ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে আচমকা ত্রিপুরা তথা চাকলা রোশনাবাদের রাজস্ব বাড়িয়ে দেয়। আগের তুলনায় তা তিন গুণ। নবাব আলিবর্দি খান ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ে এ অঞ্চলের রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ৩০৫ টাকা। ১৭৬৫ সালে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা ধার্য করা হয়। এ বিপুল রাজস্বের জোগান দিতে ত্রিপুরার রাজা ও স্থানীয় জমিদাররা হতদরিদ্র কৃষক প্রজাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাদের উৎপাদিত প্রায় সবকিছু রাজস্ব হিসেবে চলে যেত কোম্পানির ভা-ারে। ফলে চাকলা রোশনাবাদের মঞ্চে দুর্ভিক্ষের তা-বলীলা অনুষ্ঠিত হতে সময় লাগেনি। তা এতটাই চরমে পৌঁছেছিল যে অনেক হতভাগ্য কৃষক সামান্য কয়টি টাকার জন্য এমনকি তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করতেও দ্বিধা করেননি। তাদেরই একজন পেয়ার মোহাম্মদ। তিনি খাদ্যের সন্ধানে কুঞ্জরা (বর্তমান ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার একটি গ্রাম) থেকে হিজরত করে দক্ষিণশিকে চলে আসেন এবং সেখানকার জমিদার নাছির মোহাম্মদের কাছে তার বালক পুত্রকে বিক্রি করে দেন। তখন কে আন্দাজ করেছিল, প্রাপ্তবয়সে এ বালকই তার আশ্রয়দাতা নাছির মোহাম্মদকে পরাজিত করে জমিদার হবেন এবং সেখানেই থেমে না থেকে কালক্রমে হয়ে উঠবেন ত্রিপুরার রাজা! পরিচিত হবেন শমসের গাজী নামে। শমসের গাজীর প্রারম্ভিক জীবন সম্পর্কে এমন তথ্য পাওয়া যায় ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইয়ে। তার বক্তব্য অনুসারে, ১৭৬৫ সালে শমসের গাজী বালক। তাহলে তার জন্মসাল আন্দাজ করা যেতে পারে ১৭৫০ সালে বা তার কিছু আগে-পরে। সুপ্রকাশ রায়ের মতে, শমসের গাজীর নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয় ১৭৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু শমসের গাজীর জীবনী লেখক আহমদ মমতাজের মতে, তিনি ১৭০৫ সাল, মতান্তরে ১৭০৬ বা ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সুপ্রকাশ রায়ের মতে, শমসের গাজীর বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশরা ক্ষমতায়। আর আহমদ মমতাজের মতে, শমসের গাজী ত্রিপুরা তথা চাকলা রোশনাবাদের শাসক হন নবাব আলিবর্দি খানের সময়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, তার জীবন ও কীর্তি নিয়ে ঐতিহাসিক তথ্যবিভ্রাট আছে। তাছাড়া তাকে নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। তবে শমসের গাজীর নেতৃত্বে যে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ লেখায় দুই ভিন্নমতেরই প্রভাব আছে।
শমসের, আরবি এ শব্দের অর্থ তরবারি। আর তা যদি হয় হযরত আলীর, তাহলে তো আর কথাই নেই। চাকলা রোশনাবাদের ক্ষুৎপীড়িত চাষী পেয়ার মোহাম্মদ কী মনে করে নবজাতকের নাম শমসের আলী (অর্থ আলীর তরবারি) রেখেছিলেন, তা এখন আর প্রত্যয় করে জানার উপায় নেই। তবে নামের পূর্ণ মহিমা যে তার জীবনে প্রতিভাত হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। সে যাত্রা ছিল ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত তৎকালীন দক্ষিণশিক, বর্তমান ফেনীর ছাগলনাইয়ার অদূরে মুহুরী নদীর তীরবর্তী প্রাচীন পানুয়াঘাট থেকে। ছাগলনাইয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের নৌ-যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র ছিল পানুয়াঘাট। এ ঘাট দিয়েই লোক পারাপার এবং পণ্য আনা-নেয়া হতো। প্রতি সপ্তাহে বসত হাট। জলপথে তখন মগ ও পর্তুগিজ হার্মাদদের ত্রাস। দক্ষিণশিকের মুহুরী নদীতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এ দস্যুদের অত্যাচার থেকে নদী-তীরবর্তী জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে সেখানকার জমিদার নাছির মোহাম্মদ পানুয়াঘাটে একটি কেল্লা নির্মাণ করেন। কেল্লার দায়িত্বে যিনি থাকতেন, তাকে বলা হতো কেল্লাদার। একপর্যায়ে জমিদারের কৃপায় কেল্লাদার হন যুবক শমসের আলী। এটি তার সাফল্যের প্রথম সোপান। যার চূড়ান্ত পরিণতিতে শমসের আলী থেকে তিনি হয়ে ওঠেন শমসের গাজী। পরিচিতি পান ‘ভাটির বাঘ’ নামে। পানুয়াঘাট কেল্লার অধিপতি শমসের গাজী। স্থানীয় চোর-ডাকাত, এমনকি জলদস্যুরাও তার ভয়ে থরহরি কম্পমান। তারা গাজীর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শমসের গাজী’ জীবনীগ্রন্থে (প্রথম প্রকাশÍজুন ২০১৩) রচয়িতা আহমদ মমতাজ লেখেন, ‘পানুয়াঘাট কেল্লার অধিপতি নিযুক্তির সংবাদে স্থানীয় চোর-ডাকাতের মতো জলদস্যুরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এতদিন নির্বিঘেœ ডাকাতি, হত্যা ও অপহরণ চালিয়ে যাচ্ছিল, এবার গাজীর পানুয়াঘাট আগমনে তারা বিচলিত হয়। স্থানীয় দস্যুরা একজোট হয়ে গাজীর নিকট এসে হাজির হয় এবং কাতর স্বরে শপথ করে বলে, গাজীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় তারা কখনো চুরি-ডাকাতি করবে না। অন্যস্থানে যা রোজগার হবে তার অর্ধেকাংশ গাজীকে দিয়ে যাবে। উপরন্তু ডাকাতেরা কথা দেয় গাজী তার প্রয়োজনে যখনই আহ্বান জানাবেন ডাকাতরা জীবন দিয়ে হলেও সে দায়িত্ব পালন করবে।’ ডাকাত দলের সমর্থনে শমসের গাজীর শক্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
দক্ষিণশিকের জমিদার নাছির মোহাম্মদের কন্যা দৈয়্যা বিবি। তার রূপে-গুণে মুগ্ধ কেল্লাদার শমসের গাজী। তিনি সহচর বছিরের মাধ্যমে জমিদারের কাছে তার কন্যার পাণি গ্রহণের আরজি পেশ করেন। প্রস্তাব শুনে নাছির মোহাম্মদ রাগে অগ্নিশর্মা। তিনি পানুয়াঘাট থেকে শমসেরকে ধরে আনার জন্য পেয়াদা দল প্রেরণ করেন। এরই মধ্যে বছির পালিয়ে দুঃসংবাদ পৌঁছে দেয় গাজীর কানে। শমসের গাজী তার দলবল নিয়ে পানুয়াঘাটের পার্শ্ববর্তী বেদরাবাদের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে করয়া নামক স্থানে জমিদারের বাহিনী তাদের ঘেরাও করে। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। যদিও জমিদারের সৈন্যবল অনেক বেশি ছিল, তবুও শেষ হাসি ফোটে শমসের গাজীর ঠোঁটেই। অতঃপর গাজী মুহুরী নদী পার হয়ে বেদরাবাদের কচুয়া মৌজার জমিদার নুর মোহাম্মদ ভূঞার শরণ নেন। কচুয়ার জমিদারের সহায়তায় তিনি দক্ষিণশিক আক্রমণ করেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নাছির মোহাম্মদকে পরাজিত করে তিনি দক্ষিণশিকের জমিদারি দখল করেন। তবে দৈয়্যা বিবিকে তিনি বিয়ে করতে পারেননি। যুদ্ধে পিতা ও দুই ভাইকে হারিয়ে তিনি অনলে আত্মাহুতি দেন। তবে ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, দৈয়্যা বিবিকে বিয়ে করতে চাওয়াটা ছিল শমসের গাজীর বাহানা মাত্র। মূলত দরিদ্র কৃষক প্রজাদের ওপর জমিদারের অত্যাচার খুব কাছ থেকে দেখে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। তাই জমিদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা করার জন্য তিনি এ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ বইয়ে সুপ্রকাশ রায় লেখেন, ‘তিনি তাঁহার সমবয়স্ক কৃষক যুবকগণকে বুঝাইয়া ধীরে ধীরে দল গঠন করিতে আরম্ভ করেন। দল গঠনের পর শমসের জমিদার নাছির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার এক অভিনব উপায় অবলম্বন করেন। একদিন তিনি সদলবলে জমিদারের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং জমিদার-কন্যাকে তাঁহার সহিত বিবাহ দিবার প্রস্তাব জানাইলেন। ইহাতে জমিদারের আভিজাত্যে প্রচ- আঘাত লাগিল। তিনি একজন ক্রীতদাসের সহিত নিজ কন্যার বিবাহ দিতে অস্বীকার করিলেন এবং তাঁহারই ক্রীতদাসের এই প্রকার ঔদ্ধত্যে ক্ষিপ্ত হইয়া শমসেরকে শাস্তি দিবার আয়োজন করিলেন।’ এ মন্তব্যের স্বপক্ষে তিনি কৈলাস সিংহ রচিত ‘রাজমালা’ ও নোয়াখালীর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারের দোহাই দিয়েছেন। শমসের গাজীর বিদ্রোহের স্বরূপ সম্পর্কে তিনি আরো লেখেন, ‘জমিদার প্রভুর বিরুদ্ধে ক্রীতদাস শমসেরের বিদ্রোহের কথা চারিদিকে প্রচারিত হইল, হিন্দু-মুসলমান কৃষক যুবকগণ দলে দলে আসিয়া তাঁহার বাহিনীতে যোগদান করিতে লাগিল। শমসের তাহাদের লইয়া গভীর বনে বসিয়া নানা প্রকার অস্ত্র চালনা অভ্যাস করিলেন। অবশেষে এই কৃষক-বাহিনী লইয়া তিনি প্রকাশ্যে জমিদার নাছির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিলেন।’
শমসের গাজীর নেতৃত্বে দক্ষিণশিকে যখন বিদ্রোহ সংঘটিত হচ্ছে, তখন ত্রিপুরার রাজসিংহাসনে ছিলেন রাজা ইন্দ্রমাণিক্য। তার প্রতিনিধি ছিলেন ছোট ভাই কৃষ্ণমাণিক্য। দক্ষিণশিকের পতনের খবর তার কানে পৌঁছলে তিনি শমসের গাজীকে দমনের জন্য তার মন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। শমসের প্রস্তুত ছিলেন। তিনি জানতেন, ত্রিপুরারাজের সঙ্গে তার সংঘর্ষ অনিবার্য। স্থানীয় সৈনিকদের নিয়ে তিনি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। বাড়ি ও কেল্লার চতুষ্পার্শ্বে পরিখা খনন করে সশস্ত্র পাহারার আয়োজন করেন। বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। এ যুদ্ধের ফলাফল কী হলো, তা সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায় জানা যাকÍ‘বিদ্রোহীদের সহিত রাজকীয় বাহিনীর এক ঘোরতর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে রাজকীয় বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ পরাজয়ের পর মন্ত্রী মহাশয় শমসেরকে ত্রিপুরারাজের অধীন দক্ষিণশিক পরগনার জমিদার বলিয়া স্বীকার করেন।’ দক্ষিণশিকের জমিদার হয়েই থেমে থাকেননি শমসের গাজী। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ত্রিপুরারাজের বশংবদ থেকে দরিদ্র প্রজাদের দুর্দশা দূর করা সম্ভব নয়। তাই তিনি রাজস্ব দেয়া বন্ধ করে নিজেকে সমগ্র চাকলা রোশনাবাদের স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, ত্রিপুরা রাজ্যের অন্য নাম ছিল চাকলা রোশনাবাদ। ‘রাজমালা’ গ্রন্থকার কৈলাস সিংহের মতে, ১৭৩২ সালে মোগলরা শেষবারের মতো ত্রিপুরা জয় করে এর নাম দেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শমসের আবার সেনাশক্তি বাড়াতে মনোযোগী হন। তার জমিদারিভুক্ত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাকে সমর্থন করেন। নতুন করে তিনি তিন হাজার দুর্র্ধষ সৈন্য সংগ্রহ করেন।
গাজী ও রাজার বিরোধ চরমে ওঠে। অবশেষে খ-ল অঞ্চলে গাজীর বাহিনী মুখোমুখি হয় রাজবাহিনীর। সব মিলিয়ে শমসের গাজীর মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল ছয় হাজার। এর মধ্যে ৩০০ অশ্বারোহী, ২০০ গজারোহী এবং ৪ হাজার ৫০০ পদাতিক। ত্রিপুরারাজের বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল সাত হাজার। মণিপুর থেকে আরো দুই হাজার পাহাড়ি কুকি ও টিপরা সৈন্য এসে রাজার বাহিনীতে যোগ দেয়। তুমুল যুদ্ধে রাজবাহিনীকে পরাজিত করেন শমসের গাজী। আহমদ মমতাজ লেখেন, ‘এই যুদ্ধে ত্রিপুরার পক্ষে ২ হাজার এবং শমসের গাজীর পক্ষে ১ হাজার সৈন্য নিহত হয়।’ পরাজিত সেনাদলের পশ্চাদ্ধাবন করে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরে উপস্থিত হন শমসের গাজী। এরই মধ্যে মণিপুর থেকে ত্রিপুরারাজের সাহায্যার্থে পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী আসে। গাজীর বাহিনীর সঙ্গে তাদের সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধ চলে। ফল আসে গাজীর পক্ষে। রাজা কৃষ্ণমাণিক্য পালিয়ে মণিপুরে আশ্রয় নেন। প্রশাসনিক কাঠামো ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনর্গঠন ও সুসংহত করে ত্রিপুরার শাসনভার গ্রহণ করেন শমসের গাজী।
ত্রিপুরা রাজ্য দখল করেই সিংহাসনে বসেননি শমসের গাজী। দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে কৌশলগত কারণে তিনি লক্ষ্মণমাণিক্যকে সিংহাসনে বসান। এ উপায়ে তিনি পাহাড়ি কুকি ও ত্রিপুরাদের বশ্যতা আদায়ে সক্ষম হন। তারা তাদের রাজবংশ ব্যতীত অন্য কাউকে কর দিতে রাজি ছিল না। এ প্রসঙ্গে কৈলাস সিংহ ‘রাজমালা’য় উল্লেখ করেন, ‘মীর কাসিমের অধঃপতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেরূপ মুর্শিদাবাদে একজন সাক্ষীগোপাল নবাব রাখিয়াছিলেন, শমসের গাজীও তদ্রূপ লক্ষ্মণমাণিক্যের নামোল্লেখে কতকগুলি পার্বত্য জাতি হইতে কর সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন।’ অন্যদিকে কৃষ্ণমাণিক্য মণিপুর থেকে পাহাড়ি কুকিদের গাজীর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলেন। গাজীর সঙ্গে তাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সবক’টিতে গাজীর দল জয়লাভ করে। শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে তাদের বুঝিয়ে দলে টানার চেষ্টা করেন শমসের গাজী। অবশেষে গাজীকে তারা নিজেদের রাজা বলে মেনে নেয়। ফলে ত্রিপুরা রাজ্যের সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলে শমসের গাজীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য স্থাপিত হয়। আহমদ মমতাজ লেখেন, ‘…শমসের গাজীর উদার মনোভাব, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, দেশপ্রেম ও প্রজাদের প্রতি দরদ ও কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে পূর্বতন ত্রিপুরা রাজ্যের অনেক দায়িত্বপূর্ণ কর্মকর্তা তার বশ্যতা স্বীকার করেন ও অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন।’ ড. জগদীশ চৌধুরী রচিত ত্রিপুরার ইতিহাসে এর সমর্থনে সাক্ষ্য পাওয়া যায়Í‘ত্রিপুরেশ্বরের উজির রামধন, ত্রিপুরার সেনাপতি রণমর্দ্দন নারায়ণ, উজির উত্তর সিংহ শমসেরের পক্ষে যোগ দেন ও নানা দায়িত্ব পালন করেন।’ শমসের গাজীর পক্ষে লক্ষ্মণমাণিক্য তিন বছর রাজ্য শাসন করেন। তারপর গাজী স্বয়ং সিংহাসনে আরোহণ করেন। বাংলার সিংহাসনে তখন নবাব আলিবর্দি খান। ঢাকায় তার প্রতিনিধি ছিলেন হোসাইন উদ্দিন খান। তাদের অনুমোদনক্রমে ‘ফেনী নদীর উত্তর তীরবর্তী স্থান থেকে সিলেটের মনু নদ, মেঘনার পূর্ব তীর ও ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ ভূখ-ের একচ্ছত্র বৈধ শাসক পদে অধিষ্ঠিত হন শমসের গাজী। বিশাল এ অঞ্চলের জন্য বার্ষিক খাজনা হিসেবে নবাবের দরবারে পরিশোধ করতে হতো এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার টাকা’ (মমতাজ, ২০১৩)। দিল্লির সম্রাট ও বাংলার নবাব থেকে তিনি ‘সুবাহদার’ ও ‘সানি নবাব (দ্বিতীয় নবাব)’ উপাধি লাভ করেন। শমসের গাজীর এ রাজ্য বিভিন্ন পরগনায় বিভক্ত ছিল। আহমদ মমতাজের রচনায় এগুলোর একটি তালিকা পাওয়া যায়Íখ-ল, জগৎপুর, দক্ষিণশিক, আমিরাবাদ, তীষ্ণা (চৌদ্দগ্রাম অঞ্চল, কুমিল্লা), খানজাহনগর, মেহেরকুল (কুমিল্লা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়ে গঠিত), বগাসাইর, পাট্টিকারা বা পাইটকাড়া (চান্দিনাসংলগ্ন অঞ্চল), বলদাখাল, কসবা, নূরনগর (চাকলা রোশনাবাদের সুবৃহৎ পরগনা, কসবা অঞ্চলে অবস্থিত), চৌদ্দগ্রাম, গঙ্গামঙ্গল, বিশালগড়, আটজঙ্গল, ভাটিদেশ ও শ্রীহট্ট এবং সরাইল (বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি উপজেলা)। পরবর্তী সময়ে নোয়াখালীর ভুলুয়া ও চট্টগ্রামের নিজামপুর পরগনা শমসের গাজীর রাজ্যভুক্ত হয়।
শাসক হিসেবে শমসের গাজী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। প্রজাদের প্রতি তিনি ছিলেন দয়ালু ও উদার। তার ন্যায়পরায়ণতার প্রশংসা সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি পরগনায় তিনি সুদক্ষ শাসক নিয়োগ দেন। রাজ্য শাসনের জন্য তিনি বহু কর্মচারী নিয়োগ দেন। ‘গাজীনামা’ পুঁথিতে ১ হাজার ৮০ জন পদস্থ কর্মকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। নিজ রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে পুলিশি চৌকি বসান। বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য তিনি অনেকগুলো দুর্গ নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে গাজীর জীবনীকার আহমদ মমতাজ লেখেন, ‘শমসের গাজী রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরগনায় থানা স্থাপন করেন। সেখানে একজন দারোগা, মুহুরি ও জমাদার নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতি থানায় ১২ জন অস্ত্রধারী বরকন্দাজ নিযুক্ত করা হয়। লোকালয়ে রাত্রি বেলায় চৌকিদার পাহারায় থাকে।’ চোরাকারবারিদের দমন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেন শমসের গাজী। কৈলাসচন্দ্র সিংহ রচিত ‘রাজমালা’য় উল্লেখ আছে, ‘শমসের তাঁহার অধিকার মধ্যে দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের আশ্চর্য নিয়ম প্রচলিত করিয়াছিলেন। তাঁহার নির্দেশে ৮২ সিক্কা ওজনের সের ধার্য হইয়াছিল। তিনি সেই সেরের পরিমাণে কোন দ্রব্য কত মূল্যে বিক্রয় হইবে তাহার একটি তালিকা প্রত্যেক বাজারে টাঙ্গাইয়া দিয়াছিলেন। কেহ ইহার অন্যথা করিতে পারিত না।’ সে তালিকা অনুযায়ী শমসের গাজীর আমলে ১ পয়সায় এক সের চাল পাওয়া যেত। রাজস্ব বিভাগকেও তিনি সুসংহত করতে পেরেছিলেন।
শমসের গাজী ছিলেন প্রজাদরদি শাসক। তিনি প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অভিমত নিতেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনতেন। দরিদ্র প্রজাদের সুবিধার্থে তিনি রাস্তাঘাট, হাটবাজার এবং ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ করেন। শমসের গাজীকে দেশপ্রেমিক, প্রজাদরদি ও গণতান্ত্রিক রীতির অনুসারী আখ্যা দিয়ে আহমদ মমতাজ লেখেন, ‘দক্ষিণশিক, রোশনাবাদ প্রভৃতি এলাকায় শমসের গাজীর শাসনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় নতুন নতুন জনবসতি গড়ে ওঠে, পাহাড়-জঙ্গল কেটে সাফ করে ও নি¤œাঞ্চল ভরাট করে চাষাবাদযোগ্য জমি তৈরি হয়। জনগণের পানীয় জলের সংকট দূর ও চাষাবাদের জন্য গাজী কিছু দূর অন্তর দিঘি-পুকুর খনন করে দেন। … গরিব প্রজাদের জমির খাজনা মাফ করে দেন, মৌলবি-ব্রাহ্মণদের নিষ্করভূমি দান করেন।’ শমসের গাজী ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। ধর্ম নির্বিশেষে সব প্রজাকে তিনি সমান চোখে দেখতেন। তার শাসনকাজে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের কর্মচারীই ছিল। শিক্ষানুরাগী হিসেবেও শমসের গাজীর খ্যাতি আছে। শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
জন্মের মতো শমসের গাজীর মৃত্যু নিয়েও ধোঁয়াশা আছে। আহমদ মমতাজের মতে, ইসলামাবাদের (বর্তমান চট্টগ্রাম) নিজামপুর পরগনা দখল করা নিয়ে সেখানকার শাসক আগা বাকেরের সঙ্গে শমসের গাজীর শত্রুতা চরম আকার ধারণ করেছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে রংপুরে আগা বাকের শমসের গাজীকে বন্দি করে। ১৭৫২ সালে ‘ভাটির বাঘ’ শমসের গাজীকে হত্যা করা হয়। সুপ্রকাশ রায়ের রচনা অনুসারে সালটা অন্তত আরো ২০ বছর পরে। লেখক: নিজাম আশ শামস: লেখক ও অনুবাদক