কভিড-১৯ মহামারীকালীন সারা বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও বিভিন্ন শস্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে ব্যতিক্রম পরিস্থিতি অবলোকন করেছে দেশের চা উৎপাদন খাত। মহামারী-উত্তর সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদিত হয়েছে। সদ্যসমাপ্ত বছরে দেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড করতে যাচ্ছে দেশীয় বাগান মালিকরা। সর্বশেষ নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৯ কোটি কেজি চা উৎপাদন খাতসংশ্লিষ্টদের মনে নতুন আশার স ার করছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সর্বশেষ চা উৎপাদন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সদ্যবিদায়ী বছরের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ৯৫ লাখ ৭৪ হাজার কেজি, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদিত চায়ের তুলনায় ৩১ লাখ ৮০ হাজার কেজি বেশি। ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী দেশের বাগানগুলোতে ৬৪ লাখ ৯৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হলেই পানীয় পণ্যটির উৎপাদনে নতুন রেকর্ড স্পর্শ করবে বাংলাদেশ।
চা বোর্ড বলছে, নতুন রেকর্ড স্পর্শ করার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৬৯ লাখ ৬১ হাজার কেজি চা উৎপাদন করেছিলেন বাগান মালিকরা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চা উৎপাদন হয়েছিল ৬৪ লাখ ২৩ হাজার কেজি। ফলে অনুকূল আবহাওয়া থাকায় সদ্যসমাপ্ত মাসে আগের বছরগুলোর একই মাসের ন্যায় চা উৎপাদন অসম্ভব কিছু নয়। এক্ষেত্রে ১ কোটি ৪ লাখ ২৬ হাজার কেজি চা উৎপাদন করলেই বাংলাদেশ আগের রেকর্ড অতিক্রম করার পাশাপাশি এক বছরে ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদনের মাইলফলকে পৌঁছবে। চা বোর্ডের তত্ত্বাবধানে দেশের ১৬৭টি চা বাগান ও সমতলের ক্ষুদ্রায়তন চাষীরা সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
এদিকে সদ্যসমাপ্ত বছরে চা বাগানগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎপাদন হওয়ায় নিলাম বাজারেও চায়ের সরবরাহ বেড়েছে। প্রতিটি নিলামেই আগের বছরের চেয়ে বাড়তি চা পাঠাচ্ছে বাগানগুলো। সর্বশেষ ২৭ ডিসেম্বর ৩৩তম আন্তর্জাতিক নিলামে আগের বছরের একই নিলামের চেয়ে ১০ লাখ ১২ হাজার ৭১৯ কেজি বেশি চা পাঠানো হয়েছিল। আগামী ৩৪তম নিলামে ৩৪ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৭ কেজি চা বিক্রির জন্য প্রস্তাব ঘোষণা করেছে বাগানগুলো, যা আগের বছরের একই সময়ের নিলামের চেয়ে ৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৯ কেজি বেশি। অন্যদিকে বার্ষিক ভোগের তুলনায় সরবরাহের পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রতিটি নিলামেই অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে ৩০-৪০ শতাংশ চা।
বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বাগানগুলো চা উৎপাদনে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এগিয়ে গেছে। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ছাড়াও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে প্রতি বছরই চা উৎপাদন বাড়ছে। গত দুই বছর চা উৎপাদনে কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব থাকলেও চা বোর্ড ও চা সংসদের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বাগানগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো ফল পেয়েছে। চা উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের চায়ের সুনাম আবারো ফিরে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
চা বোর্ডের তথ্য থেকে জানা গেছে, সদ্যসমাপ্ত বছরের জুন মাস থেকেই গড়ে এক কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদন করে আসছে বাগানগুলো। জুন মাস থেকে চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম শুরু হয়। উল্লিখিত মাসে বাগানগুলোতে চা উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার কেজি, জুলাইয়ে ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৮ হাজার কেজি, আগস্টে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৮৭ হাজার, সেপ্টেম্বরে ১ কোটি ২৬ লাখ ৭ হাজার। অক্টোবর মাসে মাসভিত্তিক রেকর্ড ১ কোটি ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার এবং নভেম্বরে ১ কোটি ২ লাখ ৪১ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।
জানা গেছে, উৎপাদন পর্যাপ্ত পরিমাণ হলেও সদ্য বিদায়ী বছরে নিলাম বাজারে তুলনামূলক কম দামে চা বিক্রি হয়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশে অনুষ্ঠিত নিলামে প্রতি কেজি চায়ের গড় মূল্য ২৫০ থেকে ২৭০ টাকার মধ্যে থাকলেও ২০২১ সালে তা ২০০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। ফলে উৎপাদন বাড়লেও চা উৎপাদন ও বিপণনে লোকসান গুনেছে অধিকাংশ বাগান মালিক। অন্যদিকে প্রতিটি নিলামেই ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ চা অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। উদ্বৃত্ত এসব চা পরবর্তী নিলামগুলোতে কম দামে বিক্রির জন্য প্রস্তাব আসায় লোকসানের কবলে পড়ছেন বাগান মালিকরা। বাগান মালিকরা বলছেন, এসব বাড়তি চা বিশ্ববাজারে রফতানি না করা গেলে চা উৎপাদনের ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশের বাগানগুলো বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের মাধ্যমে চা উৎপাদন ও বিপণন করলেও সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো দিয়ে ভারতীয় কমদামের নি¤œমানের চা প্রবেশ করছে। যার কারণে দেশের বাগান মালিকরা নিলামে কম দামে চা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সীমান্ত এলাকায় অবৈধ চা প্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি দেশীয় চা খাতের জন্য সরকারি প্রণোদনা ও ব্যবস্থাপনা জোরদার করা না হলে উৎপাদনের ঊর্ধ্বমুখী ধারা বিনষ্ট হবে।
দেশে চায়ের বার্ষিক ভোগ্যতা প্রায় সাড়ে নয় কোটি কেজি। করোনাকালের ব্যবহার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় বড় ধরনের লোকসান গুনছেন বাগান মালিকরা। লোকসান কাটিয়ে উঠতে সরকারি প্রণোদনা ছাড়াও নিজ উদ্যোগে নতুন বিনিয়োগে যেতে হচ্ছে বাগান মালিকদের। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, রেশনের ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেছে বাগানগুলো। আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ ও অবৈধ চা প্রবেশ বন্ধ হলে দেশের চা খাত নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা বাগান মালিকদের। চা খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেভাবে দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে সেভাবে চায়ের রফতানি বাড়ছে না। যার কারণে দেশীয় চায়ের দাম কমে যাওয়ার কারণে বাগান মালিকরা লোকসানের মুখে পড়ছে। রফতানির পরিমাণ বাড়ানো না গেলে আগামীতে চায়ের দাম আরো কমে আসবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।-বণিকবার্তা