প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত কিছুদিন ধরে ক্রমাগত কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য সংকট মোকাবেলায় কোনো জমি যাতে অনাবাদী না থাকে, সে আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি বাস্তবতার নিরিখে এ আহ্বান জানাচ্ছেন। বাস্তবতাকে স্বীকার করে সকলকে উদ্যোগী হওয়ার তার এই আহ্বানে সাড়া পড়েছে। সাধারণ মানুষও পতিত ও অনাবাদী জমিতে ফসল ফলাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং খাদ্য উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে। এটাই হচ্ছে, সঠিক উপলব্ধি ও পদক্ষেপ। শুধু পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে থাকলে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হতো না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, অর্থনৈতিক প্রত্যেকটি খাতের সঠিক পরিসংখ্যান ও পরিস্থিতি তুলে ধরা উচিত। এতে সমস্যা যেমন চিহ্নিত হয়, তেমনি সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায়।
বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বিষয়ক পরিসংখ্যান সবসময় বাস্তবচিত্র তুলে ধরে না। এর মধ্যে পরিসংখ্যানগত ভুল তথ্য উপস্থাপন করলে তা ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি করে। বিগত বছরগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিসংখ্যান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে যেসব পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়, তার সঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বরাবরই দ্বিমত পোষণ করে আসছে। এসব পরিসংখ্যানে যতটা উন্নতির সূচক দেখানো হয়, ততটা উন্নয়ন হয় না বলে তাদের অভিমত। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের উন্নয়ন দেখানোর জন্য বাড়িয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ ও তুলে ধরা হয়। এতে যেমন জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, তেমনি প্রকৃত উন্নয়নের চিত্র উঠে আসে না। তারা এ ধরনের উন্নয়ন চিত্রকে ‘পরিসংখ্যানগত উন্নয়ন’ বা ‘কাগজে-কলমে’র উন্নয়ন হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে সরকারের তরফে যে পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। জিডিপি নিয়ে সরকার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থার তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে দেখা গেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নিয়েও একধরনের ‘শুভংকরের ফাঁকি’ রয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। এখন দেশের প্রকৃত রিজার্ভ কত, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সরকার বলছে, দেশে রিজার্ভ রয়েছে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানো যাবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার, যা তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। এর মধ্যে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া নিয়ে আইএমএফ রিজার্ভের নেট হিসাব চেয়েছে। সরকার সে হিসাব দিয়েছে, তবে তা প্রকাশ করেনি। এর ফলে রিজার্ভ নিয়ে একধরনের গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির হার কত, তারও সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।
দেখা যাচ্ছে, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ও পরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত যেসব পরিসংখ্যান সরকারের তরফ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে, তা এখন অনেকটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে দেশের আর্থিক খাত ও জীবনমানের উন্নয়নের চিত্র নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। অথচ পরিসংখ্যান কোনো লুকোচুরিরও ব্যাপার নয়। প্রকৃত চিত্র সামনে থাকলে সমস্যা চিহ্নিত করে তা উত্তরণের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়া যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ কাজটি যথাযথভাবে করছে না। বরং প্রকৃত চিত্র আড়াল করে এমনভাবে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা হচ্ছে, মনে হওয়া স্বাভাবিক, দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। এখন বিশ্বমন্দার ধাক্কায় সেসব পরিসংখ্যান ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা অনেক দিন ধরে শুনছি, কোনো কোনো দেশে চাল রফতানিও করা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। বিদেশ থেকে লাখ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে। বিদ্যুতের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথাও বলা হয়েছে। এ খাত এখন বিপর্যস্ত। গ্যাসের অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না বলে বলা হচ্ছে। গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খাতটিকে অনেকটা আমদানি নির্ভর করে ফেলা হয়েছে। বিশ্ববাজারে সংকট ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই আমদানি নির্ভর হতে গিয়ে দেশের গ্যাস উত্তোলনের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। এখন বাপেক্স দেশের গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উত্তোলনের তোড়জোড় শুরু করেছে। গ্যাসও পাওয়া যাচ্ছে। এ কাজটি আগে করলে কি হতো? অথচ ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোও সংকটে পড়েছিল। তবে তারা নিজস্ব গ্যাসের ভা-ার তৈরি রাখায় সে সংকট সামাল দিয়ে ফেলেছে। আমরাও যদি আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম, তাহলে সংকটে খাবি খেতে হতো না। রফতনি, রিজার্ভসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক সরকারের তরফ থেকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ফলে সংকটের সময় তা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অথচ উন্নয়ন খাতের সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যান থাকলে কোথায় কোন খাতে কি ধরনের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ প্রয়োজন, তা সহজে নেয়া যায়। সেখানে উন্নয়ন করে পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ করা যায়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, একশ্রেণীর আমলা যারা সরকারকে খুশি করতে ব্যস্ত থাকে। তারা নানাভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে প্রকৃত চিত্র আড়াল করে দেয়। সরকারও উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে থাকে। অনেক সময়, রাজনৈতিক কারণে মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্য সরকার উন্নয়নের পরিসংখ্যান তুলে ধরে। অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারায় এসব পরিসংখ্যান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করলেও, সংকটে তা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। তখন সরকারের পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। সরকারও সংশ্লিষ্ট খাত উন্নয়নে মনোযোগী হয়। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। আমলারা যদি সঠিক তথ্য গোপন রেখে ভুল তথ্য পরিসংখ্যানে উল্লেখ করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অন্যদিকে, ভুল তথ্য উপস্থাপন করে রাজনৈতিক ‘স্ট্যান্টবাজি’ বন্ধ করা উচিত।
আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে সততার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। যা আমরা কেউ চাই না।