রোদের ভেতর ইলসে গুঁড়ি সঙ্গে পাখির ডাক আম বাগানের ভিতর যেন মৌমাছিদের ঝাঁক প্রকৃতি আমাদের জীবনের আশ্রয়। মানুষের সূচনা থেকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এবং জীবন ও জীবিকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। উৎপাদন ব্যবস্থা, মানুষের জীবনধারণ, বিবর্তন, আর্থিক ভিত্তি নির্মাণ, সমাজকাঠামো, পারস্পরিক লেনদেন, প্রাণ ও পরিবেশ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মৌল উপাদান ও ভিত্তিতে প্রকৃতি অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখে। প্রকৃতি ব্যক্তিমানুষ ও সংস্কৃতির বহুবিধ নির্মাণ ও অভিব্যক্তির আধার। দৃষ্টিপথের ভূদৃশ্য, আবাদ ও জীবিকার ক্ষেত্র, রাজনীতির জায়গা, জাতির ভূখন্ড, ধর্মের পুণ্যভূমি, পর্যটনের কেন্দ্র, সাহিত্যের উপাদান, চিত্রকলার মটিফ, অলঙ্করণের কৌশল, নৈতিকতার মানদন্ড বা আচরণের নির্দেশক হিসেবে প্রকৃতির উপস্থাপন ও উদ্ভাসন অনেক মানবীয় কর্মকান্ডের কয়েকটি দিক। মননচর্চা থেকে শুরু করে জীবিকার বিরাট আয়তনে প্রকৃতি সব সময় তার প্রাকৃতিকতা ও বস্তুময়তা দিয়ে সফলতা-বিফলতা পরিমাপে সাহায্য করে। ফলে শিল্পে, বক্তব্যে, লিখনে, পাঠ্যে ইত্যাদি কর্মকান্ডে প্রকৃতির ঋণ অনস্বীকার্য। দর্শন, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে প্রকৃতির প্রসঙ্গ সঙ্কট ও সমাধানের বিষয় হয়ে দেখা দেয়। মানুষ তাই প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সন্তানরূপে বিরাজমান। তবে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, দর্শন, লক্ষ্য, সৌন্দর্যবোধ, মূল্যবোধ, নৈতিকতাবোধের নির্মাণে প্রকৃতির অবদান স্বীকার করেও বলা যায়, সৃষ্টিশীলতার পরিবর্তন, মতাদর্শের মেরুকরণ প্রকৃতি-মূল্যায়নে স্থিরতা দেয়নি। (মুহাম্মদ হাসান ইমাম, ‘প্রকৃতি: সদরে-অন্দরে’, চিহ্ন: ২০০৯) বিভিন্ন সময়ে তার পরিবর্তন হয়েছে নানাভাবে। জীবনাচরণে-শিল্পে-সাহিত্যে তাই প্রকৃতির উপস্থিতি অনিবার্য। সৃষ্টিশীল ও সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে একজন কবির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক আরো ব্যাপক ও গভীর। সেজন্য কবির সৃষ্টিকর্মে প্রকৃতির সামগ্রিক রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-স্বাদের রূপকল্প বাক্সময় হয়ে ওঠে। এক অর্থে কবিকে প্রকৃতির সাধক বলা হয়ে থাকে। কারণ কবিতা সৃজনে প্রেরণা ও ক্ষেত্র হিসেবে প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্নতা কাজ করে। কোনো কোনো কবিকে ‘প্রকৃতির কবি’ও বলা হয়। যেমন ইংরেজি সাহিত্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০) ‘প্রকৃতির কবি’ হিসেবে চিহ্নিত। কেননা তাঁর কবিতায় সমগ্র জীবনানুভব প্রকৃতিকে অবলম্বন করে সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রকৃতির জীবন্ত ও আন্তরিক রূপ অন্যদের চেয়ে তাঁর কবিতায় অনেক বেশি প্রকাশিত। বাংলা কবিতা প্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতিলগ্ন। ‘চর্যাপদে’র অধিকাংশ পঙ্ক্তিই প্রকৃতি আশ্রিত। মধ্যযুগের বিশাল কাব্যজগৎ প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। আধুনিককালে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রসাহিত্যে। তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় প্রকৃতি। তাঁর অধিকাংশ কবিতা ও গান সরাসরি ঋতুসংক্রান্ত। তাছাড়া তাঁর ‘জীবনদেবতা’র উপলব্ধিও মুখ্যত প্রকৃতির ভিতর দিয়ে হয়েছে। এসব কারণে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) বাংলা সাহিত্যের কবিদের মধ্যে তাকেই ‘প্রকৃতির কবি’ হিসেবে প্রধান বলেছেন। এরপর বিশেষ অর্থে ‘প্রকৃতির কবি’ বলেছেন জীবনানন্দ দাশকে (১৮৯৯-১৯৫৬)। (দ্র. বুদ্ধদেব বসু, কালের পুতুল, ১৯৯৭) কারণ এ-জাতীয় কবি সমগ্র জীবনকে প্রকৃতির ভিতর দিয়ে গ্রহণ ও প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রযুগে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪), মোহিতলাল মজুমদারের (১৮৮৮-১৯৫২) কবিতায় প্রকৃতির উপস্থিতি আপনাপন ভঙ্গিতে অঙ্কিত। অন্যদিকে ‘পল্লীকবি’ হিসেবে খ্যাত কবিদের কাব্যে প্রকৃতির রঙ-রেখা-রূপ সামগ্রিক রূপকল্পে বর্ণিলরূপে চিত্রিত। বিশেষভাবে জসীমউদ্দীনের (১৯০৩-৭৬) কবিতায় প্রকৃতি ও প্রকৃতি আশ্রিত বাস্তব জীবনের শিল্পমন্ডিত প্রকাশ উল্লেখযোগ্য। তাঁর আঁকা প্রকৃতির সঙ্গে তিরিশোত্তর আধুনিক কবিগোষ্ঠীর অঙ্কিত প্রকৃতির সাদৃশ্য নেই। কেননা তিরিশোত্তর কবিরা প্রকৃতিকে নান্দনিক উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন; কিন্তু জসীমউদ্দীন প্রকৃতি বলতে সৌন্দর্য সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জীবন-জীবিকার বাস্তব ক্ষেত্ররূপে গ্রহণ করেন। নিসর্গ সম্বন্ধে ব্রিটিশ মতাদর্শ ঔপনিবেশিক বাংলায় অবিকল কাজ করেনি। বাংলার কিংবা বাংলাদেশের ইতিহাসে দু’টি কালের নির্দিষ্টতা আছে: প্রথমটি ব্রিটিশ, দ্বিতীয়টি পাকিস্তানি। সেজন্য ব্রিটেনের বিবর্তিত ইতিহাস এক্ষেত্রে কার্যকর নয়। ঔপনিবেশিক বাংলায় প্রকৃতির দুই স্বরূপই ক্রিয়াশীল। একটি হচ্ছে নৈতিক-নান্দনিক; অপরটি হচ্ছে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক। ঔপনিবেশিককালে শ্রেষ্ঠ নান্দনিক রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে দুই স্বরূপই কাজ করেছে; কিন্তু অধিকতর ক্ষমতা লাভ করেছে প্রথম স্বরূপটি। তিনি প্রকৃতিকে নীতিসম্পন্ন ও কামনাময় করেছেন, তার মধ্যে পুরাণকল্পের শক্তি খুঁজে পেয়েছেন এবং একই সঙ্গে বাস্তব অতিক্রমী বোধ যুক্ত করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি প্রকৃতির মধ্যে নান্দনিক এক বোধ আবিষ্কার করেছেন। (বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ, ১৯৯৯) কিন্তু বাংলায় তিনি প্রকৃতি ভয়ঙ্করভাবে সামাজিক এবং বাস্তব, জমি হচ্ছে ভাড়া খাটানোর বিষয়, ঋণগ্রস্ত হওয়ার ইতিহাস, ধান-পাট উৎপাদনের ক্ষেত্র এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার প্রক্রিয়া। সেজন্য রবীন্দ্রনাথের নান্দনিকতা কিংবা নিসর্গ থেকে উৎসারিত নান্দনিকতার প্রভাব ক্ষীণ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে প্রকৃতির নান্দনিক আদর্শায়িতকরণের সঙ্গে তাঁর সমাজবোধের দ্বন্দ্ব উপেক্ষা করার নয়। তিরিশের দশকে, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের উত্থানপর্বে তাঁর নান্দনিক বোধ কিংবা সাংস্কৃতিক বোধ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়; বিপরীতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে সংস্কৃতির সমাজবোধ। এই বোধটাই চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে জয়নুল আবেদীন (১৯১৪-৭৬), এস. এম. সুলতান (১৯২৩-৯৪) এবং কামরুল হাসানের (১৯২১-৮৮) কাজে সোচ্চার হয়েছে। কবিতায় জসীমউদ্দীন ও আল মাহমুদের কৃতিতে ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। ২. বাংলাদেশের আশির দশকের প্রধান কবি মতিউর রহমান মল্লিক (১৯৫৫-২০১০) একজন প্রকৃতিপ্রেমিক কবি। ফররুখ আহমদের মতো এই কবির জীবনাদর্শ ও কাব্যাদর্শ এবং জীবনাচরণ ছিলো একই রেখায় সমান্তরাল। কাব্যপ্রকাশে সবচেয়ে বড় অবলম্বন কবি প্রকৃতির নানা মাত্রিক ব্যঞ্জনায় সম্পন্ন করেছেন। প্রথম কাব্য ‘আবর্তিত তৃণলতা’ থেকে শেষ কাব্য ‘নিষণ পাখির নীড়ে’ পর্যন্ত সমগ্র কাব্যে নৈসর্গিক ব্যবহার কবিকে সবুজ বাংলাদেশের সঙ্গে একাকার করেছে। মাটিবর্তী কবি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়েছেন বিপুল ও বিস্তৃত প্রাকৃতিক প্রাণ সজীবতায় মগ্ন হয়ে। এই কবিকে আল মাহমুদ অভিহিত করেছেন ‘অন্তরালপরায়ণ কবি’ ও ‘কোলাহল বিমুখ কাব্যপ্রতিভা’। নাগরিক, প্রতিহিংসাপরায়ণ, প্রচারমুখী সাহিত্যসমাজে এ ধরনের কবি সুস্থভাবে বিকশিত হতে পারে না; তাকে তাই প্রকৃতির আড়াল ও নির্জনতার খোঁজ করতে হয়- নীরবে, নিভৃতে, আপন খেয়ালে কাব্যচর্চা করার জন্যে। কবিতার স্রোত গতিশীল থাকে মূলত এই স্বভাবের কবিদের কৃতিতে। অর্থাৎ ‘সাহিত্যের প্রাণশক্তি’ এইসব কবিই- যাদের কাব্যজীবন ও কাব্যসাধনা ব্যয় হয় কবিতার জন্যে। আবর্তিত তৃণলতার ‘রাঙা মাটির সন্ধ্যা’, ‘অপার্থিব সবুজ বাসীর কথা’, ‘একটি হৃদয়’, ‘কৃষ্ণচূড়া’, ‘গাছ সম্পর্কিত’, ‘নদী এক নদী’, ‘নদীর কাছে’, ‘সৌন্দর্য সামলানোর ক্ষমতা’, ‘ক্রমাগত’; অনবরত বৃক্ষের গানের ‘বোরকাধারয়িতা ও দারুবৃক্ষের স্তোত্র’, ‘হেমন্ত দিন’, ‘তুলনা’, ‘কবিতার ধ্রুব’, ‘কাশ-শিউলির সময়’, ‘ঋতুর স্বভাব’, ‘আর এক সূর্যের গান’, ‘বিলের দিকে’; তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা-র ‘বৃক্ষের নামতা’, ‘অন্য বৈশাখ’, ‘টুকরো কবিতা’, ‘শুধু যাবো আর আসবো’; চিত্রল প্রজাপতি-র ‘বৃষ্টিরা’, ‘বৃক্ষ এবং মানুষ’, ‘তুমি একটা নদীই’, ‘মৃত্তিকা অথবা আভিজাত্য’, ‘পাতার বৃত্তান্ত’, ‘মুখোমুখি’, ‘শীতের লিমেরিক’; নিষণ পাখির নীড়ের ‘প্রকৃতি ও ব্যথার কবিতা’, ‘বাগেরহাটের সারাবেলা’, ‘তোমাকে নিয়ে’, ‘সিডর’ কবিতাবলি প্রকৃতিকেন্দ্রিক। প্রথমত: সৌন্দর্যবাদী রূপে; দ্বিতীয়ত: দার্শনিক দৃষ্টিতে; তৃতীয়ত: স্বাদেশিক বোধে; চতুর্থত: অলঙ্কার হিসেবে। ক কবি মাত্রই সৌন্দর্যপিয়াসী মনের অধিকারী। প্রাকৃতিক সুন্দরে অবগাহন করে কবি আনন্দ লাভ করেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিক একইভাবে সৌন্দর্যের জগতে বিচরণ করে তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। আশৈশব বাগেরহাটের সবুজ ও দিগন্ত বিস্তারি নিসর্গ কবিকে মুগ্ধ ও আত্মভোলা করে দিয়েছে। প্রকৃতির সীমাহীন লোকে অবাধ সাঁতার ব্যক্তি থেকে কবিতে রূপান্তিরিত করে মতিউর রহমান মল্লিককে। সুন্দরবন ও সমুদ্র ঘেঁষা শ্যামলিমায় ডুবসাঁতার দিয়ে ডুবুরির মতো আহরণ করেছেন সৌন্দর্যের মণিমুক্তা, হীরাজহরত। প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান সৌন্দর্য, দর্শন ও সত্য কবিকে মুগ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি। কাব্যগ্রন্থের নাম দেখেই অনুভব করা যায় তাঁর প্রকৃতিবাদিতা: আবর্তিত তৃণলতা, অনবরত বৃক্ষের গান, চিত্রল প্রজাপতি ও নিষণœ পাখির নীড়ে। কবির প্রকৃতিচেতনার মূলে কাজ করেছে বাগেরহাটের সবুজ শ্যামলিমায় শৈশব ও কৈশোরকালীন অভিজ্ঞতা এবং সমগ্র বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতিতে ভ্রমণের স্মৃতি। ফলে প্রাকৃতিক পটভূমি তাঁর কবিতাকে অধিকার করেছে তীব্রভাবে; আর সেখানেই তিনি সুন্দরের পঙ্ক্তিমালা সৃজন করেন। যেমন: পাথরের বুক চুয়ে গড়িয়ে পড়া সুবোধ ঝর্ণা থেকে ধ্বনি মন্থন করতে দাও আমাকে ডুবতে দাও নিমজ্জিত হতে দাও- একসময় এমন হলো যে হৃদয়ের ধরন ধারণ সীমাবদ্ধ হতে লাগলো পাহাড়ের পায়ের কাছে দাঁড়িয়েও চোখ পর্যন্ত তুলতে পারলাম না শ্রবণ সে কোনো কিছুই শুনলো না অসমতলের সবুজাভ সুউচ্চ অহংকার অরণ্যের গন্ধে ডুবে যেতে লাগলো অবিরাম ডুবে যেতে লাগলো অথচ সমতলের কারো সৌন্দর্য সামলোনোর ক্ষমতা কতটুকু আর। (‘সৌন্দর্য সামলোনোর ক্ষমতা’, আবর্তিত তৃণলতা) নাগরিক জীবনের গ্লানি, অবসাদ ও কর্মব্যস্ততার বিপরীতে কবি নীরবতা, নির্জনতা ও সৌন্দর্যের অতলান্তিক মর্মরে আনন্দ, প্রশান্তি ও সুখ অনুভব করেছেন। এক ধরনের নান্দনিক দৃষ্টি সব সময় কবির মধ্যে বিরাজমান। এই দৃষ্টিতে প্রকৃতি দেখার মধ্যে করি নন্দনবোধের পরিচয় বিধৃত। খ কবি প্রকৃতির মাঝে জীবন ও জগতের বিবিধ জিজ্ঞাসা অনুসন্ধান করেছেন। বিশেষভাবে বৃক্ষের মধ্যে কবি জীবনের নানা উপমা এবং কখনো জীবনের সমগ্রতা দেখতে পেয়েছেন। গাছের ক্রমাগত বিকাশ, নদীর বহতা ও বাঁক, সমুদ্রের গভীরতা ও বিশালতা, অরণ্যের রহস্যময়তা, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের সবুজ সজীবতা ও শস্যসম্ভার, ঋতু পরিক্রমা, পাহাড়ের গহিনতা ও রহস্যের মধ্যে কবি দার্শনিক প্রত্যয় খুঁজে ফেরেন। বিশ্বাসে সমর্পিত কবি মনে করেন এই বিশাল নিসর্গ মহান সৃষ্টিকর্তার মহানির্মাণ। সেজন্য কবি বারবার ফিরে আসেন প্রকৃতির কাছে জীবনের বাঁকে বাঁকে। একটি বৃক্ষের সমস্ত শরীর জুড়েই হাঁ-হাঁ মূলত এখন তোমার বারবারই বৃক্ষের নামতা পড়া দরকার। (‘বৃক্ষের নামতা’, তোমার ভাষায় তীক্ষè ছোরা) কবি বৃক্ষের মাঝে জীবনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছেন। জীবনের পূর্ণতার জন্য, বাঁকবদলের জন্য, গভীর জিজ্ঞাসার জন্য কবি গাছের বিকাশধারা, ফলের সমাহার এবং বীজের বিন্যাসের দিকে বারবার অবলোকন করেছেন। প্রকৃতির নানান প্রসঙ্গের মাঝে কবি জীবনের ভাবনা, দৃষ্টি ও গভীরতা অনুভব করেন। গ কবির প্রকৃতিচেতনায় মূলত শ্যামল বাংলাদেশ প্রতিবিম্বিত। বিশেষভাবে দক্ষিণ বাংলার সবুজাভ নিসর্গ বাক্সময় হয়ে উঠেছে। বৃক্ষ, নদী, পাখি, সাগর, বৃষ্টি তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ। এক্ষেত্রে কবির প্রকৃতিপ্রেম ও দেশপ্রেম ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। তিনি অন্য কোনো দেশের নয়, বাংলাদেশের নিসর্গ ভালোবেসে কাব্যে ধারণ ও অঙ্কন করেন। সেদিক থেকে তাকে দেশপ্রেমিকরূপে চিহ্নিত করা যায় সহজে। কবি শুধু স্বদেশের গ্রামীণ নিসর্গপ্রীতির পরিচয় দেননি। প্রকৃতিলগ্ন মানুষের কথাও বলেছেন। তবে গ্রামীণ মানুষের কথা জসীমউদ্দীন বা আল মাহমুদ যেভাবে এঁকেছেন, সেভাবে মতিউর রহমান মল্লিক আঁকেননি। বরং তিনি নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষের কথকতা দরদ সহকারে রূপায়িত করেছেন। প্রকৃত অর্থে তাঁর স্বাদেশিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নিসর্গচেতনায়। শুধু ফিঙে কেন? হলদে কুটুমও… ওড়ে! আশেপাশে ঘোরে মৌমাছিদের… সুর ফসলের আলে ওই দিকে চাষিরাও তরল শরৎ হাতে পায়ে… মাখা সুখ খোসা পাল্টায় হাওয়ার অতণু গা অতণু গায়ের ওপরে হালকা ‘কাল’ কালের ভেতরে আমার জন্মভূমি শরতের মত প্রথম প্রেমের গান। (‘কাশ-শিউলীর সময়’, অনবরত বৃক্ষের গান) কবি একইভাবে অন্যান্য কাব্যে প্রকৃতির উপকরণে স্বদেশপ্রেমের মহিমা গেয়েছেন। আসলে কবির স্বদেশ একদম সবুজিয়া শ্যামলিমায় ঢাকা প্রকৃতির বিস্তৃত প্রান্তর। অনেক জায়গায় কবির আঁকা প্রকৃতি আর স্বদেশ অভিন্ন। ঘ মতিউর রহমান মল্লিকের অধিকাংশ কবিতায় অলঙ্কার হিসেবে নিসর্গের ব্যবহার লক্ষণীয়। উপমা, রূপক, প্রতীক, উৎপ্রেক্ষা বা চিত্রকল্প সৃষ্টিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে বাংলদেশের নৈসর্গিক উপাদান। ‘আবর্তিত তৃণলতা’র ‘একটি হৃদয়’ কবিতায় হৃদয়ের উপমা দিতে কবি বিস্তীর্ণ প্রকৃতির মাঝে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। উপমা সংগ্রহে কবির ‘প্রকৃতিপ্রেমিক’ সত্তার পরিচয় মেলে। একটি হৃদয় কলির মত, ওলীর মত, মেঘনা নদীর পলির মত। পাখ-পাখালীর উধাও উধাও ক্লান্ত প্রহর, উথাল পাথাল ধানসিঁড়ি ঢেউ নিটোল নহর, সবুজ খামার সহাওয়ার খেলায় সুরের বহর; একটি হৃদয় লতার মত, লজ্জাবতীর পাতার মত, অনেক কথকতার মত। (‘একটি হদয়’, আবর্তিত তৃণলতা) উত্তরজীবনের কাব্যে এই ধরনের প্রাকৃতিক চিত্রকল্পের ব্যবহার বহুলভাবে ব্যহৃত হয়েছে। জীবন জিজ্ঞাসা, উজ্জীবন, আন্দোলন-সংগ্রাম, আনন্দ-সুখ-বিরহ, বিপ্লবের সম্ভাবনা নির্মাণে কবি বারবার প্রকৃতির আশ্রয়ে ফিরে গেছেন। জীবনের সমুদয় ভাব, ভাবনা ও নির্মিতির ক্ষেত্রে তাঁর প্রকৃতি নির্ভরতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ৩ মতিউর রহমান মল্লিক একজন প্রকৃতি নিমজ্জিত কবি। জীবনের সব ক্ষেত্রে কবি প্রকৃতির বিস্তৃত জগৎ থেকে আহরণ করেছেন প্রয়োজনীয় উপাদান। অনেক কবিতা আছে যেখানে কবি সম্পূর্ণভাবে নিসর্গ সমর্পিত। নিসর্গ অবলম্বন কবির মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি বিনাশী বা ধ্বংসের রূপও এঁকেছেন। সৌন্দর্যবাদী রূপে, দার্শনিক দৃষ্টিতে, স্বাদেশিক বোধে ও অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহারে উপলব্ধি করা যায় কবি প্রকৃতির পরম আত্মীয়। কবিকে ‘প্রকৃতির কবি’ বললে বেশি বলা হয় না। কারণ কবির অধিকাংশ কবিতাই প্রকৃতিলগ্ন।