অষ্টম শতকে পাল রাজা ধর্মপাল (৭৭০-৮১০) যেসব বৌদ্ধ মঠ তৈরি করেন, এর মধ্যে অন্যতম হলো ওদন্তপুরী বা ওদন্তপুরা বৌদ্ধ বিহার। পাল আমলের প্রধান পাঁচ বিহারের একটি ছিল ওদন্তপুরী। বাকিগুলো হলো বিক্রমশীলা, নালন্দা, সোমপুর এবং জগদ্দল মহাবিহার। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই পরিচালিত হতো বিহার রাজার তত্ত্বাবধানে। প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল একটি চেইনের অংশ। পরস্পরের সাথে যোগাযোগ ও বিনিময় ছিল পরস্পরের। বিহারগুলো কালের ব্যবধানে ধ্বংসের শিকার হয়। ওদন্তপুরীও টিকে থাকেনি। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাপিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ একটি সঙ্কলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে ওদন্তপুরী বৌদ্ধ বিহার নিয়ে রয়েছে ক্ষীণাঙ্গী এক রচনা। লিখেছেন নাসরীন আখতার। নাসরীন এ বিহারের গ্রন্থ পোড়ানোর জন্য বখতিয়ার খিলজিকে (ওফাত: ১২০৬ সাল) দায়ী করেন। পাঠ্যপুস্তকেও বখতিয়ারের লাইব্রেরি ধ্বংসের প্রসঙ্গ এসেছে। সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় বখতিয়ারকে উপস্থাপন করা হয়েছে বেশ কয়েকটি লাইব্রেরি ধ্বংসকারী হিসেবে। কিন্তু এ বক্তব্য অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর। বস্তুত একটি লাইব্রেরিও ধ্বংসের ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
বখতিয়ার খিলজির বিজয় থেকে শুরু করে ১২৫৯ সাল পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস হলো তবকাত-ই-নাসিরি। তার লাইব্রেরি ধ্বংসের সব বিবরণ দিন শেষে তাবাকাতে নাসিরিকে ভিত্তি করে দাঁড়ায়। তাবাকাতের লেখক মিনহাজ উস সিরাজ জুরজানি (জন্ম: ১১৯৩)। তার পূর্ণ নাম আবু উসমান মিনহাজউদ্দিন বিন সিরাজউদ্দিন। ত্রয়োদশ শতকের অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক ছিলেন তিনি। ঘুরি সালতানাতের রাজধানী ফিরোজকোহে তার জন্ম। তার পিতা ছিলেন ঘোরি রাষ্ট্রের বিচারপতি। ৩৪ বছর বয়সে মিনহাজ মুলতানে নাসিরুদ্দীন কুবাচার (শাসনামল: ১২০৩-১২২৮) দরবারে যোগ দেন। ওই শহরে তিনি বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। কুবাচা অচিরেই পরাজিত হন শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ (শাসনামল: ১২১১-১২৩৬) এর কাছে। ইলতুৎমিশ দিল্লির অধীন করে নেন মুলতানকে। মিনহাজ উস সিরাজকে তিনি নিয়ে আসেন দিল্লিতে। এখানে তিনি বিচারকের দায়িত্ব লাভ করেন, প্রধান মাদরাসার অধ্যক্ষ হন এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সদরে জাহান পদে বরিত হন।
সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের (শাসনামল: ১২৪৬-১২৬৬) প্রশাসনে দায়িত্বরত অবস্থায় দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি তাবাকাতে নাসিরী রচনা শুরু করেন। তিনি বাংলায়ও অবস্থান করেন দুই বছর। এখানকার ইতিহাস রচনার জন্য গ্রহণ করেন তথ্য-উপাত্ত। এখানকার রাজনৈতিক ঘটনাচক্রের সাথে তার ছিল গভীর সংযোগ। বখতিয়ারের নদীয়া জয় ও তার পরবর্তী ঘটনাচক্র তিনি উল্লেখ করেছেন নানা সূত্রে। ১২৬০ সালে (৬৫৮ হি.) রচিত এ গ্রন্থে রয়েছে ২২টি তবকা বা অধ্যায়। ২০তম অধ্যায়ে আছে মুইজ্জিয়া সুলতানদের বিবরণ। এতে আছে আট সুলতানের আলোচনা। তারা হলেন সুলতান কুতুবুদ্দীন আল মুঈজ্জি, কুতুবুদ্দীনের পুত্র আরাম শাহ, মালিক নাসিরুদ্দীন কাবাচা, বাহাউদ্দীন তুগরিল আল মুইজ্জি এবং তারপর মালিকুল গাজী (ইখতিয়ারুদ্দীন) মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি। অন্য সুলতানরা হলেন বখতিয়ারের সঙ্গী শিরান খিলজি, আলী মর্দান খিলজি ও ইওয়াজ খিলজি।
বখতিয়ার খিলজির আলোচনায় এসেছে বিহারের একটি দুর্গে তার অভিযানের কথা, যেখানে যুদ্ধ শেষে দেখা যায় অনেক বই। মিনহাজুস সিরাজ লিখেন, ‘বিশ্বস্ত ব্যক্তিগণ বর্ণনা করেছেন যে, দুই শত সশস্ত্র অশ্বারোহী সৈন্যসহ তিনি কিল্লায়ে বিহার (বিহার দুর্গ) এর দিকে যাত্রা করেন এবং সহসা আক্রমণ করেন। তনুরায়ে দরওয়াজা বা দুর্গের প্রধান ফটকে উপস্থিত হয়ে তিনি প্রবল আক্রমণ করেন। স্বীয় শক্তি ও সাহসের বলে বখতিয়ার প্রধান ফটক ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করলে তার সৈন্যরা দুর্গ অধিকার করে এবং অনেক মালে গণিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) হস্তগত করে। এখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দা ছিলেন বারহ¤œান বা ব্রাক্ষণ। তাদের মস্তক ছিল মু-িত। তাদের সবাইকেই হত্যা করা হয়েছিল। সেখানে ছিল অনেক গ্রন্থ। বহুসংখ্যক গ্রন্থ যখন মুসলমানদের চোখে পড়ল, তখন উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে গ্রন্থের মর্মোদ্ধারের জন্য আহ্বান করা হলো। পুস্তকের মর্মোদ্ধার করে জানা গেল, সমগ্র নগর ও দুর্গ নিয়ে এটি ছিল একটি মাদরাসা; বিদ্যালয়।’
এই হলো মিনহাজুস সিরাজের বিবরণ। প্রসঙ্গ এখানেই শেষ। গ্রন্থের পাঠোদ্ধার অবধি। তার পরের কোনো বিবরণ নেই। বইগুলো যখন তাদের চোখে পড়ল, তারা থেমে গেলেন। বুঝতে চাইলেন বইগুলোর রহস্য কী? যুদ্ধপরিস্থিতিতেও এর পাঠোদ্ধার করালেন। এর মানে কী? এর মানে বইয়ের গুরুত্ব তাদের কাছে ছিল, ছিল সম্মান। নতুবা বর্বরদের মতো বইকে পাত্তা না দিয়ে ধ্বংস করতেন। বইয়ের পাঠোদ্ধার শেষে তারা আবিষ্কার করলেন যাকে দুর্গ ভেবেছেন, তা আসলে বিহার, বিদ্যালয়। এর পরে অভিযান শেষ। বর্ণনাও শেষ। বিহার ধ্বংস করা হয়েছে, এরও উল্লেখ এখানে নেই, একটি বইয়ের একটি পাতাও ছেঁড়া হয়েছে, এমন প্রমাণও নেই এখানে। কেবল ন্যাড়ামাথার যেসব লোক (প্রতিরোধকারী) দুর্গে ছিল, তাদেরকে হত্যার বিবরণ আছে।
মিনহাজুস সিরাজ দুই ব্যক্তির কাছ থেকে ঘটনাটি শুনেছেন। তারা হলেন ফারগানা রাজ্যের দুই বিজ্ঞ ভাই; নিজাম উদ্দীন ও শামসামুদ্দীন। তারা বখতিয়ার এর প্রশাসনে নিযুক্ত ছিলেন। ঘটনার প্রায় ৪০ বছর পরে (৬৬১ হিজরিতে) লাখনৌতিতে তাদের সাথে মিনহাজুস সিরাজের দেখা হয়। সেখানে তারা তাকে ঘটনাটি শুনান। ঘটনা বর্ণনায় তারা কিছু ভুল করেন। যেমন দুর্গের অধিবাসীদেরকে তারা ন্যাড়ামাথার ব্রাহ্মণ বলে আখ্যা দেন। আসলে তারা ছিলেন বৌদ্ধ। হিন্দুদের বিদ্যালয়কে বিহার বলে অভিহিত করেন, আসলে বিহার হলো বৌদ্ধদের উপাসনালয় ও বিদ্যালয়। মিনহাজ এই ঘটনা বর্ণনা করেন এই ভুলসহ। মিনহাজের বিবরণে আমরা পাচ্ছি ‘কিলআয়ে বিহার’ এর উল্লেখ, যেখানে বখতিয়ার অভিযান পরিচালনা করেন।
কিলআ বা কিল্লায়ে বিহার মানে বিহারের সেনানিবাস। এই কথাটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ লিখেছেন সেটা মূলত ছিল ওদন্তপুরী মঠ। বখতিয়ার ওদন্তপুরীকে শত্রুদের সেনাশিবির মনে করেন। এর মানে ওদন্তপুরী মঠে বখতিয়ার অভিযান করেছেন, এটা মিনহাজ বলেননি, তিনি বলেছেন বিহারের কেল্লা বা দুর্গে অভিযানের কথা, একে ব্যাখ্যাকাররা ধরে নিচ্ছেন ওদন্তপুরী মঠ। যেহেতু মিনহাজ তবকাতের আগের খ-ে উদন্দপুর জয়ের কথা বলেছেন এবং ১৬০৮ সালে ঐতিহাসিক লামাতারানাথ (১৫৭৫-১৬৩৪) তার History of Buddhism in India (Gya-gar-chos-byun) গ্রন্থে স্পষ্ট করেন যে, অভিযানের কবলে পড়া বিহারটি হলো ওদন্তপুরী। কালিকারঞ্জন কানোনগো (১৮৯৫-১৯৭২) রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) আবদুল করীম (১৯২৮-২০০৭) মোহর আলী (১৯২৯-২০০৭), রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটনসহ (১৯৪০-) ঐতিহাসিকরা একেই কবুল করেছেন।
বখতিয়ার এই বিহারকে সেনানিবাস মনে করেছিলেন ভুলবশত। কিন্তু কেন তিনি একে সেনানিবাস ভাবলেন? বস্তুত ওদন্তপুরী মঠকে সেনাশিবির মনে করার কারণ ছিল। লামা তারানাথ দিয়েছেন এর ব্যাখ্যা। তার মতে, খুব সম্ভবত দুর্গের প্রাচীর দেখে এবং সৈন্যের উপস্থিতির খবর শুনে বখতিয়ার একে সেনানিবাস ভেবেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন তখনকার বৌদ্ধ মঠগুলো সেনাশিবিরের আদলে বানানো হতো। এর প্রমাণ আমরা দেখব ওদন্তপুরীসহ অন্যান্য বিহারের ধ্বংসাবশেষেও। আমরা যদি শালবন বিহারটা লক্ষ করি, এর প্রমাণ পাব। এ বিহারে আছে কেন্দ্রীয় এক ম-প, যার চারদিকে ক্রুশ আকারে চারটি শাখা। ১৮৭ বর্গমিটার আয়তনের মধ্যে আছে ১৫৫টি কক্ষ। এতে মূল প্রবেশপথ মাত্র একটি। উত্তর দিকের ঠিক মধ্যবর্তী অংশে যার অবস্থান। প্রবেশপথের সামনের অংশ ২২.৬ মিটার প্রশস্ত, আর এর উভয় পাশে আছে বাইরের দিকে মুখ করা দুই প্রহরী ঘর। প্রবেশের পথে কড়া নিরাপত্তা। গোটা বিহারের দেয়ালগুলো আকারে অস্বাভাবিক রকমের সুদৃঢ় ও বিশাল। বিহারের সব দেয়াল বিশালায়তন ও ইট নির্মিত। পেছনের দেয়াল সবচেয়ে পুরু ও প্রশস্ত। এই দেয়াল দুর্ভেদ্য, সুউচ্চ ও পাঁচ মিটার পুরু। গোটা কাটামোটাই সুনিশ্চিতভাবে এক দুর্গের চিত্র হাজির করে। সেকালের সেনানিবাসগুলো যতটা সুরক্ষিত ও দুর্ভেদ্য হতো, এই মঠ ঠিক তেমনই। দিনাজপুরের সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারে একই চিত্র লক্ষ্য করব। সেখানে বিহারের চারদিকে আছে শক্তিশালী নিরাপত্তা প্রাচীর। প্রাচীরের চার দিকে আছে পরিখা। বিহারের উত্তর দিকে ঠিক মাঝামাঝিতে ছিল প্রধান ফটক। এর দক্ষিণ দিকে একটি মন্দির ছিল। এর গঠন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, চার দিকের পরিবেশ একে একটি দুর্গ হিসেবেই উপস্থাপন করে। ওদন্তপুর ছিল এসবের তুলনায় অধিকমাত্রায় দুর্গবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল দুর্গম, দুর্গের চার দিক ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আচ্ছাদিত, এর বাইরের প্রাচীর ছিল একেবারে সেনানিবাসের আদলে গড়া, দুর্গফটকে ছিল শক্ত প্রহরার ব্যবস্থা। কোনো কোনো গবেষক দাবি করেছেন, সেন রাজাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী গুপ্তচররা তুর্কি বাহিনীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ওদন্তপুরীতে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে। যেহেতু বিহারের পাল রাজারা ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। এর মাধ্যমে বখতিয়ারকে সেখানকার সীমানায় জটিল সঙ্ঘাতে ফেলে আটকে রাখার ইচ্ছে ছিল তাদের। বখতিয়ার ওদন্তপুরীর বাহ্যিক অবস্থা লক্ষ করে তাদের প্রচারে আস্থা রাখেন, একে সেনানিবাস হিসেবে বিশ্বাস করেন। ড. সুশীলা ম-ল তার বিখ্যাত History of Bengal: The middle age, 1200-1526 গ্রন্থে দেখিয়েছেন ওদন্তপুরী ছিল দুর্গম, সুরক্ষিত, শিখরস্থিত আশ্রম। এখানে স্বয়ং বিহার রাজা গোবিন্দপাল নিজের সৈন্যদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফলে বিহার জয়ের জন্য খিলজি রাজধানীর পরে এখানে আক্রমণ করেন। ফলে সৈন্যদের পাশাপাশি বৌদ্ধভিক্ষুরাও অস্ত্র ধারণ করেন। যুদ্ধে তারা পরাজিত হন এবং গোবিন্দ পাল দেব নিহত হন। এর মানে পরিস্থিতি এখানে অভিযানকে অনিবার্য করে তুলেছিল। পরাজিত রাজা রাজধানী থেকে পালিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন জেনে বখতিয়ার দুর্গের দিকে এগিয়ে আসেন। দুর্গ তাকে ফটক খুলে দেয়নি। ফলে যুদ্ধ হয়। তখনকার অভিযানসমূহের নিয়মই ছিল এমন। তবকাতের অনুবাদক আবুল কালাম জাকারিয়ার (১৯১৮-২০১৬) মতে, এখানে যে যুদ্ধ হয়ে থাকবে, তা সম্ভবত একপক্ষীয় ছিল না, এখানে প্রচ- প্রতিরোধ হয়েছিল, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও (১৮৮৫-১৯৩০) দিয়েছেন ওদন্তপুরীর প্রতিরোধের বিবরণ। তার মতে বখতিয়ারের বিরুদ্ধে এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সেনারা সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ করে। বিহার রাজার সেনারা এখানে এসে থাকবে চারদিক থেকে কোণঠাসা হবার ফলে। এখানে এসে তারা আশ্রয় নিয়ে থাকবে।
এর মানে পরিষ্কার। দুর্গের চরিত্রে পরিবেষ্টিত, দুর্গের আকৃতিতে তৈরি ও সজ্জিত মঠের ভেতরে প্রবেশ করতে প্রতিরোধের সম্মুখীন হন বখতিয়ার। ফলে যুদ্ধ হয়। তিনি জয়ী হন এবং ভেতরে প্রবেশ করে যখন দেখলেন বহু গ্রন্থ। তখন এর পাঠোদ্ধার করে বুঝতে পারলেন এটি জ্ঞানাগার, সেনানিবাস নয়। তিনি ভুল বুঝতে পারলেন।
কিন্তু কথা এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বখতিয়ার যে ওদন্তপুরী আক্রমণ করেছিলেন, এটাও সংশয়পরিকীর্ণ। ড. দীনেশচন্দ্র সরকার (১৯০৭-১৯৮৪) দেখিয়েছেন, ওদন্তপুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে। বিভিন্ন গবেষকের মতে, ১১৯১-৯৩ সময়কালে। কিন্তু বখতিয়ারের বঙ্গজয় এর পরের ঘটনা। বস্তুত মুসলিম বিজয়ের আগে বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধবিহারসমূহ প্রচ- প্রতিকূলতার কবলে ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্মমতায় বিহারগুলো এক ধরনের মৃত্যুদশায় উপনীত হয়েছিল। আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া লিখেন, ‘সে সময় ভারতের প্রায় সর্বত্র বৌদ্ধধর্ম এক রকম নিঃশেষ হয়ে আসছিল। বাংলাদেশে যে তখন বৌদ্ধধর্ম ছিল না, সেটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। যদিও মহারাজা লক্ষণ সেনের দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রদত্ত তর্পণদীঘি তাম্র শাসনের ভূমির সীমানা উল্লেখ করতে গিয়ে প্রদত্ত ভূমির একপ্রান্তে একটি বিহারের উল্লেখ দেখা যায়, সে বিহারটি আদতে পরিত্যক্ত বিহার ছিল কি না, বলা কঠিন। পরিত্যক্ত না হলেও তা যে নামেমাত্র ও একটি নিষ্প্রাণ বৌদ্ধবিহার ছিল, এ অনুমান যুক্তিসহ।
বর্তমান বিহার অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে সে সময় হয়তো বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব ছিল। নামেমাত্র রাজা হলেও পাল বংশের শেষ নৃপতি গোবিন্দ পালদেব অথবা পাল পালদেব একটি ক্ষুদ্রায়তনের রাজ্য নিয়ে কোনো রকমে টিকে ছিলেন বলে ধারণা করা যায়। তাদের প্রভাবেই হয়তো সে অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম কোনো রকমে টিকে ছিল ও আলোচ্য ওদন্তপুর বিহার বোধ হয় তাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। (তবকাত-ই-নাসিরি, মিনহাজ ই সিরাজ, আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি ঢাকা-১৯৮৩, পৃষ্ঠা-১৯)। মৃতপ্রায় এই বিহার একদা যদিও ছিল গৌরবের তুঙ্গে, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈরিতার অব্যাহত ছোবল যুগ যুগ ধরে তার প্রাণশক্তিকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। বিহারের শেষ পাল রাজারা এর গৌরবের স্মৃতিচিহ্নকেই ধরে রাখছিলেন তখন। বিজয়ী সেনাপতি বিহারের এক কোণে গিয়ে বইয়ের মোলাকাত লাভ করলেন, যা বিহারের দুর্দশাকেই ব্যক্ত করে।
আগেই বলেছি, বখতিয়ারের লাইব্রেরি ধ্বংসের গল্প আগাগোড়া মিনহাজের বয়ানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থে রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৮-১৯৮০) স্বীকার করেছেন, ‘খিলজির বাংলা জয় প্রশ্নে যত কাহিনী ও মতবাদ বাজারে চাউর আছে, সবই মিনহাজের ভাষ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ সম্পর্কে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় নাই।’ রিচার্ড এম ইটন (১৯৬১-২০১৩) লিখেন, ১২০৪ সালে মুহাম্মদ বখতিয়ারের সেন রাজধানী দখলের প্রায় সমসাময়িক একমাত্র বর্ণনা হচ্ছে মিনহাজের তবকাত-ই নাসিরি। ফলে সে বইটিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন ভালো বিষয়। কিন্তু বইয়ে যা নেই, তা বইয়ে আছে বলে দাবি করাটা বিভ্রান্তিকর। বইয়ে লাইব্রেরি ধ্বংসের কোনো তথ্য নেই। মিনহাজের ওপর ভর করে যারাই বখতিয়ারের লাইব্রেরি ধ্বংসের গল্প রটনা করেন, তারা হয় ভুল করেন, নয় সচেতনভাবে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।
লেখক : কবি, গবেষক,71.alhafij@gmail.com