অর্থনীতির বেশ কয়েকটি সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী। বেড়ে গেছে আমদানি ও রফতানি। রাজস্ব আয়েও গতি বেড়েছে। কিন্তু গতিহীন অবস্থায় পড়ে আছে শুধু ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এই বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৯০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। কিন্তু তিন মাস পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৮৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত তিন মাসে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ কমেছে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।
সাধারণত, ব্যাংকগুলো প্রতিমাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো নতুন ঋণ বিতরণ করে থাকে। এমনকি করোনা মহামারিতেও ব্যাংকগুলো গড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ বেড়েছে। কিন্তু গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিন মাসের পরিসংখ্যান বলছে, এই সময়ে ব্যাংকখাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ একটাকাও বাড়েনি, উল্টো কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন অর্থনীতি অনেকটা ঘুমিয়ে ছিল। এছাড়া অর্থবছরের শুরুতে উদ্যোক্তাদের অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে সময় নেয়। হয়ত সে কারণে এমনটি হয়েছে। ফলে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। দেখা যাবে, পরবর্তী কোয়ার্টারে ঠিক হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূলত প্রতি তিন মাস অন্তর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। ২০২০ সালের প্রকাশিত জুন থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই তিন মাসে ব্যাংকগুলোর ১৫ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা বিতরণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জুন শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৬৩৮ কোটি টাকা। ওই বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ১৬ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।
আর গতবছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে ব্যাংকগুলোর এ বিতরণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মার্চ শেষে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ৬৩ হাজার ২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ এই তিন মাসে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। আর এই বছরের মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৭ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৯০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েক বছর আগে তথ্য বিশ্লেষণ করেও দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেক মাসেই ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার নতুন ঋণ বিতরণ করতো ব্যাংকগুলো। ২০১৫ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে বিতরণ করা নতুন ঋণের পরিমাণ বেড়েছিল ২৬ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকখাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। একই বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লাখ ৭০ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। কিন্তু সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৮৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৯০ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই তিন মাসে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ কমেছে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পুঞ্জিভূত পরিমাণ ১২ লাখ ১০ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। আগের মাস আগস্টে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিলো ১১ লাখ ৯৪ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যমতে, গত আগস্টের ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে দশমিক ৩৫ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি। তবুও এর পরিমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। মূলত, বিনিয়োগ বাড়ায় চলতি মূলধনের চাহিদাই ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমে আসায় চলতি বছরের জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে ফিরে কিছুটা পুনরুদ্ধার লাভ করে। তারপর থেকে ঋণ প্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে যা ছিল যথাক্রমে- ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।