জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমানে ধানের বীজতলায় ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়েই চলেছে। চলতি বোরো মৌসুমে কৃষক বরিশালের কৃষক মিলন তালুকদার তার ৩০ শতক বীজতলায় ক্ষতিকর পোকামাকড় বিশেষ করে মাজরা পোকা দমনের জন্য দুইবার সেতারা ও কারটাপ গ্রুপের কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন। এতে করে এ কৃষকের ধানের বীজতলায় কীটনাশক ও প্রয়োগ খরচ মিলিয়ে প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হয়েছে। শুধু কৃষক মিলনই নয় এ চিত্র প্রায় সারাদেশের। অধিকাংশ কৃষক বীজতলায় গড়ে দুইবার কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। এতে করে একদিকে যেমন কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি মাটি, পানি, বায়ু তথা পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে কীটনাশক প্রয়োগজনিত কারণে কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। কৃষিবিদ মামুনুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ধানের বীজতলায় থ্রিপস, মাজরা পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, পামরি, গাছফড়িং ইত্যাদি পোকার আধিক্য দেখা দিয়েছে। বীজতলায় পোকা দেখামাত্রই কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। এতে করে কীটনাশকের ব্যবহার দ্রুতই বাড়ছে। বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন এসোসিয়েশনের এক রির্পোটে জানা গেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে কীটনাশকের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৫৬৩ মেট্টিক টন। সারাদেশে শুধু বীজতলায় কীটনাশক বাবদ কৃষকের খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। কৃষকের মাঠের এ দুর্দশা দেখে ধানের বীজতলার ক্ষতিকর পোকা দমনে একটি যন্ত্র আবিস্কারে মনোনিবেশ করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ববিদ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান কবির। তার এ গবেষণায় সহযোগী হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয় বরিশালের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আলমগীর হোসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথমবছরেই উদ্ভাবক মনিরুজ্জামানের হাতজাল যন্ত্রটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। কৃষকরা এ যন্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক উপকৃত হয়েছেন। উদ্ভাবক মনিরুজ্জামান কবির বলেন, গোলাকার হাতজাল মূলত ধান গাছের ক্যানপি বা পাতা থেকে পোকামাকড় ধরার যন্ত্র। হাতজাল তৈরির উপায় ॥ চারকোণা কাঠামোতে চার মিলি জিআই তার ব্যবহার করা হয়েছে। আয়তাকার কাঠামোটির দৈর্ঘ্য ৫০ সেন্টি মিটার ও প্রস্থ ২০ সেন্টি মিটার। হাতজালের প্লাস্টিক পাইপের তৈরি হাতলের দৈর্ঘ্য হবে ১০০ সেন্টি মিটার। ৮০ থেকে ১০০ সেন্টি মিটার মশারির জাল চারকোণা কাঠামোতে লাগিয়ে দিতে হবে। মশারির জালের রং হবে সাদা। কৃষকরা নিজেরা বাড়িতে বা স্থানীয় ওয়েল্ডিং এর দোকানে তিনশ’ টাকা ব্যয় করে তৈরি করতে পারবেন এ হাতজাল। ব্যবহারের উপায় ॥ হাতজালটি ধানের বীজতলায় দ্রুত হাটার তালে তালে টেনে নিতে হবে। অংকুরিত বীজ বীজতলায় ফেলার সাত থেকে নয়দিন পর থেকে সাতদিন অন্তর মশারির জালে আটকা ক্ষতিকর পোকা যেমন থ্রিপস, মাজরা পোকা, বাদামি গাছফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, পামরি, গাছফড়িং ইত্যাদি ধ্বংষ করে ফেলতে হবে। হাতজালের মশারিতে বন্ধুপোকা যেমন মাকড়সা, ফড়িং, গ্রীন মিরিড বাগ ইত্যাদি ধরা পরলে বীজতলায় ছেড়ে দিতে হবে। হাতজালের সুবিধা ॥ আদর্শ বীজতলায় দুইবার হেঁটে হাতজাল টানলে সকল ক্ষতিকর পোকামাকড় ধরে ধ্বংষ করা যায়। এতে করে প্রতিবিঘা বীজতলায় কীটনাশক বাবদ কৃষকের এক হাজার টাকা সাশ্রয় হবে। কীটনাশক প্রয়োগজনিত কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে। মাটি, পানি ও বায়ুর দূষন কমবে। কীটনাশকের ব্যবহার কমলে ধানের জমিতে বন্ধু পোকার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। পরিবেশ বান্ধব সবুজ এ প্রযুক্তিটির উদ্ভাবক কীটতত্ত্ববিদ মনিরুজ্জামান কবির বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে বীজতলায় বরিশালের ৯৫ একর গবেষণা ফার্মে এ হাতজাল ব্যবহার করে আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেছে। আয়তাকার এ হাতজাল কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। উদ্ভাবিত এ প্রযুক্তিটি নিয়ে ব্রি, বরিশালের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আলমগীর হোসেন বলেন, চলতি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলের প্রায় সাড়ে চার হাজার বিঘা প্রদর্শনী প্লটের কৃষকদের মাঝে বিনামূলে উদ্ভাবিত হাতজাল বিতরণ করা হয়েছে। যা ব্যবহার করে ইতোমধ্যে কৃষকরা ব্যাপক লাভবান হয়েছেন। ওইসব কৃষকদের হাতজাল ব্যবহার দেখে অপর চাষীদের মধ্যেও আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এনিয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হলে ভবিষ্যতে প্রতি মৌসুমে সারাদেশের বীজতলা কীটনাশক মুক্ত করা সম্ভব হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আয়তাকার হাতজাল নিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোঃ শাহজাহান কবীর বলেন, অনেক সময় গোলাকার হাতজালের মধ্যে বন্ধু পোকাও ঢুকে যাচ্ছে। তাই কৃষকদের বন্ধু ও শত্রু পোকা চেনাতে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও ব্যাপক প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সাধারণত বীজতলায় ৪০দিন পর্যন্ত কীটনাশক ব্যবহার করা না হলে বন্ধু পোকার আক্রমনে শত্রুপোকা আর আক্রমন করতে পারেনা। তাই ওই ৪০দিন হাতজাল ব্যবহার করা হলে বীজতলা সুরক্ষিত থাকবে। তাই তিনি (শাহজাহান কবীর) কৃষকদের হাতজাল ব্যবহারের জন্য আহবান করেছেন।