আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে। তারা সালাত কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। এ ধরনের লোকেরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বিরাট মর্যাদা, ভুলত্রুটির ক্ষমা ও উত্তম রিজিক।’ (সূরা আনফাল : ২-৪)
সাচ্চা ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় আত্মা কেঁপে ওঠে।
জিকর মানে স্মরণ করা। জিকরের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক ও পরিসর অনেক ব্যাপৃত। মনে, মুখে, অন্তরে, কর্মে, চিন্তায়, আদেশ পালনে, নিষেধে বিরত থাকায়, আল্লাহর নাম, গুণাবলি, বিধিবিধান, তাঁর পুরস্কার, শাস্তি ইত্যাদি স্মরণ করার নাম আল্লাহর জিকর। কুরআন হাদিসের আলোকে আল্লাহর স্মরণই হলো ইসলাম। মুমিনের সব কর্মই আল্লাহর স্মরণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর নির্দেশিত কিছু জিনিস গ্রহণ করবে এবং আল্লাহর ভয়ে কিছু জিনিস পরিহার করবে। সুতরাং তার সব কর্মই জিকর। ঈমান, কুরআন, সালাত, সিয়াম, হজ ইত্যাদি সব ইবাদাতকেই জিক্র বলা হয়। আবার এগুলোর অতিরিক্ত তাকবির, তাহলিল, তাসবিহ, দোয়া ইত্যাদিকেও জিকর নামে অভিহিত করা হয়।
কুরআন হাদিসে জিকরের অনেক উপকারিতা বর্ণনা হয়েছে। প্রথম প্রধান ফজিলত হলো, জিকরের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। হাদিসে অনেক ফজিলতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি লোকমানকে সূক্ষ্মজ্ঞান দান করেছিলাম যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে সে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজের জন্য লাভজনক। আর যে ব্যক্তি কুফরি করবে, সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত। (সূরা লোকমান : ১২)
আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিঃসঙ্গ একাকী মানুষেরা এগিয়ে গেল।’ সাহাবীরা প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! একাকী মানুষেরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর বেশি বেশি জিকরকারীরা।’ (মুসলিম : কিতাবুজ জিকর বাব হাস্সি আলা জিকরিল্লাহ)
মুআজ ইবনে জাবাল রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে আমার সর্বশেষ যে কথাটি হয়েছিল, যে কথাটি বলে আমি তাঁর থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলাম তা হলো, আমি প্রশ্ন করেছিলাম : হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কর্ম এই যে, তুমি যখন মৃত্যুবরণ করবে তখনো তোমার জিহবা আল্লাহর জিকরে আর্দ্র থাকবে।’ (বুখারি : খালকু আফআলিল ইবাদ, আলবানী-সহিহুল জামিউস সাগীর)
আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, সাত প্রকারের মানুষকে আল্লাহ কিয়ামতের দিনে তার আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী, ‘যে ব্যক্তি একাকী আল্লাহর জিকর করেছেন আর তার চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমেছে।’ (বুখারি : কিতাবুল আজান, বাব : মান জালাসা ফিল মাসজিদ)
জিকর প্রসঙ্গে এরকম আরো অসংখ্য হাদিস রয়েছে। জিকরের বাক্যের অর্থ পরিপূর্ণরূপে মনের মধ্যে উপস্থিত থাকে তাহলে তা পূর্ণতা পায়। সর্বোপরি পরিপূর্ণ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও অন্তরের পরিপূর্ণ তাওয়াজ্জুহ যদি আল্লাহর প্রতি হয় তাহলে তা হবে সর্বোত্তম কামালিয়াত ও সর্বোচ্চ পূর্ণতা এবং প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের আত্মিকশক্তি বৃদ্ধি পাবে। যে কোনো বিপদে-আপদেও যে কোনো দুঃখ-কষ্টে আমরা ধৈর্যধারণ করতে পারব।
সাচ্চা ঈমানদারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, আল্লাহর আয়াত পড়া হলে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে। যখনই তার সামনে আল্লাহর কোনো হুকুম আসে এবং সে তার সত্যতা মেনে নিয়ে আনুগত্যের শির নত করে দেয় তখনই তার ঈমান বেড়ে যায়। এ ধরনের প্রত্যেকটি অবস্থায় এমনটিই হয়ে থাকে। যখনই আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হিদায়াতের মধ্যে সে এমন কোনো জিনিস দেখে যা যা তার ইচ্ছা আশা-আকাক্সক্ষা, চিন্তা-ভাবনা মতবাদ, পরিচিত আচার-আচরণ, স্বার্থ, আরাম-আয়েশ, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব বিরোধী হয় এবং সে তা মেনে নিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান পরিবর্তন করার পরিবর্তে নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলে এবং তা গ্রহণ করতে গিয়ে কষ্ট স্বীকার করে নেয় তখন মানুষের ঈমান তরতাজা ও পরিপুষ্ট হয়। পক্ষান্তরে এমনটি করতে অস্বীকৃতি জানালে তার ঈমানের প্রাণশক্তি নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকে।
মানুষের জ্ঞানের পরিধি যত বিস্তৃতি লাভ করে, আল্লাহভীতি তত বেশি বৃদ্ধি পায়। আর সেই জ্ঞান হলো, তাওহিদ, আল্লাহর ক্ষমতা, আল্লাহর গুণাবলি, রেসালাত ও আখিরাতের জ্ঞান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞানসম্পন্নরাই তাকে বেশি ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ পরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল।’ (সূরা ফাতির : ২৮) অর্থাৎ আল্লাহর শক্তিমত্তা, জ্ঞান প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানময়তা, ক্রোধ, পরাক্রম সার্বভৌম কর্তৃত্ব ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবলি সম্পর্কে যে ব্যক্তি যত বেশি জানবে সে তত বেশি তার নাফরমানি করতে ভয় পাবে। আর অজ্ঞরা আল্লাহকে ভয় পাবে না। আসলে এ আয়াতে জ্ঞান অর্থ দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অঙ্ক ইত্যাদি স্কুল কলেজে পঠিত বিষয়ের জ্ঞান নয়। বরং এখানে জ্ঞান বলতে আল্লাহর গুণাবলির জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। এ জন্য শিক্ষিত ও অশিক্ষিত হওয়ার প্রশ্ন নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না সে যুগের শ্রেষ্ঠ প-িত হলেও এ জ্ঞানের দৃষ্টিতে সে নিছক একজন মূর্খ ছাড়া আর কিছু নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণাবলি জানে এবং নিজের অন্তরে তার ভীতি পোষণ করে সে অশিক্ষিত হলেও জ্ঞানী। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: এ কথাই বলেছেন, ‘বিপুলসংখ্যক হাদিস জানা জ্ঞানের পরিচায়ক নয় বরং বেশি পরিমাণ আল্লাহভীতি জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।’ হাসান বসরীও একথাই বলেছেন, ‘আল্লাহকে না দেখে যে ভয় করে সেই হচ্ছে আলেম।
আল্লাহ যা কিছু পছন্দ করেন সেদিকেই আকৃষ্ট হয় এবং যে বিষয়ে আল্লাহ নারাজ সে ব্যাপারে সে কোনো আগ্রহ পোষণ করে না।’
সাচ্চা ঈমানদারের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো, তারা সালাত কায়েম করে। আল্লাহর দেয়া ইবাদতগুলোর মধ্যে সালাত শ্রেষ্ঠ ইবাদত। কারণ মানুষ সালাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সামনে আপাদমস্তক অবনত করে দেয় এবং তাঁরই শাহি দরবারে গোটা অবয়বই লুটিয়ে দেয়। সৃষ্টির সার্থকতা এখানেই পরিস্ফুট হয় বিধায় মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত হয়েছে। অপর দিকে যেহেতু একমাত্র সালাতের মাধ্যমেই এর প্রতিফলন ঘটে অর্থাৎ একমাত্র সালাতের মাধ্যমেই মানুষ তার মর্যাদার এই প্রতীকগুলোকে আল্লাহর সামনে বিনা দ্বিধায় নত করে দেয়, সেজন্য অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় সালাত শ্রেষ্ঠ ইবাদতে পরিণত হয়েছে। আল-কুরআনের কোনো কোনো স্থানে শুধুমাত্র রুকু ও সাজদাকেই সালাত বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘তুমি সিজদা করো এবং (তোমার রবের) নৈকট্য অর্জন করো।’ (সূরা আলাক : ১৯) ‘তোমরা রুকু করো এবং সিজদা করো।’ (সূরা হাজ : ৭৭) দু’টি আয়াতেই রুকু ও সিজদা করা মানে সালাত পড়া।
কুরআন ও হাদিসে সালাতের কথা এত বেশি উদ্ধৃত হয়েছে যা অন্য কোনো ইবাদতের বেলায় দেখা যায় না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সালাত মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং সালাত কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই হিসেবে গণ্য হবে।’ (সূরা তাওবা : ১১)। এই সালাতের কথা বলেই মানবতার মহান বন্ধু রাসূল সা: শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সুতরাং নামাজের সব আহকাম বিশেষত রুকু ও সিজদার সময় যদি আমরা মনে রাখতে পারি যে, আমরা কার সামনে মর্যাদার এই প্রতীকগুলো লুটিয়ে দিচ্ছি। তাহলে আমাদের সালাতের সার্থকতা সর্বকাজে প্রতিফলিত হবে। সালাতের প্রতিটি দোয়ার অর্থ বুঝে মনের আবেগ মিশিয়ে পড়তে পারি তাহলে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জীবন কল্যাণে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।