মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২৬ পূর্বাহ্ন

স্মরণ: আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

হারুন ইবনে শাহাদাত
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০
আামদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

বঙ্গাব্দ অনুসারে ১২ ভাদ্র আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৪৩ম মৃত্যু দিবস পালিত হয়েছে। ঈসায়ী বর্ষপঞ্জি অনুসায়ী কবি ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ ঢাকার পিজি (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়)-এ হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে ।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষা-ভাষি প্রত্যেক মানুষের কাছে পরিচিত এক নাম। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। মজার ব্যাপার হলো তাঁকে এই মর্যাদার আসনে বসিয়ে বাংলাদেশের আপামর জনগণ। রাষ্ট্রীয় কোন গেজেটে তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তারপরও তিনি আমাদের জাতীয় কবি। এ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলা (বর্তমান পশ্চিম বঙ্গ)-’র বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। বর্তমান সংশোধিত বাংলা ক্যালেন্ডারের সাথে মিলালে ঈসায়ী সন অনুসারে তাঁর জন্ম ২৫ জুন ১৮৯৯। তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম। শৈশবে বাবার কাছ থেকেই তিনি আরবি, ফারসি ভাষা, পবিত্র কোরআন পড়া এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। বাল্য বয়সে বাবাকে হারিয়ে তিনি নিজেও মসজিদের মুয়াজ্জিম,ইমামতি ও গ্রাম্য মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। বাল্যকালে তিনি ইসলামের যে মৌলিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পর্বে তার প্রভাব লক্ষণীয়। তাঁর কবিতা, গল্প ও গানে ফুটে ওঠেছে ইসলামী ঐতিহ্য ও সুমহান আদর্শ।
বাংলা গানের জগতের ‘বুলবুল’ কাজী নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করতে তিনি আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। অবশ্য সত্যিকারে হাতিয়ার হাতেও তিনি যুদ্ধ করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১৭ সালে ৪৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সাধারণ সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তার দক্ষতা ও যোগ্যতা বলে তিনি সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। সৈনিকজীবনে তিনি ব্যাটেলিয়ানের পাঞ্জাবি মৌলভীর নিকট ফারসি ভাষা শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করেন।
বৈচিত্র্যে ভরা কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন। বন্ধুবৎসল কবির জীবনে বন্ধুদের প্রভাবে অনেক বাঁক বদল হয়েছে। তিনি নার্গিসকে ত্যাগ করে প্রমীলা দেবিকে বিয়ে করেছিলেন। শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টির জন্য অনেক গান কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু ইসলাম থেকে কেউ তাকে দূরে সরাতে পারেনি। তাঁর বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহীতে পৌরাণিক মিথ ব্যবহার করে অনেক কঠিন কথা উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু ইসলামী উপমা ব্যবহার করেছেন সর্তকতার সাথে। ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান’ কিংবা ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ মুসলিম মনে ঝংকার তোলা এমন সহ¯্রাধিক গান তিনি রচনা করেছেন। বাংলা গজলের প্রথম ¯্রষ্টা তিনি। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি,সাংবাদিক, সম্পাদক,ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্য ভাÐার তাঁর অবদানে ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তাঁর উল্লেখ যোগ্য সৃষ্টিকর্ম হলো: কাব্যগ্রন্থ: অগ্নিবীণা (১৯২২) , সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৮), সঞ্চিতা (১৯২৮); বুলবুল (১৯২৮), জিঞ্জির (১৯২৮) ও চক্রবাক (১৯২৯)। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয়েছে নজরুলের রাজনৈতিক উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা, গানের সংকলন নজরুল-গীতিকা, নাটিকা ঝিলিমিলি এবং কবিতা ও গানের সংকলন প্রলয়-শিখা ও চন্দ্রবিন্দু। শেষোক্ত গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত এবং প্রলয়-শিখা-র জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত আদালতের রায়ে নজরুলের ছয় মাসের সশ্রম কারাদÐের আদেশ হয়, নজরুল হাইকোর্টে আপিল ও জামিন লাভ করেন। ইতোমধ্যে গান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে হাইকোর্ট কর্তৃক নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা খারিজের আদেশ দেওয়া হয়, ফলে নজরুলকে দ্বিতীয়বার কারাবাস করতে হয়নি। ১৯৩২ সালে নজরুলের প্রকাশনার মধ্যে সবগুলিই ছিল গীতিসংকলন, যেমন: সুর-সাকী, জুলফিকার ও বন-গীতি। ১৯৩২-৩৩ সাল এক বছর নজরুল এইচ.এম.ভি ছেড়ে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৩৩ সালে নজরুল এক্সক্লুসিভ কম্পোজাররূপে এইচ.এম.ভি-তে পুনরায় যোগদান করেন। এ সময় তাঁর অনেক গান রেকর্ড হয়। ১৯৩৩ সালে নজরুল তিনটি মূল্যবান অনুবাদ-কর্ম সমাপ্ত করেন: রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম এবং কাব্য আমপারা।
১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনা হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রæয়ারি ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে ।
নানা আয়োজনে জাতীয় কবি নজরুলকে স্মরণ: নানা আয়োজনের মাধ্যেম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৪তম প্রয়াণ দিবস পালিত হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে গতকাল ১২ ভাদ্র বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। এরপর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাবি উপাচার্য বলেন, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে প্রেরণার এক অসাধারণ উৎস কাজী নজরুল ইসলাম। কঠিনতম সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে নজরুলের গান ও কবিতা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এ দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বৃক্ষের মূল উৎপাটন করবো বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। একইসঙ্গে নজরুলের চেতনায় সমৃদ্ধি ও সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণ করবো। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বদরুল আরেফীন বলেন, নজরুলের কীর্তি ও রচনা চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের সাহিত্য অঙ্গন আরও এগিয়ে নেবো। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত। দুঃশাসনের এ যুগে তিনি আমাদের প্রতিটিক্ষণ এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন, এ দুঃসময় অতিক্রম করার জন্য, সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি আমাদের পাশেই রয়েছেন। কবির নাতনি খিলখিল কাজীসহ অনেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রশাসনিক ভবনস্থ অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম নজরুল বিশেষজ্ঞ হিসেবে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন। এছাড়া জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাদ ফজর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদুল জামিয়া’য় কোরানখানি অনুষ্ঠিত হয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com