হেমন্তের শেষে শীতের আগমনের সাথে সাথে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সিংড়ার গাছিরা।এমনই এক দৃশ্য চোখে পড়ে উপজেলার ০৮নং শেরকোল ইউনিয়নের ভাগনাগরকান্দী গ্রামে। গ্রামের রাস্তায় দু পাশে সারি সারি অপরিচ্ছিন্ন খেজুর গাছ গুলোর পুরানো ডাল পালা কেটে পরিষ্কারের কাজ অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। শীতের তীব্রতা দেখা না দিলেও এরই মধ্যে অনেক গাছি অভাবের কারণে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এই শীতকাল গ্রামীণ মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ জীবনে শীত আসে বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের গাছিদের কাছে সে তো বিভিন্ন মাত্রায় রূপ নিয়ে। নানা স্বপ্ন আর প্রত্যাশায় তাদের অনেকটা সময় কেটে যায় এই খেজুর গাছের সাথে। বলতে গেলে সারাদিন এক গাছ থেকে অন্য গাছ এভাবেই কেটে যায় তাদের দিন। ওতপ্রোত ভাবে জড়িত গাছির জীবন সংগ্রামে বহু কষ্টের মাঝে অনেক প্রাপ্তিই মিটে যায় গ্রাম বাংলার এই জনপ্রিয় বৃক্ষ খেজুর গাছের সাথে। গাছিদের জন্য এই সময়টা হয় অনেক আনন্দদায়ক। কারণ এই গাছই তো গাছিদের অন্নদাতা। তাদের খেজুর গাছের যতœাদি না করলে যে রস মিলবে না। আর রস না মিললে গুড় হবে কি করে। ভোরের হাড় কাপানি ঠান্ডায় গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে হিমশীতল খেজুর রস খাওয়ার স্বাদটা একেবারেই যেন আলাদা। আসলে ভোর বেলায় রস খেলে শীত মনে হয় আরো বেশি জাঁকিয়ে বসে। তবে শীতে শরীর কাঁপানির স্পন্দন যেন চরম মজা আনন্দদায়ক। শীত লাগে লাগুক তবুও রস খাওয়ার কোন বিকল্প নেই। যত শীতই লাগুক রস খেতেই হবে। ঠান্ডা শীতের পরশে এক গ্লাস বা দুই গ্লাস রস খাওয়ার পরে পরেই কাপতে কাঁপতে আরো এক গ্লাস রস চুমুক দিয়ে বাড়ীর উঠানে রোদ তাপানোর আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। উপজেলার বিলভরট গ্রামের এক গাছিয়া আশরাফুল বলেন, খেজুর গাছ প্রায় ছয়/সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত রস দেয়। তবে গাছ যতই পুরনো হয় রস দেয়া ততই কমে যায়। পুরনো গাছ রস কম দিলেও পুরনো গাছের রসগুলো খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়। মাঝ বয়সের গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্য অবার অনেক ক্ষতিকর। ভাগনাগরকান্দী গ্রামের গাছিয়া সুঁকচান আলী প্রতিবেদককে জানান, রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাসের শুরুতে খেজুর গাছ পরিষ্কারের কাজ শুরু করা হয়।অগ্রহায়ন মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত বেশি পড়বে তত বেশি রস ঝরবে। রসের স্বাদও ততই মিষ্টি হবে। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ মাস হলো রসের ভরা মৌসুম। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত স্থান ভেদে একটি খেজুর গাছে মাসে ৪০-৫০ কেজি রস পাওয়া যায়। এই রস আবার জ্বাল দিয়ে তৈরি হবে গুড়। সেই গুড়ের আবার প্রকারভেদ আছে। পাটালি গুড় ও ঝোলা গুড়। এ সব গুড় বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়। শীতে খেজুর গাছের রস হতে যে গুড়ে তৈরি করা হয় তা দিয়ে দুধের পিঠা, পায়েস পুলি পিঠা, সেমাই পিঠা ইত্যাদি। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি রসের পিঠা খুবই সুস্বাদু হয়ে থাকে। শীত তার বিচিত্র রূপ ও রস নিয়ে হাজির হয় গ্রাম বাংলার মানুষের মাঝে। শীত যেন সৃষ্টির নিয়ামত তা উপলব্ধি করতে চাইলে অবশ্যই গ্রামে যেতে হবে। আশ্বিনের শুরু থেকেই গাছিরা খেজুর গাছ তোলা এবং পরিচর্যায় বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই উপযুক্ত সময় তারা নির্ধারণ করে মাঘের শীতেই গুড় বিক্রিয় এবং তৈরীর প্রক্রিয়ার সমাপ্ত ঘটে। গ্রামের বাজার গুলোতেও জমজমাট হয়ে ওঠে খেজুর রস এবং গুড়ে। প্রকৃত পক্ষেই শীতে উৎসব মুখর হয়ে উঠে গ্রাম বাংলায়। গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাড়ি ( ভাঁড়)ব্যবহার করা হয়। ভাঁড়টি আসলেই খুব ছোট আকৃতির কলসের মতো হয়ে থাকে। মাঝারি আকৃতির দশ বা পনেরো ভাঁড় রস জ্বাল দিয়েই এক ভাঁড় গুড় হয়। সেই এক ভাঁড় গুড়ের ওজন ছয় থেকে আট কেজির মতো বলা চলে। গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের পাত্রে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। এই খেজুর গুড় যারা বানায়, তাদের ঐতিহ্যগত পরিচয় তারা গুড়-শিল্পী। এই শিল্পীরা আদতে খেতে খামারে কাজ করে। আর শীতকালীন এই মৌসুমে তারা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তেরী করে দেশের বিভিন্ন যায়গায় বাজারজাত করে,বর্তমানে এই খেজুর গুড় কমবেশি দেশের সব জায়গায়তেই পাওয়া যায়।