আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন ওহির জ্ঞান দিয়ে। সেই ওহির জ্ঞান মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। নবুয়াতি এই ধারা হজরত আদম আ: থেকে শুরু হয়ে সমাপ্ত হয়েছে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মাধ্যমে। তবে নবীজী সা: রেখে গেছেন একদল হেদায়েতপ্রাপ্ত সোনালি মানুষ। যাদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন ‘তারা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট’। তারা হলেন সাহাবায়ে কেরাম। তারা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছ থেকে কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান লাভ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম থেকে ইলমে ওহির উত্তরাধিকারী হয়েছেন তাবেঈন। তাবেঈন থেকে তাবে তাবেঈন। আর তাবে তাবেঈন থেকে উলামায়ে কেরাম। উলামায়ে কেরামের ত্যাগের বিনিময়ে দ্বীন ইসলাম আমরা পেয়েছি। এক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের অবদান অনস্বীকার্য। ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই ওহির জ্ঞান মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ, মাহফিল ও দাওয়াতে তাবলিগের মাধ্যমে অর্জন করে আসছেন। হাদিসের ভাষায় উলামায়ে কেরাম আম্বিয়ায়ে কেরামের উত্তরসূরি এবং জাতির পথপ্রদর্শক। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নেই, যে বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেœহ করে না এবং আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় না’। (মুসনাদে আহমাদ-২২১৪৩)
ইসলামের আদিলগ্ন থেকে বিরোধীরা এর বিরোধিতা করে আসছে। মুসা আ:-এর বিরোধিতা করেছে ফেরাউন বাহিনী। ইবরাহিম আ:-এর বিরোধিতা করেছে নমরুদ বাহিনী। প্রিয় নবীজী সা:-এর বিরোধিতা করেছে আবু জেহেল, আবু লাহাব ও মুসলিম নামধারী মুনাফেক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল বাহিনী। সেই অপশক্তির উত্তরসূরিরা এখনো সক্রিয়। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। ইসলামী শক্তির এই উত্থান ও গণজোয়ার দেখে ইসলামবিদ্বেষী অপশক্তির হৃদকম্পন শুরু হয়ে গেছে। এ জন্য তারা আজ কুফরিবাদের নীলনকশা অনুযায়ী ইসলামকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করতে আদাজল খেয়ে লেগেছে। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তার আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ (৮ : ৬১)
ইসলামবিদ্বেষী অপশক্তি বুঝতে সক্ষম হয়েছে তাওহিদি জনতা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের এদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে তারা সমাজে ও রাষ্ট্রে টিকতে পারবে না। এ জন্য তারা আবু জেহেল ও আবু লাহাবের অবস্থান থেকে সরে এসে মুনাফিক আবদুুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পথ বেছে নিয়েছে। শুধু ইসলামের বাণী প্রচার করার অপরাধে নিরীহ নিরপরাধ উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে বছরের পর বছর মুফাসসির, মাসের পর মাস শায়খুল হাদিস, দিনের পর দিন ওয়ায়েজিনদের কারাগারে অন্তরীণ করে রেখেছে। একদিকে মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের কথা বলছে, অন্যদিকে মিথ্যা অজুহাত তুলে ওয়াজ মাহফিল বন্ধের পাঁয়তারা করছে। ভারতের কর্নাটকে হিজাব নিষিদ্ধের পাঁয়তারা আর বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিল নিষিদ্ধের পাঁয়তারা হতে পারে একসূত্রে গাঁথা! এতেই প্রমাণিত, ইসলামের বিরুদ্ধে কুফরিশক্তি ঐক্যবদ্ধ।
বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি তাওহিদি জনতার দেশে ইসলামবিরোধী অপশক্তি মুসলিম জনতার হৃদয়ের স্পন্দন পীর মাশায়েখ ও ওয়ায়েজিনে কেরামের বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র এই শ্বেতপত্র। ইসলাম বাস্তবসম্মত পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহ তায়ালা দ্বীনে কোনো প্রকার অচলাবস্থা রাখেননি। স্বেচ্ছায় হাদিয়া দেয়া এবং হাদিয়া নেয়া দু’টিই রাসূল সা:-এর সুন্নাহ। অতএব, হাদিয়া নিয়ে আপত্তি তোলা বিদ্বেষপ্রসূত ও অজ্ঞতা!
স্বঘোষিত গণকমিশনের দুই আইনজ্ঞের বিরুদ্ধে রয়েছে অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকা-ের প্রচুর অভিযোগ। একজনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় স্বীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সন্তানের বিরুদ্ধে গর্ভধারিণী মায়ের সংবাদ সম্মেলন এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার দাবি ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। অন্যজনের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করে বিচারপতি হওয়া, পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং কালো টাকায় ইংল্যান্ডে বাড়ি করার অভিযোগ। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেইসব অভিযুক্তরাই আজ সাধু সেজে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে আঙুল তুলছে। তারা উলামায়ে কেরামকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান থেকে বিচ্ছিন্ন করার এবং জাতির সামনে হেয়প্রতিপন্ন করার নতুন এক ষড়যন্ত্রে মেতেছে! তাদের ভাষায় উলামায়ে কেরাম নাকি ধর্মের অপব্যাখ্যা করছে? ধর্মের অপব্যাখ্যা করছে নাকি সঠিক ব্যাখা করছে তা মূল্যায়ন করবে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা নাকি ধর্মাজ্ঞরা? ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীরা নাকি ইসলাম বিদ্বেষীরা? কাদের ইন্ধন ও অর্থায়নে এই কমিশন কাজ করছে তা জাতির কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত। তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেশকে অশান্ত করে দেশের শান্তিময় পরিবেশ ও সম্প্রীতির বন্ধন বিনষ্ট করতে চায় কি না সে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিদ্বেষপ্রসূত শ্বেতপত্রের কারণে তথাকথিত গণকমিশন আজ গণধিকৃত ও গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে। উলামায়ে কেরামের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অন্তরে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। মসজিদ, মাদরাসা ও ওয়াজ মাহফিলে এখন স্থান সঙ্কুুলান হয় না।
উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কাল্পনিক শ্বেতপত্র ও আষাঢ়ে গল্প সেই নীল নকশারই বহিঃপ্রকাশ। ১১৬ ইসলামী বক্তার মধ্যে ৩০ নম্বরে যার নাম এসেছে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। তিনি ভিনদেশী। সৌদি আরবে দাওয়াতি কাজ করেন। এ থেকেই প্রতীয়মান, ব্যক্তি নয় বরং ইসলামই এই অপশক্তির টার্গেট।
ইসলামকে যারা সহ্য করতে পারে না, ধর্মের নাম শুনলেই যাদের গায়ে জ্বালা ধরে, সেসব ধর্মবিদ্বেষী অপশক্তি ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে এটি স্বাভাবিক। তবে আমরা তাওহিদি জনতা, ধর্মপ্রাণ মুসলমান, উলামায়ে কেরাম, ওয়ায়েজিনে কেরাম ও পীর মাশায়েখরা সেসব ধর্মবিদ্বেষীকে কোনোভাবেই আমাদের ঈমান ডাকাতির সুযোগ দিতে পারি না। জাতিকে নাস্তিক বানানোর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সহযোগী হতে পারি না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা ইসলামবিরোধীদের সাথে লড়াই করো, যে পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (১৯৩ : ২)
আমিন আস্তে না জোরে, হাত ওপরে না নিচে, রফয়ে এদাইয়ন একবার না বার বার। দোয়াতে হাত তোলা না তোলা, সালাতু সালাম বসে না দাঁড়িয়ে, ঈদ দু’টি না তিনটি- এগুলো ইসলাম ধর্মের বেসিক কোনো বিষয় নয়। ইখতেলাফ সালাফের মধ্যেও ছিল তবে সীমাবদ্ধ। এসব মুস্তাহাব্বাত, ফরোআত ও জুজিয়াত এবং হাদিসের ভাষায় ‘মালা’ঈয়ানি’ এড়িয়ে সব তাওহিদি জনতা, ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও সব উলামায়ে কেরাম পরস্পর দলাদলি, মতবিরোধ ও ভেদাভেদ ভুলে দ্বীনের বৃহত্তর স্বার্থে আল্লাহর ওয়াস্তে সাদা দিলে উদার মনে এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে গেলে ইসলামবিরোধী অপশক্তি অতীতের মতো লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হবে। ‘মুসকান’ যদি ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে গেরুয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে একাই লড়তে পারে, সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না?
ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। আসুন যার যার অবস্থান থেকে আমাদের ভালোবাসা ও সম্মানের পাত্র আলেম সমাজকে অসম্মান ও হেয়প্রতিপন্ন করার প্রতিবাদ করি। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ্ আহমদ শফি রহিমাহুল্লাহ ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহিমাহুল্লাহর পরীক্ষিত ও প্রদর্শিত পন্থায় ইসলামবিরোধীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না, যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে।’ (১৩৯ : ৩) লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম