বসন্ত আসে প্রকৃতির রাণী হয়ে। বাহারি সাজে তাঁর আগমন। রঙিন ফুলের ফুটন্ত পাপড়ি আর কোকিলের কুহু ডাকে মনে প্রেম জাগাতে বসন্তের জুড়ি মেলা ভার। এই বসন্ত জন্ম দিয়েছে কত কবি আর সুরের! বসন্তের হাজারো ফুলের মধ্যে পলাশ কারো মন কাড়েনি এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেনা। প্রেয়সি মন না কাড়লেও পলাশের সৌন্দর্য মন কাড়তে বাধ্য। গুচ্ছ ভর্তি ফুটন্ত পলাশের চূড়ায় বসে যখন কোকিল ডাকে মনে হবে স্বর্গীয় সুরের মূর্ছনা। যান্ত্রিক শহরের ক্লান্তি নিমিষেই প্রশান্তিতে রূপ নেবে। শুধু কি বসন্তের কোকিল এই পলাশের প্রেমে পড়ে? তা কি করে হয়। লম্বা লেজের সবুজ টিয়ারও দর্শন মেলে পলাশ চূড়ায়। পাখিদের মত মানুষের মন ও পলাশের প্রেমে পড়ে। কবি নজরুল তাঁর গানে লিখেছেন ‘হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল এনে দে এনে দে নইলে বাঁধব না, বাঁধব না চুল…’পলাশ ফুলের রুপ আর গুণের কমতি নেই। দেশাত্মবোধক একটি গানেও উল্লেখ পাওয়া যায় পলাশের। আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটি পলাশ ফুলের মালা… সেই বিখ্যাত গানের চড়ন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতা আর গানেও পলাশ ফুলের উল্লেখ আছে। যেমন – দোলের গান, ওরে গৃহবাসীতে ‘রাঙা হাসি রাশি রাশি, অশোকে পলাশে’ বা ফাগুন হাওয়ায় হওয়ায় গানে ‘তোমার অশোকে কিংশুকে, অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে’। পলাশ মাঝারি আকারের পত্রঝরা বৃক্ষ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ইঁঃবধ সড়হড়ংঢ়বৎসধ। বৃক্ষটি ঋধনধপবধব পরিবারের সদস্য। তবে পলাশ গাছ তার ফুলের জন্যই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সাধারণত ৮-১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। গাছের গোড়ার বাকল ফাটা হলেও আঁকাবাঁকা শাখা-প্রশাখার বাকল মসৃণ। একটি বোঁটায় তিনটি পাতা থাকে এবং আকারে অবিকল পারিজাত বা মাদার পাতার বড় সংস্করণ। ফাগুনে যখন গাছের সব পাতা ঝরে যায় তখনি পলাশের ফুলের কুঁড়ি আসা শুরু হয়। যখন ফুল ফুটা শুরু হয় মনে হবে আগুন লেগেছে বনে। তাইতো পলাশের অপর নাম আরণ্যের অগ্নি শিখা। বহুদূর থেকে দেখে মনে হবে একগুচ্ছ অবাধ্য আগুনের ফুলকি সব ধ্বংস করে আকাশে উড়তে চাচ্ছে। পলাশের সৌন্দর্যের বর্ণনায় হয়তো দিনরাত ফুরিয়ে ভোর হবে, মহাকাব্য রচিত হবে। কিন্তু বর্ণনা শেষ হবে না। পলাশের সৌন্দর্য ছাড়াও আছে ঔষধি গুণ। পলাশে ফলও হয়। পলাশ ফল দেখতে ছোট শিমের মতো। লম্বায় ২-৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। পলাশ আমাদের দেশজ তরু। পলাশের শুধু রুপ নয়, আছে ওষধি গুণ। পলাশ ফুল বসন্ত ঋতুতে অর্থাৎ ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে দেখতে পাওয়া যায়। এটি মাঝারি আকারের পর্ণমোচী বৃক্ষ। গাছটি সর্বোচ্চ ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। এটি থোকায় ফুল ফোটে। পলাশ ফুল ২ থেকে ৪ সেঃ মিঃ লম্বা হয়। কুঁড়িগুলো দেখতে অনেকটা বাঘের নখের মতো। শাখা-প্রশাখাগুলো আঁকাবাঁকা। নতুন পাতা রেশমের মতো সূক্ষ্ম। শীত মৌসুমে গাছের সব পাতা ঝরে যায় এবং গ্রীষ্মের ছোয়ায় নতুন পাতা গজাতে শুরু করে। ফুল ফোটার সময় গাছ থাকে পাতাশূন্য। দূর থেকে দেখে মনে হয় গাছে আগুন লেগেছে। গাছের আগুনরাঙা পলাশের রূপ কার না ভালো লাগে! দূর থেকেও মানুষের নজর কাড়ে। পলাশের নেশা তীব্র, পলাশ ফুল সবার মনে একবার হলেও দোলা দিয়েছে। তার ফুলের প্রেমের জালে জড়ায়নি হয়তো এমন কেউ খুজে পাওয়া দুস্কর। বসন্তে ফোটা পলাশ বনে ঘোর লাগে। তবে বড় ক্ষণস্থায়ী পলাশের মৌসুম। মাত্র ২০-২৫ দিন। তার নেশা লাগতে লাগতে, চিনে নিতে নিতে সে উধাও হয়ে যায়। যৌবনের উন্মাদনার মতো ক্ষণস্থায়ী। তবে এই ক্ষণস্থায়ী সুখ চলে গেলেও স্মৃতি থেকে যায় পুরো বছর। সেই স্মৃতি নিয়ে আমরা অপেক্ষায় থাকি অন্য বসন্তেরৃ। বসন্ত মানেই ফুলের সমারোহ আর ফুল মানেই রঙের মিলন মেলা। এইতো প্রকৃতি এখন পেয়েছে বসন্তের ছোঁয়া। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সবাই সাদরে বরণ করেছে ঋতুরাজ বসন্তকে। আর প্রকৃতিতে আগুন ঝরা পলাশ ফুল জানান দিচ্ছে বসন্ত চলছে। এই সময় পলাশ ফুলের সুন্দর্য দূর থেকেই আগুনের মতো জলতে দেখা যায়। ফুলের মেলায় পাখির কলতানে মুখরিত চারিদিক। বসন্ত এলেই সবার মনের মাঝে দোলা দেয় বসন্ত ফুল। এ যেন বসন্তে পলাশের রাজত্ব। বাংলার গ্রামে ও শহরে প্রায় সব জায়গায় কম-বেশি পলাশ ফুল দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামে পলাশ গাছের নিচে শিশুরা ফুল দিয়ে খেলা করে থাকে। শিশুরা একে অপরের কানে ফুল দিয়ে দেয়। গ্রামবাংলার এই দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। তিন প্রকার রঙের পলাশের মধ্যে হলুদ পলাশের জন্ম ভারতবর্ষে। গাছটি খুব কষ্ট সইতে পারে। রুক্ষ ও শুষ্ক মাটিতেও পলাশ বিনা যতেœ ফুল দেয়। গাছের বীজ দিয়ে নতুন চারা তৈরি করা যায়। তাই গাছটি থেকে বীজ সংগ্রহ করে দেশের সব উদ্যানে, পর্যটন কেন্দ্রে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ।