আজ মহান ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতীয় আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার দাবিকে উচ্চে তুলে ধরার ঐতিহাসিক মাইলফলক দিবস আজ। মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় এ দিবসে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ঢাকার রাজপথে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৫২ সালের এইদিনে অবিবেচক ও স্বেচ্ছাচারী শাসকদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাঁদের হত্যা করে। পরবর্তীতে ভাষা শহীদদের এই আত্মত্যাগের কারণেই বাংলা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করে। শাসকরা বাধ্য হয় এই মর্যাদা দিতে। অন্যদিকে ভাষার জন্য জীবন দেয়ার বিরল ইতিহাস রচনার সুবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। ঐতিহাসিকভাবেই এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় স্বাতন্ত্র্যচেতনায় স্ফুরণ ঘটে, পরবর্তী যাবতীয় আন্দোলন, সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তার প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। ঘটেছে জাতীয় প্রতিষ্ঠা। আমরা স্মরণ করতে পারি ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদির কথা। এই আন্দোলনগুলো ভাষা আন্দোলনের চেতনার আলোকেই পরিচালিত হয়েছে। অতঃপর স্বাধীনতাযুদ্ধ যা ওইসব আন্দোলনেরই ধারাবাহিকতার ফল। স্বাধীনতার চেতনার মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা মিলে মিশে একাকার। এই চেতনার সারকথা, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষা, স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, ব্রিটিশ-ভারতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা, বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ ইত্যাদির বিবেচনায় ভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা মোটেই ন্যূন ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেই লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে হিন্দি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা ভাষার মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যের দাবি তুলে ধরে আরও বহু আগে কবি আবদুল হাকিম বলেছিলেন, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ পাকিস্তানী শাসকরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে রাজী হননি। ভাষা শহীদরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে দাবি তুলেছিলেন, এ মর্যাদা দিতে হবে। সে দাবির পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা ঘটেছে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। বাংলা প্রথমে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় আর এখন বাংলাদেশের একক ও একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আমরা দেশ পরিচয়ে বাংলাদেশী, ভাষা পরিচয়ে বাঙালী এবং ধর্মীয় পরিচয়ে অধিকাংশই মুসলমান। এই তিন পরিচয়ের একটিও অপরটির চেয়ে ছোট বা বড় নয়। আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে, অপরিসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই পরিচয় প্রতিষ্ঠিত ও নিশ্চিত করেছি।
২১’র চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, আমরা সে লক্ষ্য কতটা অর্জন করেছি, সে প্রশ্ন সঙ্গ কারণেই উঠতে পারে। ভাষার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শোষণ-ব নার অবসান, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন কায়েমের লক্ষ্য এখনো আমরা পুরোপুরি অর্জন করতে পারিনি। কথায়ই বলে, স্বাধীনতা অর্জন করা যত কঠিন, তার চেয়ে বেশি কঠিন তা সুরক্ষা করা। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে দুর্বল দেশের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এখন সেই চ্যালেঞ্জের মুখে অবস্থান করছি। রাজনীতিতে বহিরাগত প্রভাব স্পষ্ট। অর্থনীতিতে বাইরের সবল অর্থনীতির অনুপ্রবেশ ও দখল প্রতিষ্ঠার প্রবণতা দৃশ্যমান। সংস্কৃতিতে চলছে নানামুখী আগ্রাসন। এই বাস্তবতায় দেশে গণতন্ত্র উধাও, রাজনৈতিক দমনপীড়ন সাধারণ ঘটনা এবং ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন অধরা। বলা মোটেই বাহুল্য হবে না যে, বাংলাদেশ এখন এক বিশেষ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আমরা ভাষা আন্দোলন করেছিলাম, করেছিলাম মুক্তির যুদ্ধ এবং অর্জন করেছিলাম স্বাধীনতা, সেই গণতান্ত্রিক অধিকার এখন মুখ থুবড়ে আছে। এখন জাতি এক অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফল ভোগ করছে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর- সবকিছুই একটি বৃত্তে আটকে আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ-বিসংবাদ, সরকারের বেপরোয়া দমনপীড়ন, মানবাধিকারের যথেচ্ছ লঙ্ঘন, জননিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অনবরত ঠোকরাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ উচ্চারিত হলেও কোনো পথ এখনো দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠেনি। দুর্ভাগ্যজনক এই বাস্তবতার মধ্যেই এবার ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। জাতীয় ঐক্য এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট অবসান এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় জাতীয় প্রত্যাশা। ভাষা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে বর্তমান পরিস্থিতির অবসানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উদ্যোগী হবেন, শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবেন, এটাই আজকের দিনে আমরা কামনা করি।