মাত্র ১০ মিনিটে ধোয়া যাবে ১৪ কোচের একটি ট্রেন। এতে রেলের জনবলের পেছনে ব্যয় কমবে। স্বল্প সময়ে ধোয়া যাবে ট্রেন। এভাবে নিয়মিত ধোয়ামোছার ফলে চকচকে ট্রেন পাবেন যাত্রীরা। এমন সুবিধার কথা বলে রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশন ও রাজশাহীতে আলাদা দুটি ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিন্তু চালুর মাত্র দুই মাসের মাথায় দেখা যাচ্ছে ওয়াশিং প্ল্যান্ট দুটি তেমন একটা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আগের মতো ‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতিতেই চলছে ট্রেন ধোয়ামোছার কাজ। অথচ প্ল্যান্ট দুটি স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামোগতভাবে ভুল জায়গায় বসেছে ওয়াশিং প্ল্যান্ট। তাই মিলছে না সুফল। এখন প্ল্যাটফরম থেকে তিনবার ইঞ্জিন পরিবর্তন ও তিন স্থানে কোচ থামিয়ে নেওয়া হয় ওয়াশিং প্ল্যান্টে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে দ্বিগুণ। তাই প্ল্যান্টটিতে দিনে দুই থেকে তিনটি ট্রেন ধোয়া হয়। বাকিগুলো পুরোনো পদ্ধতিতেই পরিষ্কার করেন শ্রমিকেরা।
প্ল্যান্ট স্থাপনের পর কেন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রেন ধোয়া হচ্ছে, এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়। এই প্ল্যান্টের প্রকল্প পরিচালক বলছেন, প্ল্যান্ট ব্যবহারে কিছু অসুবিধা রয়েছে। অন্যদিকে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, প্ল্যান্টে পর্যাপ্ত কোচ ধোয়ার সুযোগ রয়েছে। সব কোচ প্ল্যান্টেই ধোয়া হবে। তবে ভিন্ন কথা বলেছেন ট্রেন পরিষ্কারের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকেরা। তারা জানান, স্বয়ংক্রিয় ওয়াশিং প্ল্যান্টে মূলত ট্রেনের দরজা-জানালা বন্ধ করে বাইরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানো হয়। এরপর দুই পাশে দুটি বড় ব্রাশ দিয়ে কোচ মুছে দেওয়া হয়। পরে যন্ত্রে জোরে হাওয়া ছাড়ার মাধ্যমে কোচ শুকানো হয়। কিন্তু ট্রেনের ভেতরে ঝাড়ু ও শৌচাগার শ্রমিকদের দিয়ে পরিষ্কার করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে রেলওয়ের ব্যয় কমেনি, বরং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র চালাতে গিয়ে বিদ্যুৎ বাবদ খরচ বেশি হচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য মিটারগেজ ও ব্রডগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এ প্রকল্পের আওতায় ২০০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ ও ৫০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুটি অটোমেটিক ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্ট কেনা হয়। এর মধ্যে কমলাপুরে একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়, আরেকটি রাজশাহীতে। এই প্রকল্পে ৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এর মধ্যে গত ৮ নভেম্বর ‘ওয়াশিং প্ল্যান্ট’ দুটি উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। ওই দিন এই প্ল্যান্টে ১০ মিনিটের মধ্যে একটি ট্রেনের (গড়ে ১৪টি কোচ) বাইরের অংশ পরিষ্কার করে উপস্থিত সবাইকে তা দেখানো হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে হাত ও ব্রাশ দিয়ে ঘষে ট্রেনের ভেতর এবং বাইরের অংশ পরিষ্কার করা হতো। এতে বগি ঠিকমতো পরিষ্কার হতো না। বিভিন্ন অংশে কালো দাগ পড়তো। এখন আধুনিক পদ্ধতিতে প্ল্যান্টে ট্রেন ঢুকলেই জানালা-দরজা লাগিয়ে ওয়াশিং পাউডার ও পানি দিয়ে অটোমেটিক পদ্ধতিতে পরিষ্কার হয়ে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে আসবে। এতে ট্রেন ঝকঝকে দেখাবে। এছাড়া এ প্ল্যান্ট প্রতিদিন কমপক্ষে এক লাখ লিটার পানি সাশ্রয় করবে, যা ব্যবহৃত পানির ৭০ শতাংশই রি-সাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এখন রেলে আন্তঃনগর ট্রেনের কোচ আছে প্রায় ৭০০টি। এগুলো দিয়ে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ১০০টির মতো ট্রেন নানা গন্তব্যে চলাচল করে। এর বাইরে আছে মেইল, কমিউটার ও লোকাল ট্রেন। এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেনই প্রতিনিয়ত ধোয়া হয়। কাজটি করা হয় যাত্রা শুরুর স্টেশনে। এর মধ্যে কমলাপুরে প্রতিদিন গড়ে ৩০টি ট্রেন পরিষ্কার করা হয়।
কমলাপুর স্টেশনের শাহজাহানপুর অংশে আগে থেকেই ট্রেন ধোয়ামোছার জন্য নির্ধারিত জায়গা আছে। এর পাশেই পৃথক লাইনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটি বসানো হয়েছে। যার দুই পাশে টিনের বেড়া, ওপরে ছাউনি। এর ভেতরে একসঙ্গে ১৩ থেকে ১৪টি কোচ প্রবেশ করতে পারে। গত ৫ জানুয়ারি সকালে গিয়ে দেখা যায়, প্ল্যান্টটিতে কোনো ট্রেন নেই। ভেতরে বালি, ময়লা ছড়িয়ে আছে। এখানে কখন ট্রেন পরিষ্কার করা হবে, এ বিষয়ে জানতে সংশ্লিষ্টদের কাউকে পাওয়া যায়নি। একবার ব্যবহৃত পানি শোধন করে আবার কাজে লাগানোর কথা থাকলেও তা পুনরায় ব্যবহারের কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। অন্যদিকে এই প্ল্যান্টের পূর্ব পাশে আগের নিয়মে ট্রেন ধোয়ার নির্ধারিত জায়গায় ডিটারজেন্ট ও ব্রাশ দিয়ে ট্রেন পরিষ্কার করতে দেখা যায় আট শ্রমিককে। এর মধ্যে একজন পাইপ দিয়ে কোচে পানি ছিটাচ্ছিলেন। এভাবে একটি ট্রেন পরিষ্কার করতে তাদের ৪০ থেকে ৫০ মিনিট সময় লাগছে। দুই বছর ধরে ব্রাশ দিয়ে ট্রেন পরিষ্কার করেন রমজান আলী। তিনি জানান, তারা দিনে ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রেন পাউডার ও ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করেন। এজন্য তাদের ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। আর ওয়াশিং প্ল্যান্টে দিনে মাত্র দুটি ট্রেন ধোয়া হয়। ওয়াশিং প্ল্যান্টের ইনচার্জ মো. হাদিউজ্জামান বলেন, এটা যদি সামনের দিকে হতো, তাহলে যখনই ট্রেনগুলো ওয়াশপিটে (ওয়াশিং প্ল্যান্ট) ঢোকানো হচ্ছে তখনই পরিষ্কার হয়ে চলে আসতো। এখন উল্টোদিকে হওয়ার কারণে কাজ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ট্রেন পরিচ্ছন্নতার কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা রেলওয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, কমলাপুরে দিনে গড়ে ৩০টি ট্রেন ধোয়ামোছার কাজ করতে হয়। সব ট্রেনই সকালে ও সন্ধ্যায় অল্প সময়ের মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় যে ওয়াশিং প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে, তাতে দু-তিনটির বেশি ট্রেন ধোয়া যাচ্ছে না। কারণ, যন্ত্রটি দিয়ে বেশি ট্রেন ধুতে গেলে সেটি বিকল হওয়ার ভয় আছে। এছাড়া ওয়াশিং প্ল্যান্টে ট্রেন ধোয়ার পর আবার শ্রমিকদের দিয়ে সেই ট্রেন পরিষ্কার করতে হচ্ছে। রাজশাহীর প্ল্যান্টটিও বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে।
জানতে চাইলে স্বয়ংক্রিয় ট্রেন ওয়াশিং প্ল্যান্টের প্রকল্প কর্মকর্তা ফকির মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্ল্যান্টে যন্ত্রে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। তবে ভুল জায়গায় এই প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। এখন এটির ব্যবহারের সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। প্রকল্প নেওয়ার সময় কেন এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, এমন প্রশ্নের এড়িয়ে যান তিনি।- জাগো নিউজ