গ্রামবাংলার চিরচেনা একটি পাখি ‘হলদে পাখি’। দেশের অনেক অঞ্চলে ‘কুটুম পাখি’ বা ‘বেনে বউ’ বলেও ডাকেন অনেকেদেখতে চমৎকার আর সুরেলা কণ্ঠের কারণে পাখিটি নিজের গুণেই মানুষের নজর কাড়ে। এই পাখিটি সব ঋতুতে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ মাতিয়ে রাখে। বাড়ির আঙ্গিনার বাঁশঝাড়, বট, পেয়ারা, ডালিম, চালতাসহ সকল গাছের ডালে বসে ডাকাডাকি করে। এদের আবার শিশুরা মুখ ভেংচিয়ে খেপায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে প্রকৃতিতে কমেছে এ পাখির সংখ্যা। খুব একটা দেখা না মিললেও সম্প্রতি নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার ভাবলা গ্রামে একটি আমবাগানে দেখা মেলে হলদে বা কুটুম পাখির। উড়ে বেড়ানোর সময় ক্যামেরায় বন্দি করা হয় পাখিটি। তবে অল্প সময়ের মধ্যে আবার চোখের আড়াল হয়ে যায়। হলদে বা কুটুম পাখির বৈজ্ঞানিক নাম ওরিওলিদি এবং ইংরেজি নাম অরিওল। গায়ের পালক উজ্জ্বল হলুদ। এই পাখিটি আকৃতিতে অনেকটা শালিকের মতো। দৈর্ঘ্য ২২-২৪ সেন্টিমিটার। গায়ের পালক উজ্জ্বল হলুদ। লেজ ও পাখার অগ্রভাগের পালক কালো। গলা ও মাথার রং চিকচিকে কালো হলেও ঠোঁট ও চোখ লাল টকটকে। আর পা দুটো হালকা কালো। এরা সাধারণত ঝোপ-ঝাড়ে, শুকনো ডালপালা, খড়কুটো বা আগাছা দিয়ে গাছের ডালে বাসা বানায়। বসন্ত ও গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় সাধারণত এদের প্রজনন মৌসুম। সাদা রঙের বাদামি ফোঁটাযুক্ত তিন-চারটি ডিম পাড়ে। ডিমে তা দেয় পুরুষ ও মেয়ে পাখি মিলে। ১৫ থেকে ১৭ দিনে বাচ্চা ফোটায়। এদের ঠোঁট লম্বা। কুটুম পাখিরা পোকা-মাকড় ও ফল খায়। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পাখিগুলোর বাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আমাদের পাক-পাখালি। কিন্তু মানুষের অতি লোভ আর আগ্রাসী আচরণে উজাড় হয়ে যাচ্ছে তাদেও আবাসস্থল বনজঙ্গল ও দেশীয় গাছগাছালি আর বৃক্ষলতা। ফলে জীববৈচিত্র্যের বড় ক্ষতি হচ্ছে। বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে কুটুম পাখিসহ দেশীয় প্রজাতির সব পাখি। তবে এরা এখনো আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এ প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। পাখিপ্রেমী চকমখোলার আলামীন বলেন, মানুষের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বট, আম, জাম, চামকাঁঠালসহ বড় বড় গাছ উজাড় হয়ে গেছে। ফলে দেশীয় প্রজাতির অনেক পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় হলদে পাখি খুবই কাছাকাছি দেখা যেতো। কিন্তু এখন এদের কম দেখা যায়। উপজেলার বেলাব ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক সোলায়মান খন্দকার বলেন, আমাদের প্রকৃতি থেকে পরিবেশ বান্ধব বৃক্ষলতা হারিয়ে যাওয়ায় কৃষক বন্ধু পাখিটি কমে গেছে। ফসলের ক্ষতিকারক পোকা-মাকড়ই এদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু পাখিটি কমে যাওয়ায় পোকা মাকড়ের কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। এখন এই পাখিটি গ্রামবাংলায় সচরাচর চোখে পড়ে না। পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হকের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে হলদে পাখি বা বেনেবউ পাওয়া যায়। তবে এদেও বাসস্থান, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ, বনজঙ্গল উজাড় করার কারণে চিরচেনা এ পাখি বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ ও সবার সহযোগিতা জরুরি।