্থানে ব্লক বসিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করায় প্রতি বছর বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হচ্ছে পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও সদর উপজেলার বিস্তীর্ণ অংশ। এদিকে মূহুরী নদীতে এখন পর্যন্ত ড্রেজিং করা হয়নি। নদীর অনেক স্থানে পলি জমে নাব্যতা সৃষ্টি হয়েছে। দেড়পাড়া গ্রামের কৃষক মো ইব্রাহিম হোসেন জানান,নদী ড্রেজিং ও বাঁকা নদী সোজা করলে প্রতিবছর বন্যার ক্ষতি কমে আসবে।
ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল আলিম মজুমদার জানান, প্রতিবছর বন্যায় মূহুরী নদী প্লাবিত হয়ে ফেনীর উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। নদী দখল করায় নদীর পানি চলাচলের প্রবাহ সংকুচিত হয়ে গেছে। নদীতে ড্রেসিং ও অবৈধ দখলমুক্ত করে নদীর স্বাভাবিক চলাচল ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, ত্রান নয়, আমরা ফুলগাজী বাসী এই মুহুরী নদীর স্থায়ী বাঁধ ও সংস্কার চাই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত দু’বছর আগে পানি সম্পদ উপমন্ত্রী ঘোষণা করে গিয়েছিলেন মুহুরী নদীর স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে ৮ শ কোটি টাকা বরাদ্ধ করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বরাদ্ধের কোন খবর তিনি জানেন না।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফেরদৌসি বেগম জানান, ইতিমধ্যে নদীর মুহুরী নদীর দখল উচ্ছেদ ও দূষণ পরিস্কার করতে জেলা মিটিং এ আলোচনা করা হয়েছে। অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে খুব শিঘ্রই উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে মুহুরী নদী দখলমুক্ত করা হবে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে রবিবার ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জহির উদ্দিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com