১৪৪৪ হিজরি সালের রজব মাস চলছে। ২৬ রজবরাতে (১৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার) যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে পবিত্র শবেমেরাজ। হিজরি মাসগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ ও মহিমান্বিত মাসের নাম রজব। এ মাস আসে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে। ‘রজব’ শব্দের অর্থ সম্মানিত। সুতরাং রজব মাস অত্যন্ত সম্মানিত ও ফজিলতপূর্ণ।
জাহেলিয়ার যুগে আরবরা এ মাসকে অন্য মাসের তুলনায় বেশি সম্মান করতেন। এজন্য তারা এ মাসের নাম রেখেছিল ‘রজব’। ইসলাম আগমনের পর বছরের ১২ মাসের মধ্য থেকে রজবসহ চার মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ সম্মানিত মাস ঘোষণা করা হয়। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে গণনায় মাস ১২টি, তার মধ্যে চারটি (সম্মানিত হওয়ার কারণে) নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। [সূরা তওবা-৩৬] মুমিনের ইবাদতের কিছু বিশেষ মৌসুম রয়েছে। যে মৌসুমগুলোতে একজন মুমিন অল্প আমলেও বেশি সাওয়াবের অধিকারী হতে পারেন। তার মধ্য থেকে একটি অন্যতম মাস হলো রজব।
রজব হিজরি মাসগুলোর মধ্যে সপ্তম মাস। রজব অর্থ সম্ভ্রান্ত, প্রাচুর্যময়, মহান। এ মাসের মর্যাদা উপলব্ধি করতে প্রিয় নবী সা:-এর এ হাদিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রজব মাসে (ইবাদত দ্বারা অন্তরের) জমিন চাষাবাদ করল না আর শাবান মাসে (ইবাদতের মাধ্যমে মনের) জমিন আগাছামুক্ত করল না; সে রমজান মাসে (ইবাদতের) ফসল তুলতে পারবে না।’ [বায়হাকি] মর্যাদার এ মাসটিতে মহান আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার আসমান-জমিন সৃষ্টি করার দিন থেকেই বারো মাসে বছর হয়। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত; তিনটি একাধারে জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং চতুর্থটি হলো ‘রজব মুদার’, যা জমাদিউল আখিরা ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।’ [মুসলিম] মর্যাদার এ মাসটি মুমিন মুসলমানের ইবাদতের মাস। বরকত লাভের মাস। কেননা রাসূলুল্লাহ সা: কোমরে কাপড় বেঁধে এ মাসে ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত হতেন। রোজা রাখতেন এবং বেশি বেশি বরকত পেতে দোয়া পড়তেন; তার উম্মতকেও দোয়া পড়তে বলতেন। ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থ : ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান মাস আমাদের নসিব করুন।’ (বুখারি ও মুসলিম) ‘রজব মুদার’ বা বহুবিদ কল্যাণের সম্মিলন এ মাস। রমজানের আগে নিজেদের আমল ও ইবাদতের জন্য উপযোগী করে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাস রজব। তা ছাড়া রজব ও শাবান হলো পাশাপাশি দু’টি জোড়া মাস। মাস দু’টিকে একত্রে রজবান বা রাজাবাইনও বলা হয়। তাই বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি, দোয়া-ইসতেগফার ও রোজা রাখার মতো আমল ইবাদত করে এ দুই মাসে নিজেদের প্রস্তুত করার উপযুক্ত সময়।
রজব মাসজুড়ে রাসূলুল্লাহ সা: অত্যধিক আমল-ইবাদত করতেন, রোজা রাখতেন। দোয়া পড়তেন। রমজানের জন্য নিজেকে তৈরি করতে, নিজের মন-মানসিকতাকে পরিচ্ছন্ন করতে এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘রজব হলো আল্লাহর মাস, শাবান হলো আমার মাস; রমজান হলো আমার উম্মতের মাস।’ [তিরমিজি]। রজব ও শাবান মাসে প্রিয়নবী সা: কী পরিমাণ ইবাদত-বন্দেগি করতেন; তা উম্মাহাতুল মুমিনিনদের বর্ণনা থেকেই সুস্পষ্ট। হাদিসে এসেছে- হজরত উম্মে সালমা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: রমজান মাস ছাড়া সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, অতঃপর রজব মাসে। হজরত আয়েশা রা: বলেন, ‘যখন রজব মাস আসত, রাসূলুল্লাহ সা:-এর আমলের আধিক্য দেখেই আমরা তা বুঝতে পারতাম।’ কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ সা: রজব মাসে ১০টি রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি রোজা রাখতেন; রমজান মাসে ৩০টি রোজা রাখতেন। [দারিমি] রজব মাসের বিশেষ আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বেশি বেশি নফল রোজা পালন করা। মাসজুড়ে প্রিয়নবী সা:-এর নিয়মিত আমল- ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা পালন করা। সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টিতে রজব মাসজুড়ে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া। বিশেষ করে তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, দোহা, জাওয়াল, আউয়াবিন; তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলুল মাসজিদ ইত্যাদি নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া খুবই জরুরি। সাহাবায়ে কেরামও এ মাসের ইবাদত ও ফজিলত বর্ণনা করেছেন। হজরত সালমান ফারসি রা: বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, রজব মাসের প্রথম তারিখে ১০ রাকাত নফল নামাজ পড়তে হয়। হজরত ওমর রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, অতি মহান (মর্যাদার) চারটি রাত হলো- রজব মাসের প্রথম রাত; শাবান মাসের মধ্য দিবসের রাত (শবেবরাত); শাওয়াল মাসের প্রথম রাত (ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদের রাত); জিলহজ মাসের দশম রাত (ঈদুল আজহা বা কোরবানি ঈদের রাত)। সুতরাং মুমিন-মুসলমানের উচিত, রজব মাসের মর্যাদা, ফজিলত ও আমলের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। রমজানের পরিপূর্ণ ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক