দেশের সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্ধকোটি লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান এ শিল্পে। সস্তায় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের উৎস। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এই শিল্পের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে পোল্ট্রির বর্জ্য সমস্যা নয়, বরং সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা দুই লাখ পাঁচ হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে নিবন্ধিত পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ৮৫ হাজার ২২৭টি ও অনিবন্ধিত খামারের সংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার চারটি। সামনের দিনগুলোতে যত্রতত্র পোল্ট্রি বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলার সুযোগ একেবারে কমে যাবে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে দেশের বড় পোল্ট্রি জায়ান্ট কোম্পানিগুলো ভাবছে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে। পোল্ট্রি বর্জ্যকে তারা এখন আর সমস্যা ভাবছে না, দেখছে সম্ভাবনা হিসেবে ২০১৯-২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ১৬টি পোল্ট্রি গ্র্যান্ড প্যারেন্ট ফার্ম, ২০৬টি লেয়ার ও ব্রয়লার ব্রিডার ফার্ম ও ৮ হাজার ৮০০টি লেয়ার এবং ব্রয়লার খামার রয়েছে। কার্যক্রম পরিচালনা করছে ২১৭টি ফিড মিল, ১৫টি মিট প্রসেসিং প্ল্যান্ট, ২ হাজার ১৫টি সোনালি মুরগির ব্রিডার খামার এবং ৫৩৪টি প্রাণিস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোম্পানি। বর্তমানে দেশে মোট জিডিপির ১ থেকে ৩০ শতাংশ আসছে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। তাই পোশাকশিল্পের পরই সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে পোল্ট্রি শিল্প এরই মধ্যে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. নাথু রাম সরকার পোল্ট্রির বর্জ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। তার মতে, একটা সময় ছিল যখন পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ শুরু হয়নি। তখন হয়তো এতসব ভাবারও সময় ছিল না। সে সময় জায়গাও ছিল। তবে সরকারি নীতিকাঠামো ছিল অনেকটা দুর্বল। এখন দিন যত যাচ্ছে, জমি কমছে, কঠিন হচ্ছে সরকারি নীতিকাঠামো। সামনের দিনগুলোতে যত্রতত্র পোল্ট্রি বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলার সুযোগ একেবারে কমে যাবে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে দেশের বড় পোল্ট্রি জায়ান্ট কোম্পানিগুলো ভাবছে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে। পোল্ট্রি বর্জ্যকে তারা এখন আর সমস্যা ভাবছে না, দেখছে সম্ভাবনা হিসেবে। বিশ্বের বড় বড় দেশের কৃষিজমির পরিমাণ অনেক বেশি। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কম্পোস্ট সার হিসেবে ব্যবহার করা হয় পোল্ট্রি লিটার (বিষ্ঠা)। খুবই সহজ পদ্ধতিতে সাধারণ কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোল্ট্রি লিটার রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন করে সেগুলো প্যাকেটজাত অবস্থায় বাজারজাত করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পোল্ট্রি লিটার থেকে জৈব সার উৎপাদনই শুধু নয়, লিটার দিয়ে তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাস ও বিদ্যুৎ। বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে আশির দশক থেকে বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালন শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিনিয়োগকারীদের উদ্যোগে পোল্ট্রি শিল্প গতি পায় এবং সস্তায় উন্নত আমিষের উৎস হিসেবে এ খাত জনপ্রিয়তা লাভ করে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পোল্ট্রি একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের রূপ ধারণ করে এবং বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়তে থাকে।
যারা বড় খামারি তারা একটি কমপ্লিট ম্যাকানিজম করে তাদের বর্জ্যগুলো রিসাইকেল করে যে বিদ্যুৎ হয় সেটি নিজেরাই ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া ফার্টিলাইজার হিসেবেও কিন্তু ব্যবহার করা যাবে পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে সারাদেশে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অনেক খামার, ফিড মিল ও ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে এ শিল্পে। গত কয়েক বছরে রেড মিটের দাম বেড়ে যাওয়ায় সস্তায় প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে পোল্ট্রি শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
পোল্ট্রি শিল্পের বর্জ্য: পোল্ট্রি শিল্পের পোল্ট্রি বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে বিষ্ঠা, খাদ্যের উচ্ছিষ্টাংশ, পালক, হ্যাচারির বর্জ্য ও মৃত মুরগি। বর্তমানে দেশে বছরে ৪ দশমিক ৫২ মিলিয়ন টন পোল্ট্রি বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন টন উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিক খামার থেকে। এসব খামার দেশের মধ্য, উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় কিছু অঞ্চলে অবস্থিত। প্রচলিত ব্যবস্থায় পোল্ট্রির বিষ্ঠা খামারের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়। পরবর্তীসময়ে ফারমেন্টেশন হয়ে বিভিন্ন গ্যাস উৎপন্ন ও দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করে। এতে বাতাস, পানি ও মাটিদূষণ হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খামারিদের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০ শতাংশ খামারি পোল্ট্রির লিটার ব্যবহার করেন না, ৪০ শতাংশ খামারি বিক্রি করেন, ৩০ শতাংশ শস্যক্ষেতে এবং ১০ শতাংশ মাছ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একটি ব্রয়লার মুরগি এক কেজি খাবার খেলে এক কেজি ফ্রেশ লিটার পাওয়া যায়। অন্যদিকে একটি লেয়ার মুরগি থেকে বছরে ২০ কেজি বিষ্ঠা পাওয়া যায়। বর্তমানে দৈনিক প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস ও দুই কোটি ৮০ লাখ ডিম উৎপাদিত হয়। ফলে দেশে প্রতিদিন অনেক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এ সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে সার, জ্বালানি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসা সম্ভব ড. নাথু রাম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, বর্জ্য যে একটি সম্পদ আমাদের দেশের খামারিদের মধ্যে অনেকের সে বিষয়ে ধারণাই নেই। আমাদের ছোট ছোট খামারির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে হয়তো সেটি থাকবে না। যারা বড় খামারি তারা একটি কমপ্লিট ম্যাকানিজম করে তাদের বর্জ্যগুলো রিসাইকেল করে যে বিদ্যুৎ হয় সেটি নিজেরাই ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়া ফার্টিলাইজার হিসেবেও কিন্তু ব্যবহার করা যাবে।
‘একটি খামার করে যে পরিমাণ আয় হয়, সে অনুযায়ী বর্জ্য থেকেও তার ২৫ শতাংশ আয় করা সম্ভব। পোল্ট্রির বর্জ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলেও আমরা সেটির যথাযথ ব্যবহার করতে পারি না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না করলে কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, একই সঙ্গে রিসোর্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বর্জ্য থেকে তৈরি সার জমিতে ব্যবহার করলে আমাদের দেশের ইউরিয়াসহ অন্যান্য সারের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারবো। একই সঙ্গে মাটির যে গুণাগুণ থাকে সেটি কমে যাচ্ছে, কিন্তু সার ব্যবহারের ফলে সেটি থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। তাই পোল্ট্রির বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা খুব জরুরি।’ তিনি বলেন, যেসব ছোট খামারির সক্ষমতা নেই তারা অন্তত এটিকে কম্পোস্ট করতে পারেন। পোল্ট্রির বর্জ্যকে অন্যান্য আবর্জনার সঙ্গে মিশিয়ে একটি কম্পোস্ট করা যায়। কিন্তু সেটিও অনেকে করছেন না। তারা অন্যের জমিতে রাখছেন, সেখান থেকে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ বিষয়টিতে তাদের সচেতন করতে হবে।
পোল্ট্রির বর্জ্য ব্যবহার:যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে পোল্ট্রি ও টার্কির লিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। আয়ারল্যান্ডে বায়োগ্যাস এনার্জির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পোল্ট্রি লিটার। ব্রয়লার হাউজের তাপ বা উষ্ণতা বাড়াতে আগে যেখানে ফসিল ফুয়েল বা এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করা হতো, এখন সেখানে পোল্ট্রি লিটার ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যাডভান্স ফাইবারস অ্যান্ড পাউডারসের মতো বড় বড় কোম্পানি তাদের ইলেকট্রিক্যাল ও হিটিং অ্যাপ্লিকেশনে জ্বালানি হিসেবে পোল্ট্রি লিটার ব্যবহার করছে। পাশাপাশি তারা তৈরি করছে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ও সার। পোল্ট্রি শিল্পের কোনো কিছুই এখন ফেলে দেওয়া হয় না। চিকেন ফেদার মিল থেকে প্রোটিন মিল ও সার তৈরি ছাড়াও নতুন ধরনের বায়োডিজেল ফুয়েল উৎপাদন করা হচ্ছে। গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, খামারে প্রতি বছর এক হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হলে সেখান থেকে ৩৮ থেকে ৭০ কিলোওয়াট, ১০ হাজার টন বর্জ্য থেকে ৩৪০ থেকে ৭০০ কিলোওয়াট ও ৫০ হাজার টন বর্জ্য থেকে ১ দশমিক ৭০ থেকে ৩ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বাংলাদেশের প্যারাগন পোল্ট্রি, কাজী ফার্মস প্রভৃতি দেশি কোম্পানি নিজস্ব খামারে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে অভিনব এ পদ্ধতি কাজে লাগাচ্ছে। এক হিসাব মতে, ১০ হাজার মুরগির একটি খামার থেকে প্রতিদিন এক টনের বেশি বর্জ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিইসিসি) হিসাব মতে দেশে বর্তমানে দৈনিক প্রায় চার হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস ও দুই কোটি ৮০ লাখ ডিম উৎপাদিত হয়। ফলে দেশে প্রতিদিন অনেক বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এ সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে সার, জ্বালানি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসা সম্ভব। কাজী ফার্মসের হেড অব সেলস কৃষিবিদ আবু তাহের জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৬ সালে লাইসেন্স পেয়ে আমরা পুরোপুরি জৈব সার তৈরিতে চলে গেছি। আমাদের মুরগির বিষ্ঠার সঙ্গে কাঠের গুঁড়া, ভুট্টার গুঁড়া, ১৫টি অণুজীব যেগুলো পচনশীল সেগুলো ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা জৈব সার হিসেবে বিক্রি করছি। পুরো প্রক্রিয়াটি আমরা করছি অটোমেটিক মেশিনে। ফলে আমাদের কোনো সানলাইটের সংস্পর্শে যেতে হচ্ছে না। এতে মিথেন গ্যাসও উৎপাদন হয় প্রচুর পরিমাণে। মিথেন গ্যাস যদি কেউ সানলাইট দিয়ে শুকায় সে কিন্তু গ্রিন হাউজ গ্যাস তৈরি করতে পারে। যেটি পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অস্বাভাবিক বন্যা, ঝড়-বৃষ্টির জন্য গ্রিন হাউজ গ্যাসটি দায়ী, সেজন্য আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারনালভাবে প্ল্যান্টের মাধ্যমেই তৈরি করছি, যা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করছে না।
তিনি বলেন, জৈব সার তৈরির ফলে লাভ-লোকসানের হিসাবে আমরা আগে যাইনি। পোল্ট্রির বর্জ্য যথাযথভাবে অপসারণ করা আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল। শুরুর দিকে কাঁচা যে লিটার হতো সেটি লোকালয়ে কিছু টাকা দিয়ে হলেও বলতাম নিয়ে যেতে। তারা যখন নিতো তখনও কিন্তু দুর্গন্ধ ছড়াতো। এটা আমাদের খুবই সমস্যার কারণ ছিল। এখন আমরা দুর্গন্ধহীনভাবেই তৈরি করতে পারছি। আমাদের ইনভেস্টমেন্ট অনেক হাই। দিনশেষে আমাদের লাভ হবে। এখন যেহেতু ইনভেস্টমেন্ট হাই তাই লাভ দেখাতে পারছি না।-জাগোনিউজ২৪.কম