প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রতিযোগিতায় রয়েছে চীন-অস্ট্রেলিয়া। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দীর্ঘ সফরে রয়েছেন যার উদ্দেশ্য এই অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে সেখানে চীনের প্রভাব বিস্তার করা। টানা দশ দিন ধরে চীনের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একই অঞ্চলের এতোগুলো দেশ সফরে যাওয়াকে নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে তার এই সফরের সময় ওই অঞ্চলের আটটি দেশের সাথে চীন বাণিজ্য, কৌশলগত ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনের এই পরিকল্পনায় নড়েচড়ে বসেছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর পাশাপাশি চীনের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে। এর আগে সলোমন আইল্যান্ডসের সাথে চীনের একটি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে এই তিনটি দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাদের আশঙ্কা এই চুক্তি অনুসারে চীন হয়তো সেদেশে সামরিক ঘাঁটি বিশেষ করে নৌ-ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। যদিও দু’দেশ এরকম কোনো উদ্দেশ্যের কথা অস্বীকার করেছে। সলোমন আইল্যান্ডসের জন্য সবচেয়ে বড় দাতা দেশ অস্ট্রেলিয়া। এর আগে দেশটিতে যখন সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তখন দাঙ্গা দমনে অস্ট্রেলিয়া এই দ্বীপরাষ্ট্রে তাদের সেনা পাঠিয়েছিল।
টার্গেট যেসব দেশ: চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যেসব দেশ সফর করছেন তার মধ্যে রয়েছে সলোমন আইল্যান্ডস, ফিজি, কিরিবাস, সামোয়া, টোঙ্গা, ভানুয়াতু, পাপুয়া নিউ গিনি ও টিমোর লেস্ট।
বিশ্লেষকরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো ঘিরে চীনের এই পরিকল্পনাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করছেন। যার মধ্যে রয়েছে সাইবার নিরাপত্তা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। বেইজিংয়ের এই পরিকল্পনা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, এসব চুক্তিতে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে চীনের অর্থ সহায়তায় পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য একাডেমি গড়ে তোলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে। এসবের পেছনে উদ্দেশ্য একটাই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোকে চীনের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসা। অর্থাৎ উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থা বৃদ্ধি করা। তবে ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ চীনের সাথে এ ধরনের চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর বেইজিংয়ের এই উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। সমঝোতার কিছু কিছু বিষয় নিয়ে এসব দেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
চীনের কেন আগ্রহ: প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর দিকে চীনের নজর দীর্ঘদিনের। গত কয়েক বছর ধরেই বেইজিং এসব দেশের সাথে তাদের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লোয়ি ইন্সটিটিউটের এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীন ওই অঞ্চলে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার দিয়েছে বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে, যা অনুদান ও ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে চীনের নানা ধরনের আগ্রহ কাজ করেছে।
চীনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কের এতো অবনতি হওয়ার কারণ কী: লোয়ি ইন্সটিটিউটের একজন গবেষক মিহাই সোরা বলেছেন, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে যে, সংঘাতের সময় রসদ সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে পারার অর্থ হচ্ছে- আপনার সাথে রয়েছে পুরো একটি অঞ্চল। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক কোনো জায়গায় ভোটাভুটির মাধ্যমে যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন হয়তো তারা আপনার প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হতে পারে।
মিহাই সোরা আরো বলেন, ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের এই আকাঙ্ক্ষার পেছনে একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যও রয়েছে। যার মাধ্যমে তাইওয়ানের প্রতি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থন দুর্বল করাও চীনের একটি উদ্দেশ্য।’ উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, গত কয়েক বছরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় কয়েকটি দেশ কূটনৈতিকভাবে তাইওয়ানকে সমর্থন দেয়া থেকে সরে গিয়ে চীনের পক্ষে চলে গেছে। এরকম দুটি দেশের উদাহরণ কিরিবাস ও সলোমন আইল্যান্ডস।
সর্বশেষ কারণ সম্পদ : প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্পদের প্রধান ভোক্তা দেশ চীন এবং চীনের উন্নয়নের জন্য এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই চীন যাতে এসব সম্পদ আরো সহজে পেতে পারে সেটাকেও চীন অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে করেন এই গবেষক।
অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ: তবে চীনের ক্রমবর্ধমান এই আগ্রহ অস্ট্রেলিয়া সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে অস্ট্রেলিয়া তাদের ব্যাকইয়ার্ড বা ‘বাড়ির পেছনের উঠোন’ বলে বিবেচনা করে থাকে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা মোকাবেলা করার জন্য ক্যানবেরা সরকার ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে সাহায্য তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে।
এই দেশগুলোকে বলা হয় ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিবার’। এই পরিবারের সাথে পুনরায় যোগাযোগ ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ২০১৮ সালে ‘প্যাসিফিক স্টেপ-আপ’ নামে একটি নীতি গ্রহণের কথাও ঘোষণা করে। একই সাথে চীনের ঋণ ও বিনিয়োগ মোকাবেলার জন্য অস্ট্রেলিয়াও এ দেশগুলোকে অবকাঠামো খাতে কয়েক কোটি ডলারের অর্থ সাহায্য দিতে শুরু করে। তবে এ বছরের শুরুর দিকে চীনের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ সলোমন আইল্যান্ডসের একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে। ক্যানবেরা সরকার এই সমঝোতার তীব্র সমালোচনা করে। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূল থেকে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে সলোমন আইল্যান্ডস। এবং এ কারণে ক্যানবেরার পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যে, এই দ্বীপরাষ্ট্রটির সাথে চীনের নিরাপত্তা চুক্তির ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, এই চুক্তিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৮০ বছরের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করে তৎকালীন বিরোধীদল লেবার পার্টি, যে দলটি স¤প্রতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছে। গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি উং-ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ফিজি সফর করেন যখন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ওই অঞ্চল সফরে বের হন। এই দুই সফর ইঙ্গিত দেয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে।
চুক্তি নিয়ে আপত্তি: বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের পরিকল্পিত এই চুক্তির ফলে ওই অঞ্চলের ভারসাম্য বদলে যেতে পারে। তাদের অনেকে আশঙ্কা করছেন এরকম চুক্তি হলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়াও এই দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত প্রতিযোগিতার মাঝখানে পড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব রক্তাক্ত যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে তার কয়েকটি হয়েছে এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। সূত্র : বিবিসি