আজ ১৯ জানুয়ারি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’। ২০০৩ সালে ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে তৎকালীন সরকার এ দিবসটি চালু করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ভাবে ৫ই অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়ে থাকে। শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক ছাড়া যোগ্য সমাজ ও উজ্জ্বল জীবন কল্পনাতীত। শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের কাছে বাবা-মায়ের মতো। বাবা-মা যেমন তাদের ভালোবাসা-স্নেহ-মমতা দিয়ে সন্তানদের বড় করেন, ঠিক তেমনি শিক্ষকেরা শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যান। এর সাথে থাকে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা। তাঁদের শিক্ষার আলো যেমনি শিক্ষার্থীদের সামনের পথ চলাকে সুদৃঢ় করে, তেমনি তাদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে।
আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় আজ আমাদের দেশে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা একদম নি¤œ পর্যায়ে চলে গেছে। শিক্ষকতার মত সৃজনশীল পেশা খুব কমই আছে পৃথিবীতে। শিক্ষকদের পেশাজীবন কেবল একটি চাকরির ক্ষেত্রে সীমিত হলেও, একজন মানুষের জীবনে আদর্শবান শিক্ষকদের গুরুত্ব অপরিসীম। এই পেশায় নিয়োজিত হওয়ার পুর্বে মানুষ সাধারনত দুটি দিক থেকে অনুপ্রাণিত হয়। একটি চাকরি অথবা অর্থনৈতিক প্রবণতা, অন্যটি আদর্শিক বা ভাবপ্রবণতার দিক। প্রথমটির মাধ্যমে তিনি চান অর্থ সম্পদ যার দ্বারা সাংসারিক জীবনে একদিকে যেমন সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করা যায় অন্যদিকে তেমনি তার সৎ ব্যবহারের দ্বারা জীবনে সম্মান ও গৌরবের সর্বোচ্চ স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা অর্জন করা যায়। দ্বিতীয়টি দ্বারা তিনি চান সেবা ও আত্মনিয়োগ। যারা দ্বিতীয়টি দ্বারা অনুপ্রাণিত হন তারা পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধির দিকে আর্থিক মনোযোগী নন। ফলে উৎসর্গীকৃত জীবন যাপনে তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। প্রকৃত আদর্শ শিক্ষক হতে হলে চাই আত্মউৎসর্গ করার প্রেরণা।
করোনা মহামারির কারণে লন্ডভন্ড বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। চরম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন শিক্ষকরাও। লাখ লাখ শিক্ষার্থী আজ শিক্ষাঙ্গনের বাইরে। তাদের একটি বড় অংশ পরিবারসহ রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ সংকটের ও নানান প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের শিক্ষক সমাজ আগামী প্রজন্মকে একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ হাতে ডিজিটাল কন্টেন্ট বেইসড, জুম এ্যাপস্, গুগুলমিট, ফেসবুক লাইভ, মেসেঞ্জার, ইউটিউব চ্যানেল সহ বিভিন্ন মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে উদ্দীপনা ও সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
তাঁরা ব্যক্তিগত প্রয়াস, সংশ্লিষ্টজনের সহযোগিতা আর প্রযুক্তির প্রয়োগ ও সুযোগের সমন্বয়ে শিক্ষার অবিরত ধারা অব্যাহত রেখেছেন। ঠিক তেমনিভাবে অনাগত দিনে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে আস্থার পরিবেশ তৈরি করে, শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে দিতে হবে সামাজিক নেতৃত্ব ও রাখতে হবে বলিষ্ঠ ভূমিকা। বুঝিয়ে দিতে হবে জাতিগঠনে তাঁদের অনিস্বীকার্য গুরুত্ব ও অবদান। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে নিকৃষ্ট দিক হচ্ছে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ। বিশাল এই জনগোষ্ঠী দেশের সম্পদ। তবে বর্তমানে বেসরকারি স্কুল-কলেজের ভীড়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। সা¤প্রতিক আমাদের দেশে বিভিন্ন অনৈতিক, অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, ঘুষ, জালিয়াতি এমনকি ধর্ষনের মতো স্পর্শকাতর কর্মকান্ডেও শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা বরাবরই লক্ষ্যনীয়। এছাড়া মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপর্যায়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে পূর্বে যে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক এবং উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে হয়েছে বলে শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে।
আজ এই শিক্ষক দিবসের অঙ্গীকার হোক শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত দেশ উপহার দেয়ার। শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে উন্নত নৈতিক চরিত্রবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক উপহার দেয়াই হোক শিক্ষক সমাজের আজকের দিনের শপথ।