ঢাকের তালে নাচ-গান আর পূজা-অর্চনার মধ্যদিয়ে উদযাপন করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব। ওঁরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহান, মালো, মাহাতোসহ প্রায় ৩৮টি জাতিসত্ত্বার প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব কারাম পূজা। আনন্দঘন পরিবেশে নানা আয়োজনে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় কারাম উৎসব উদযাপন করা হয়। উৎসবটিকে ঘিরে আদিবাসী পল্লীগুলোতে বহুদিন আগে থেকেই ছিল সাজসাজ রব। ওঁরাওদের গ্রামে গ্রামে কারাম বৃক্ষের (খিলকদম) ডাল পূজাকে কেন্দ্র করে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় উত্তরের সমতল ভূমির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ এই উৎসব পালন করে আসছে। কারাম একটি গাছের নাম। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে এটি একটি পবিত্র গাছ। এই কারাম গাছকে তারা মঙ্গলের প্রতীক বলে মনে করেন। ওই গাছের ডাল কেটে মাটিতে পুঁতে রেখে পূজা-অর্চনা, নাচ-গান ও কিচ্ছা বলার মধ্য দিয়ে প্রতি বছর কারাম উৎসব পালন করে থাকেন তারা। পূজা শেষে ওই ডাল উঠিয়ে গ্রামের সব বয়সের নারী-পুরুষ নেচে-গেয়ে গ্রামের পুকুরে বিসর্জন দেয়। উৎসবকালে গাছ দেবতার কাছে ভালো ফসল প্রার্থনা করা হয়। শিশু কিশোর থেকে সব বয়সের ওঁরাও গানের সুরে সুরে প্রার্থনায় মেতে উঠে। গাছ দেবতার আনুকূল্য পাওয়ার জন্য ধান, শর্ষেদানা, কলাই, গম প্রভৃতি ফসলের বীজ এই কারাম গাছের গোড়ায় রাখা হয়। যেন গাছ দেবতা সামনের বছর ভালো ফলন দেয় ও জগতের সব বিপদ-আপদ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেন। প্রার্থনার সঙ্গে রাতভর চলে নৃত্যগীত ও হাড়িয়া পান। কারাম উৎসবকে ঘিরে ওঁরাও গ্রামগুলোতে প্রস্তুতি চলে ১৫ থেকে ২০ দিন। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০ থেকে ১১টা পর্যন্ত নাচ গান চলে। ওঁরাওরা এ উৎসবের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। এ উৎসব উপলক্ষে আলোচনা সভা এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী নৃত্যগীত পরিবেশিত হয়েছে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে মঙ্গলবার বিকেলে শহরের ডাকবাংলো মাঠে ১২-১৪টি সাংস্কৃতিক দল একসঙ্গে নাচ-গান পরিবেশন করেছে। নাচে-গানে ও ঢোল মাদলের আওয়াজে মাতোয়ারা হয় কারাম উৎসব দেখতে আসা নারী-পুরুষ। সাংস্কৃতিক পর্ব শেষে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সবিন চন্দ্র মুন্ডার সভাপতিত্বে আয়োজিত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান আহসান হাবীব ভোদন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান মিলন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল) এটিএম মাইনুল ইসলাম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অরুন চন্দ্র রায় প্রমুখ। বক্তারা বলেন, নিছক বিনোদনের জন্য নয়; এসব অনুষ্ঠান আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই। বক্তারা আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান। পরে সাংস্কৃতিক দলগুলোকে পুরস্কৃত করা হয়।