সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন

মানুষকে ভালোবাসার ফজিলত

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম:
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১

ভালোবাসার আরবি প্রতিশব্দ ‘মুহাব্বাত’। তা ‘হুববুন’ শব্দ থেকে গঠিত। যার অর্থ হৃদ্যতা, আসক্তি, আগ্রহ, পছন্দ, প্রেম, প্রণয়, বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা ইত্যাদি। ইসলামে পারস্পরিক ভালোবাসার গুরুত্ব অত্যধিক। মুমিন ভালোবাসে তার রবকে, তার রাসূলকে এবং মুমিন ভাইকে। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যায় : বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য এলাকায় তার মুমিন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশে বের হয়, আল্লাহ তায়ালা তার গমন পথে একজন ফেরেশতা বসিয়ে দেন। ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করে তুমি কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা করছ। সে বলে, ওই গ্রামে আমার একজন ভাই আছে, তার সাক্ষাতে যাচ্ছি। ফেরেশতা তখন জিজ্ঞেস করে, তার কাছে তোমার কোনো অনুগ্রহ আছে কি? যার বিনিময় লাভের জন্য তুমি যাচ্ছ। সে বলে, না, আমি তাকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসি। তখন ফেরেশতা বলে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার কাছে এই সংবাদ দিতে এসেছি যে, আল্লাহ তোমাকে অনুরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাকে ভালোবাস।’ (মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং-৫০০৭) হজরত ইবনে মাসউদ রা: বলেন, একদা এক সাহাবি মহানবী সা:-এর খেদমতে হাজির হয়ে বলে, হে আল্লাহর রাসূল! এমন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? যে ব্যক্তি কোনো স¤প্রদায়কে ভালোবাসে অথচ তাদের সাথে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। রাসূল সা: বলেন, ‘সে তাদের সাথেই রয়েছে যাদেরকে সে ভালোবাসে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) আরশের নিচে ছায়া পাবে: মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বিচার দিবসে বলবেন, আমার সুমহান ইজ্জতের খাতিরে যারা পরস্পরে ভালোবাসা স্থাপন করেছে; তারা কোথায়? আজ আমি তাদেরকে আমার বিশেষ ছায়া দান করব। আজ এমন দিন, আমার ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া নেই’ (মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং-৫০০৬)।
সৎ সঙ্গের দৃষ্টান্ত : মহানবী সা: বলেছেন, ‘ভালো লোকের সঙ্গ এবং মন্দ লোকের সঙ্গের দৃষ্টান্ত হলো- কস্তুরী বিক্রেতা আর কামারের হাঁপরে ফুঁ দানকারীর মতো। কস্তুরী বিক্রেতা তোমাকে হয়তো এমনিতেই কিছু দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে কস্তুরী ক্রয় করবে কিংবা তার কাছ থেকে সুঘ্রাণ পাবে। আর কামারের হাঁপরে ফুঁ দানকারীর কাছে গেলে তোমার জামা-কাপড় জ্বালিয়ে দেবে অথবা তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং-৪৬৬৯)। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা: বলেন, আমি রাসূল সা:কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যারা আমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, আমার উদ্দেশে সমাবেশে মিলিত হয়, আমার উদ্দেশে পরস্পর সাক্ষাত করে এবং আমার উদ্দেশে নিজের সব সম্পদ ব্যয় করে। তাদের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত।’ (মুয়াত্তামালিক, মিশকাত, হাদিস নং-৪৬৭০)। মানুষকে ভালোবাসার ফজিলত : হজরত ওমর রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা নবীও নন এবং শহীদও নন। কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার কাছে তাদের মর্যাদা এত বেশি হবে যে, তা দেখে নবী ও শহীদরা ঈর্ষা করবেন। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! বলুন, তারা কারা? তিনি বলেন, তারা এমন স¤প্রদায় যারা শুধু আত্মার সম্পর্কের ভিত্তিতে একে অন্যকে ভালোবেসেছে। তাদের মধ্যে আত্মীয়তার ও আর্থিক লেনদেনের কোনো সম্পর্ক নেই। বিচার দিবসে তাদের চেহারা হবে জ্যোতির্ময় এবং তারা উপবিষ্ট হবে নূরের ওপর। তারা ভীত হবে না, যখন সব মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হবে এবং চিন্তায় মগ্ন থাকবে।’ অতঃপর রাসূল সা: আয়াত পাঠ করেন, ‘জেনে রাখো! নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না’ (আবু দাউদ, মিশকাত, হাদিস নং-৪৬৭১)। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: হজরত আবুজার গিফারী রা:কে বলেন, ‘হে আবুজার ঈমানের কোন শাখাটি উত্তম?’ আবুজার রা: বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব স্থাপন করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্যকে ভালোবাসা এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ঘৃণা করে’ (বায়হাকি, মিশকাত, হাদিস নং-৫০১৪)।
কাউকে ভালোবাসলে তাকে অবহিত করা : কাউকে ভালোবাসলে তাকে অবহিত করতে হবে? মহানবী সা: বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে ভালোবাসে সে যেন অবহিত করে যে, সে তাকে ভালোবাসে’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, মিশকাত, হাদিস নং-৫০১৬)। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী সা:-এর পাশ দিয়ে গমন করেন, তখন সেখানে কিছু লোক ছিল। লোকটি তার নিকটস্থ এক ব্যক্তিকে লক্ষ করে বলল, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমি তাকে ভালোবাসি। রাসূলুল্লাহ সা: তখন বলেন, ‘তুমি যে তাকে ভালোবাস, তাকে কি অবহিত করেছ?’ লোকটি বলল না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ওঠো, যাও তাকে গিয়ে জানিয়ে দাও’। লোকটি তার কাছে গিয়ে জানাল। সে বলল, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসুক, যার সন্তুষ্টির জন্য তুমি আমাকে ভালোবেসেছ। লোকটি ফিরে এসে মহানবী সা:কে সব বলল। মহানবী সা: সব শুনে বললেন, ‘তুমি (পরকালে) তার সাথেই থাকবে, যাকে তুমি ভালোবাস’ (বায়হাকি, মিশকাত, হাদিস নং-৫০১৭)।
মহানবী সা: বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি কারো সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়, সে যেন তার নাম, পিতার নাম এবং এলাকা জিজ্ঞেস করে। কেননা, পরিচিতিতে ভালোবাসা সুদৃঢ় হয়’ (তিরমিজি, মিশকাত, হাদিস নং-৫০২০)। প্রিয় আমল : মহানবী সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসা এবং কাউকে ঘৃণা করা’ (আহমদ, আবু দাউদ, মিশকাত, হাদিস নং-৫০২১)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যদি দুই বান্দাহ একে অন্যকে ভালোবাসে, তাদের একজন প্রাচ্যে এবং অন্যজন পাশ্চাত্যে থাকলেও আল্লাহ তায়ালা উভয়কে বিচার দিবসে একত্র করবেন’ (বায়হাকি, মিশকাত, হাদিস নং-৫০২৪)। রাসূলুল্লাহ সা: অন্যত্র বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যারা একে অন্যকে ভালোবাসে তারা যাবারজাদ নামক উন্নত মুক্তার গৃহে একত্রে বসবাস করবে’ (বায়হাকি, মিশকাত, হাদিস নং-৫০২৬)। মহানবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসল, কাউকে দান করল, কাউকে নিষেধ করল, সে যেন তার ঈমানকে পূর্ণ করল’ (আবু দাউদ)।
লেখক: প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com