দেশের জ্বালানি পণ্যের বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। গত সপ্তাহেই এলপিজির দাম বাড়িয়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতি মাসেই পণ্যটির মূল্য নির্ধারণ করে থাকে বাংলাদেশে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এছাড়া সংস্থাটি গণশুনানির ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করলেও এক্ষেত্রে ভোক্তাদের চেয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর স্বার্থ বেশি গুরুত্ব পায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
আকস্মিকভাবেই গত মাসে ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন, পেট্রলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৪২ থেকে প্রায় ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় সরকার। সে সময় বলা হয়েছিল, দীর্ঘদিন মুনাফায় থাকা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসানের চাপ কমাতে পণ্যগুলোর দাম বাড়ানো হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাবপত্রের তথ্য অনুযায়ী, যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছে সংরক্ষিত আয় রয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত অর্থবছরেও মে মাস পর্যন্ত মুনাফায় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। জ্বালানি খাতের লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গত সাত বছরে বিপিসিকে কোনো ভর্তুকি দেয়নি সরকার। বিষয়টি নিয়ে নানা পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনার পর গত মাসের শেষ দিকে ডিজেল-কেরোসিনের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও এর আগে গত মাসের শুরুর দিকে তা বাড়ানো হয়েছিল লিটারে ৩৪ টাকা করে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে দেয়ার বিষয়টি প্রতিযোগিতামূলক বাজারভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না। এজন্য বাজারের স্তরগুলো একটু বুঝতে হবে। উন্নত দেশেও আমাদের মতো নানা কমিশন বড় করপোরেট হাউজগুলোর দাম নির্ধারণের বিষয়টি তদারকি করে থাকে। দাম অনুযায়ী প্রতিযোগিতা হচ্ছে না হলে তারা বড় ধরনের জরিমানা করে থাকে। কিন্তু তারা চাল-ডালের দাম নির্ধারণ করে দেয় না এটা ঠিক। আমাদের এখনো চাল-ডালসহ বিভিন্ন জিনিসের দামে হেরফের হচ্ছে। আর আমাদের আইনটাও পুরনো, ১৯৫৬ সালের। সে আইনের আলোকেই আমাদের কাজ করতে হয়। যেহেতু আমাদের বাজার এখনো স্থিতিশীল না এবং আমাদের সরবরাহ চেইনে বিভিন্ন রকমের ঝামেলা আছে, কে কত দাম নিচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই, বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নেই, তাই দাম বেঁধে দিতে হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমরা পণ্যের প্রাপ্যতা যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেটির চেষ্টা করি। যেমন বন্দরে ভিড় কমানো, পণ্যবাহী ট্রাকগুলো যেন ফেরিঘাটে বা রাস্তায় চলাচলে সুবিধা পায় আমরা সেভাবে চেষ্টা করি। আর আমরা মনিটরিং করি। নিতান্তই না পারলে আমরা মূল্য বেঁধে দিই। এক্ষেত্রে কিন্তু আমদানিনির্ভর পণ্যেরই মূল্য বেঁধে দেয়া হয়। কারণ সহজেই সেটির হিসাব বের করা যায়।
সম্প্রতি দেশের আর্থিক খাতের ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) আমানত ও ঋণের সুদহার বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ শতাংশ। ঋণের সুদহার বেঁধে দেয়া হয়েছে ১১ শতাংশ পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে এরই মধ্যে আপত্তি তুলেছে এনবিএফআইগুলো। এ সিদ্ধান্ত পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠিও দিয়েছে তারা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য হলো কয়েক বছর ধরেই তারল্য সংকটের কারণে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। হাতে গোনা শীর্ষ কয়েকটি বাদে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ দিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে। আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দিলে একদিকে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাত প্রতিযোগিতা কমে দুর্বল হয়ে পড়বে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য সংকট আরো ঘনীভূত হবে।
ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞদের আপত্তি ‘নয়-ছয়’ সুদহার নিয়ে। ২০২০ সাল থেকে কার্যকর এ সুদহার নীতি নিয়ে তাদের বক্তব্য হলো বর্তমান পরিস্থিতিতেও সুদহার না বাড়ায় বাজারে তারল্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এখন নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠলেও ঋণের সুদহার ৯ শতাংশেই আটকে থাকায় তা মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার ব্যাংকগুলোর নতুন পণ্য বা সেবা উদ্ভাবনের পথেও তা বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সুদহারের মতো ভোগ্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণও এখন হাতে তুলে নিয়েছে সরকার। গত মাসের শেষ দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল (সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল), পরিশোধিত চিনি, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, এমএস পণ্য (রড) ও সিমেন্টের মূল্যও নির্ধারণ করে দেয়া হবে। সেজন্য ট্যারিফ কমিশনকে ১৫ দিনের মধ্যে এ নয় পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার সময়ও বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর্থিক খাত থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য পর্যন্ত বাজারসংশ্লিষ্ট প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই এখন মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে সরকার। ভোক্তা বা বাজারসংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষ এ মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে ভোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বাজারের পরিবর্তে বাজারজাতকারী বা আমদানিকারক বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবিদাওয়ারই প্রতিফলন দেখা যায় বেশি। এতে করে একদিকে ভোক্তাস্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতামূলক চেহারা হারিয়ে বাজারও হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রণমূলক বা কর্তৃত্ববাদী।
এ ধরনের উদ্যোগের পেছনে জনকল্যাণের উদ্দেশ্য কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত গুটিকয়েক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই এর সুবিধাভোগী হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক ও উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এখানকার রাজনৈতিক বন্দোবস্তেরই প্রতিফলন ঘটে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ ধরনের পদক্ষেপ জনকল্যাণমূলক। কিন্তু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সেই জনকল্যাণটাকে নিশ্চিত না করে যদি গোষ্ঠীতান্ত্রিকতার দিকে নিয়ে যায়, তাহলে ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত হয় না। কভিডকালে নতুন দরিদ্র বাড়ল, স্বল্প আয়ের মানুষ আয়হীন হলো। সেই সময় ভোগব্যয় টিকিয়ে রাখার জন্য একটি নীতি নেয়া হলো। এটি ছিল একটি জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ। আবার একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমা শুরু হলেও আমাদের দেশের ভোক্তারা এ থেকে কোনো সুবিধা পেলেন না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থসিদ্ধির একটি প্রবণতা কাজ করেছে।
তিনি আরো বলেন, যখনই দামটা নির্ধারণ করে দেয়া হয়, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে ঠিক। কিন্তু এর মধ্যে যদি রাজনৈতিক যোগসাজশ এসে ঢোকে, তাহলে দেখা যাবে একধরনের প্রিডেটরি প্রাইসিং (পণ্যের দাম কমিয়ে প্রতিযোগীকে ব্যবসা থেকে ছিটকে ফেলার কৌশল) হয়। এক্ষেত্রে অলিগোপলিরাই (বাজারে প্রতিযোগিতা অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অলিগোপলি বলা হয়) এ প্রিডেটরি প্রাইসিংয়ের সুবিধাভোগী। এজন্য রাষ্ট্র যদি জনকল্যাণের জন্য ভালো নিয়ত থেকেই নিয়ন্ত্রণমূলক বা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হাতে নেয়, তাহলে এর সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম-শৃঙ্খলার বিষয়টিকেও নিশ্চিত করতে হয়। বাংলাদেশে বলা হলো ব্যক্তি খাত যদি বিনিয়োগ নিয়ে আসে, তাহলে প্রতিযোগিতা বেশি হবে। প্রতিযোগিতা বেশি হলে সুদের হারও কমে যাবে। এক্ষেত্রে বাজারই তা করবে। কিন্তু মুশকিল হলো ওই রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারণেই। বাংলাদেশে জিডিপির আকারের বিপরীতে ব্রডমানি খুব কম। এখন এ অবস্থায় যদি সুদহার দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেরও চিন্তা করা হয়, সেটিও অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো (ডব্লিউটিআই) প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন আর বাজারকে নিয়ন্ত্রণমূলক রাখার পক্ষপাতী নয়। এর পরিবর্তে বাজার প্রতিযোগিতামূলক রাখার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে সংস্থাটি। এ নিয়ে সংস্থাটির গাইডলাইনেও বলা আছে, বাজার প্রতিযোগিতামূলক হলে ভোক্তাদের পণ্য বাছাই ও ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয়েরও সুযোগ থাকে।
দাম বেঁধে দেয়াকে কোনোভাবেই অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ বলা যায় না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, দাম বেঁধে দিলে ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হন। ভোক্তারা এ নীতির কোনো সুফল পায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বলে দেশে ভোজ্যতেলের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখন ভোজ্যতেলের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও বাংলাদেশে সে হারে কমেনি। অন্যান্য পণ্যের পরিস্থিতিও একই। দাম বেঁধে দিয়ে দায়িত্ব শেষ মনে করলে হবে না, সে দামের বাস্তবায়নও ঘটাতে হবে। ব্যাংক খাতে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়ার সুফলও দেশের সাধারণ মানুষ পায়নি।
নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের ফলে পণ্যমূল্যে বাজারের প্রকৃত চিত্র উঠে না আসার বড় উদাহরণ হিসেবে এখন বারবার ভোজ্যতেলকে সামনে নিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দাম এখন কমছে। যদিও দেশের বাজারে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের মূল্যে তার কোনো প্রতিফলন নেই। দেশে ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণ করে ট্যারিফ কমিশন। মূলত বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাবের ভিত্তিতে এটি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু ভোজ্যতেল আমদানি, পরিশোধন ও মোড়কজাত নিয়ে কোম্পানিগুলোর দেয়া তথ্য বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এজন্য কোম্পানিগুলোর দেয়া তথ্য ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে নেয়া তথ্যের বিশ্লেষণে দাম পুনর্র্নিধারণের কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিগুলো যেভাবে উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ের তথ্য সরবরাহ করে থাকে, এর বাইরে যেতে পারে না ট্যারিফ কমিশন। এছাড়া অপরিশোধিত ভোজ্যতেল পরিশোধনকালে ভিন্ন দামের একাধিক গ্রেডের মূল্য নির্ধারণের বিবেচনায় আনা হয় না। আবার ভোজ্যতেল পরিশোধনের পর পাওয়া সর্বশেষ অবশিষ্ট বর্জ্যও সাবান তৈরির কারখানায় ভালো মূল্যে বিক্রি করে আমদানিকারকরা। এ বিষয়ও মূল্য নির্ধারণের সময়ে বিবেচনায় নেয়া হয় না। এতে কোম্পানিগুলো বড় মুনাফা করলেও ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ ভোক্তারা।
একসময়ে ভোজ্যতেলের বাজারে প্রতিযোগিতা ছিল অনেকগুলো কোম্পানির মধ্যে। ২০০৮-১০ সালের দিকে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক ভোজ্যতেল আমদানি, পরিশোধন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের লোকসানে পড়ে যায়। সে সময় দেশের ভোজ্যতেল বাজারে শীর্ষস্থানে উঠে আসা চট্টগ্রামভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ে যায়। কোনো কোনোটি ঋণখেলাপিও হয়ে যায়। পরে সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হলেও বাজার কুক্ষিগত হয়ে পড়ে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির হাতে। দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবাধ প্রতিযোগিতার বিষয়টি হয়ে পড়ে পুরোপুরি গুরুত্বহীন। বাজারসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম যেমনই হোক না কেন, দেশে তা নির্ধারণ হয় হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের ভিত্তিতে।
বিষয়টি নিয়ে আপত্তি রয়েছে ভোজ্যতেলের আমদানি ও বাজারজাতকারকদের মধ্যেও। এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক ভোজ্যতেল আমদানিকারক উদ্যোক্তা বলেন, ট্যারিফ কমিশনের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যসহ নয়টি পণ্যের দাম বেঁধে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা ব্যবসায়ী বা দেশের অর্থনীতির জন্য শুভকর নয়। সরকার কী চিন্তা থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। বিভিন্ন ব্যাংকে ডলারের রেট আলাদা। এখন একেক ব্যবসায়ী আলাদা রেটে ডলার কিনে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলছে। এতে আমদানিকারকদের পণ্য আমদানিতেও মূল্য ভিন্ন ভিন্ন হচ্ছে। এখন সরকার দাম বেঁধে দিলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ওঠানামা করে। এখন সরকারের ট্যারিফ কমিশন যদি একটি নির্দিষ্ট দাম বেঁধে দেয়, তাহলে ব্যবসায়ীদের জন্য এ সিদ্ধান্ত সুখকর হবে না। এক্ষেত্রে বিশ্ববাজারের দাম পর্যালোচনা করে সতর্কতার সঙ্গে মূল্য নির্ধারণ করাটাই বাঞ্ছনীয় হবে। দাম বেঁধে দেয়াকে চূড়ান্ত কোনো সমাধান হিসেবে দেখছেন না সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকলে পণ্যের দাম বাড়বেই। এখন দেখতে হবে সংকটটি কৃত্রিম কিনা। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে দাম বেঁধে দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়ে দেন। কিন্তু বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব পড়তে অনেক সময় লাগে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আমি দেখেছিলাম, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলে দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়তে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। এর চেয়ে বেশি সময় লাগলে বুঝতে হবে, বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিক নেই।
বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্য ও আর্থিক বাজারের মতো মুদ্রাবাজারেও কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রভাব দেখা যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ হলেও বাংলাদেশে ডলারের বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চাহিদা ও জোগানের ওপর ডলারের বিনিময় হারকে ছেড়ে না দিয়ে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখার চর্চা হচ্ছে বহুদিন ধরে। বৈদেশিক মুদ্রার চাপ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালে তখনই একসঙ্গে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হচ্ছে। এক ধাক্কায় বড় মাত্রায় অবমূল্যায়ন করতে গিয়ে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, অন্যদিকে কঠিন হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।
যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য, সুদের হার, রাজস্ব ও মুদ্রানীতিসহ পারিপার্শ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবেশী ও সমঅর্থনীতির দেশগুলোর বিনিময় হারকেও এক্ষেত্রে আমলে নেয়া হয়। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার ৭৭ থেকে ৭৯ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময়েও কৃত্রিম উপায়ে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
কৃত্রিম উপায়ে মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখে তা হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়া অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী ভারতেও মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। কিন্তু সেখানে তা করা হয়েছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ অবমূল্যায়ন করে দেশটির জনগণকে অসহনীয় চাপে ফেলে দেয়া হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে ডলারের দাম চেপে ধরে রাখা হয়। চাপ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালে হঠাৎ করে ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে বিনিময় হারের অভিঘাত জনগণের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ সামগ্রিক অর্থনীতি যে পরিমাণ চাপের মধ্যে আছে, তাতে চলতি বছরের মধ্যেই ডলারের বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়ানোর বড় আশঙ্কা রয়েছে।
দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, নিত্যপণ্যের বাজারে কিছুটা পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, আমি মনে করি, কিছু নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকা উচিত। মানে একেবারে ছেড়ে দিয়ে যেমনতেমন প্রতিযোগিতাও হতে দেয়া ঠিক না। সমস্যা হচ্ছে সরবরাহ ও চাহিদার ওপরই দাম নির্ভর করবে। এখন সরবরাহে কোনো সমস্যা হলে চাহিদা বাড়বে। আবার দেখা যায়, কিছু কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের জন্য যারা টেন্ডার পেয়ে থাকে তাদের পক্ষে বাংলাদেশের ১৭-১৮ কোটি মানুষের চাহিদা কোনো কোনো সময় পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তখনো দাম বাড়ে। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ পরিকল্পনা নিলে কিছু হবে না। সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
অনেকটা একই মত চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. মাহবুবুল আলমেরও। তিনি বলেন, কোনো মুনাফালোভী গোষ্ঠী যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেজন্য সরকার দাম বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে দাম নির্ধারণে যাতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত সরকারকে জানিয়েছি।