সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্রাহক পর্যায়ে আবারো ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। মার্চের বিদ্যুতের বিল দিতে হবে নতুন এ দামে। এখন থেকে গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮ টাকা ২৫ পয়সা। আগে ছিল ৭ টাকা ৮৬ পয়সা। ওই দামও বাড়ানো হয়েছিল গত ৩১ জানুয়ারি। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানেই ইউনিটপ্রতি দাম বাড়ল ৩৯ পয়সা। বিদ্যুৎ বিভাগ নির্বাহী আদেশের ক্ষমতা পাওয়ার পর চলতি বছরের প্রথম দুই মাসেই তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। প্রথমবার বেড়েছিল ১২ জানুয়ারি।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, লাইফলাইন গ্রাহকের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম (০-৫০ ইউনিট পর্যন্ত) ৪ টাকা ১৪ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ টাকা ৩৫ পয়সা। প্রথম ধাপের ব্যবহারকারীর (০-৭৫ ইউনিট) ক্ষেত্রে ৪ টাকা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের ব্যবহারকারীর দাম (৭৬-২০০ ইউনিট) নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা, যা আগে ছিল ৬ টাকা ৩১ পয়সা। তৃতীয় ধাপের (২০১-৩০০ ইউনিট) ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৬২ থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া ৩০১-৪০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৯৯ থেকে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১-৬০০ ইউনিটের ক্ষেত্রে ১০ টাকা ৯৬ থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৫১ পয়সা, ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১২ টাকা ৬৩ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা।
সেচ, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রাস্তার বাতিসহ অন্যান্য বিদ্যুতের দামও বাড়িয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে কৃষিতে ব্যবহূত সেচযন্ত্রের বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ টাকা ৮২ পয়সা, যা ৩১ জানুয়ারি বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৪ টাকা ৫৯ পয়সা। শিক্ষা, ধর্মীয়, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৬৪ থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৭ পয়সা করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্পে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৯ টাকা ৪১ থেকে বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮৮, রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পে ৮ টাকা ৪৯ থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৯১, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের ক্ষেত্রে ৮ টাকা ৪২ থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৮৪, বাণিজ্যিক ও অফিস ফ্ল্যাটে ১১ টাকা ৩৬ থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯৩ এবং নির্মাণ শিল্পের বিদ্যুতের দাম ১৩ টাকা ২৩ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ টাকা ৮৯ পয়সা।
দুই মাসে তিন দফা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে লাইফলাইন গ্রাহকের ইউনিটপ্রতি খরচ বেড়েছে ৬০ পয়সা, ৭৫-৬০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি দাম বেড়েছে ৬৬ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১ টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত। এছাড়া তিন দফায় ইউনিটপ্রতি খরচ বেড়েছে সেচের বিদ্যুতে সর্বোচ্চ ৬৬ পয়সা; শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, দাতব্য ও হাসাপাতালের ক্ষেত্রে ৯৫ পয়সা; রাস্তার বাতির জন্য ১ টাকা ২১ পয়সা; ব্যাটারি চার্জিংয়ে ১ টাকা ২০ পয়সা; বাণিজ্যিক অফিসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬৩ পয়সা ও নির্মাণ শিল্পের জন্য ১ টাকা ৮৯ পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে নতুন বছরে প্রতি মাসেই দাম সমন্বয় করছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় গত দুই মাসে গ্রাহক পর্যায়ে তিনবার ৫ শতাংশ করে মোট ১৫ ভাগ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যেসব গ্রাহক মাসে ২০১-৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, ৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের খরচ মাসে ৬৬ থেকে ৯৯ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এভাবে গ্রাহকভেদে বিদ্যুতের দাম আগের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়বে।
মাসে মাসে এভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবীদরা। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির মাত্রা কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন মূল্যস্ফীতি অনেকটাই উচ্চপর্যায়ে আছে, সামনে তা আরো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এভাবে লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে।’
বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সরকার ভর্তুকির খরচ কমানোর চেষ্টা করলেও তা কতটা কমানো হচ্ছে সেটি জানার সুযোগ সেই জনগণের। একই সঙ্গে এ মূল্যবৃদ্ধির ব্যয় বহন করার সক্ষমতা তাদের আছে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। এটি দরকার। তবে এটি গণশুনানির মধ্য দিয়ে হলে ভালো হতো। এখানে ভোক্তার এ বিষয়ে জানার ও মতামত দেয়ার সুযোগ থাকত। কিন্তু এখন সরকার দাম বাড়াচ্ছে, কতটুকু ভর্তুকি কমে যাবে, সে বিষয়ে ভোক্তা জানতে পারছে না। আসলে এটি সাধারণ মানুষের বহন করার সক্ষমতা রয়েছে কিনা সেটিই এখন বিবেচ্য বিষয়। এটা একটা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।’ সরকারের নির্বাহী আদেশের আগে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এর পর থেকে সেই ক্ষমতায় তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়াল বিদ্যুৎ বিভাগ।