আমার কাছে অতি সম্প্রতি তিনটি ভিডিও ক্লিপ এসেছে। এগুলোর একটি হলো চরম মুসলিম বিদ্বেষী ‘কাশ্মির ফাইলস’, ‘দি মোদি কোয়েশ্চেন’ এবং সর্বশেষ ভারতীয় হিন্দি ছবি ‘পাঠান’। দি মোদি কোয়েশ্চেন বানিয়েছে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা বিবিসি। এখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০০২ সাল থেকে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছেন। এই চেষ্টার অংশ হিসাবে গুজরাটে ২ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। আমি ছবিগুলো বার বার দেখছি এবং গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো নোট করছি। এগুলো ভালভাবে পড়া শেষ হলে এবং নোট করা শেষ হলে আমি এই তিনটি বিষয় নিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে বিস্তারিত লেখার আশা করছি। এই সাথে আরো অনেকগুলো পয়েন্ট আছে যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, সুপরিকল্পিতভাবে কাশ্মিরে মুসলমানদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সংখ্যালঘিষ্ঠতায় পরিণত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী চেষ্টা করা হচ্ছে। বিস্তারিত যখন লিখবো তখন সবগুলো ঘটনা জেনে আপনারা উদ্বেগে শিহরিত হয়ে উঠবেন। আজ এই বলে প্রসঙ্গটি শেষ করতে চাই যে, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে জনসভায় দিচ্ছেন, ‘ভারত মাতাকি জয়’, ‘হর হর মহাদেব’সহ আরো অনেক কট্টর হিন্দুত্ববাদী শ্লোগান। মহাদেব যে হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেবতা শিবের অপর নাম সেটা অনেকেই জানেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে, যখন হিন্দু ধর্ম তথা হিন্দুত্বের জয়গানে সমগ্র ভারত সয়লাব হয়ে গেছে তখন আমাদের দেশে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ শ্লোগান দিলে সেটিকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা মৌলবাদ হিসাবে অপবাদ দিয়ে থাকেন। আমি আরো বিস্মিত হয়েছি যখন দেখেছি যে, চট্টগ্রামের বিশাল জনসভায় একজন বক্তা যখন নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার শ্লোগান দিয়েছিলেন তখন ঐ দলের একজন সিনিয়র নেতা তৎক্ষণাৎ ঐ লাখ লোকের সামনে মাইক নিয়ে বলেন যে, একটু আগে যে শ্লোগানটি দেওয়া হলো, সেটি আমাদের দলের শ্লোগান নয়। এখানে শুধু এটুকু বলে রাখি যে, ঐ সভাটি কিন্তু আওয়ামী লীগের সভা ছিল না। যাই হোক, এখন একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি।
॥দুই॥
বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা সঠিক কি রূপ ধারণ করেছে সেটি সম্পর্কে অনেকের সম্যক ধারণা নাই। আমি সাধারণত হার্ড ফ্যাক্ট নিয়ে লিখি। সেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক তত্ত্ব নিয়ে খুব কম লিখি। কারণ বেশি তত্ত্ব আওড়ালে সাধারণ পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয়। তবুও আজকে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঠিক রূপ বর্ণনা করার জন্য আমাকে কিছুটা তত্ত্বের আশ্রয় নিতেই হবে। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র বর্ণনা করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি নামক থিংক ট্যাংক বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
গত মাসের শেষের দিকে সিপিডি একটি সেমিনার করেছিল। ইংরেজি পত্রিকাগুলো তার শিরোনাম দিয়েছিল, Authoritarian system block to institutional, regulatory development.. এই সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন দেশের নাম করা অর্থনীতিবিদরা। তারা অর্থনীতির কথা বলতে গিয়ে রাজনীতির কথাও বলেছেন। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মতামত দিয়েছেন যে, একাধিক পুঁজিবাদি গ্রুপ সরকারের নীতি বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা এই সুযোগ পাচ্ছে, কারণ দেশে এখন পর্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল দেখা যাচ্ছে না। আর যদি তেমন শক্তিশালী বিরোধী দল থেকেও থাকে, তাহলেও তারা তাদের শক্তি এমনভাবে দেখাতে পারছে না, যে-শক্তি দেখে সরকার এক তরফা পুঁজিবাদি অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্থ হয় এবং ক্ষান্ত হয়। তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, একটি প্রবল শক্তিশালী পুঁজিবাদি শ্রেণী রাষ্ট্রযন্ত্রকে বলতে গেলে পুরোপুরি দখল করে বসে আছে।
॥তিন॥
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন যে, স্বাধীনতার পর অর্পিত সম্পত্তি কব্জা করে সম্পদ গড়ে তোলা হয়। অন্য একটি গ্রুপ বিদেশী অর্থায়নে উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে অর্থ লুণ্ঠন করে বড়লোক হয়। এরপর পুঁজিবাজারে রীতিমত ডাকাতি করে এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের পাহাড় গড়ে তোলে। দেবপ্রিয় বলেন, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার কারণে ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদ মাথাচাড়া দিতে থাকে। তবে এর মধ্যেও ক্ষীণতম হলেও একটি আশার আলোক রশ্মি দেখা যাচ্ছে। এই পুঁজিবাদি শোষণের মধ্যেও এমন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠছে যারা অর্থবিত্তে সম্পদশালী না হলেও লুণ্ঠন ও কর্তৃত্ববাদের মুখোশ উন্মোচন করছে। এই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নাই বলে লুন্ঠনবাদি অর্থনীতি ও রাজনীতির কোনো পরিবর্তন সাধনে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তবে শোষণের একাধিক দানবরা যে ইতোমধ্যেই মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে সেটি তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের সিনিয়র গবেষক মির্জা এম হাসান বলেন যে, ১০/১৫ বছর আগেও পুঁজিবাদিরা পেছন থেকে সরকারের নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু এখন তারা আর পাদপ্রদীপের নিচে থাকতে রাজি নন। তারা এখন সামনে চলে এসেছেন। তারা রাজনীতিতে যোগদান করেছেন, সরকারি দল থেকে নমিনেশন নিয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়ে এমপিও হয়েছেন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তারা সরাসরি সরকারের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করছেন। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, ব্যবসায়ীরাই এখন বড় রাজনীতিবিদ। একটি সময় ছিল যখন রাজনীতিতে প্রমিনেন্স অর্জন করতেন পোড়খাওয়া কর্মীবৃন্দ। তাদের সামনে ছিল একটি ভিশন, ছিল একটি আদর্শ। সাধারণ কর্মী থেকে প্রথমে পোষ্টার মারা, চিকা মারা, মিছিল মিটিং অর্গানাইজ করা এবং কর্মী রিক্রুটমেন্ট তাদের প্রধান কাজ ছিল। এসব কাজ যে যত সফলভাবে করতে পেরেছেন, দলে তিনি তত বেশি সিনিয়র পজিশনে গিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় সিনিয়র হয়ে তারা নমিনেশন পেয়েছেন, এমপি হয়েছেন এবং মন্ত্রী হয়েছেন। এদের অনেকে ছিলেন এ্যাডভোকেট বা ব্যারিস্টার। কেউ কেউ স্কুল কলেজের শিক্ষকতা বা অধ্যাপনা ছেড়ে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন।
এর পরেই রাজনীতিতে শুরু হলো টাকার খেলা। নিঃস্বার্থ কর্মীরা ধন সম্পদের প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে পড়েন এবং রাজনীতির আকাশে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যান। তবে এদের মধ্যে যারা চালাক চতুর তারা রাতারাতি খোলস বদল করেন এবং অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানান।
ইন্টারনেট এবং বিশ^ায়ন তাদের এই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পেছনে অনেক অবদান রেখেছে। এরাই ব্যাংক খেয়ে ফেলেছেন। এরাই ঋণ খেলাপী হয়েছেন। এরাই লক্ষ লক্ষ এবং বছরান্তে লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এরা প্রথমে সুইজারল্যান্ডে তাদের পাচারকৃত টাকা রাখতেন। এরপর কালো টাকা রাখার জায়গা অনেক খুলে যায়। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম হয়। কানাডায় বেগমপাড়া হয়। আমেরিকায় রিয়ালস্টেটে ইনভেস্টমেন্ট হয় অথবা বাড়ি কেনা হয়। এমনকি দুবাইয়ের মতো জায়গাতেও হয় দালান কোঠা কেনা হয়, নাহয় ব্যবসাতে ইনভেস্ট করা হয়। সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোতে তাদের টাকা ওড়ে।
॥চার॥
সবচেয়ে দুঃখ, উদ্বেগ এবং হতাশার কারণ এই যে বিগত এক দশকেরও বেশি সময় এই নব্য পুঁজিপতি, এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ আমলা এবং অত্যন্ত উচ্চাভিলাসী পলিটিশিয়ানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি নেক্সাস বা গাটছড়া। এই নেক্সাস বা গাটছড়া বা জোট শুধু প্রশাসনের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করে না, তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও পেছন থেকে টেনে ধরে। এর আগে তাদের প্রভাবে একাধিক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তারপর সেই প্রকল্পের সমাপ্তির তারিখ একের পর এক পেছানো হয়। ফলে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। ইতোপূর্বে অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে, পাশের বাড়ি আসামের একটি সাঁকো করতে যত সময় ও টাকা ব্যয় হয় আমাদের দেশে তেমনি একটি সাঁকো করতে তার চেয়ে অন্তত ৩ গুণ বেশি ব্যয় হয় এবং ৩ গুণ সময় লাগে। এই অতিরিক্ত সময় ও ব্যয়ের সিংহভাগ ঐ লুণ্ঠনকারী নেক্সাস লুট করে নেয়।
॥পাঁচ॥
কয়েকটি ব্যাপার খুব বিস্ময়কর ও রহস্যময়। অন্তত ১০/১২ বছর হলো বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছিল। গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক শুরুর কিছুদিন পর থেকে অকস্মাৎ সেটি সরকারি খাতে ১০৫ টাকা এবং বাইরে ১১০ থেকে ১১২ টাকায় উন্নীত হয়। মাত্র ২/১ মাসের মধ্যে বিনিময় হার একলাফে ২০ থেকে ২৫ টাকা বৃদ্ধির নজির অতীতের ৫০ বছরেও শোনা যায়নি। অনেক কথাই বলার ছিল। কিন্তু এক লেখায় সবকিছু বলা সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ খাতে দেশটিকে এলএনজি নির্ভর করা হলো কেন? কার স্বার্থে? তারা কি কায়েমী স্বার্থবাদী নয়? বহুদিন তো বলা হলো বাংলাদেশ নাকি তেলের ওপর এবং গ্যাসের ওপর ভাসছে। তেলের কথা আর কেউ বিশ^াস করে না। কিন্তু গ্যাসের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন হলো এই যে, বিগত ২০ বছরে সরকার মাত্র ১৯টি কূপ খনন করলো কেন? বিশেষজ্ঞদের মতে অন্তত ৪০টি কূপ খনন করা উচিৎ ছিল। তাদের মতে ঐ এলএনজি নির্ভরতার সাথে গ্যাসের জোরদার অনুসন্ধান না করার মধ্যে একটি অশুভ সংযোগ রয়েছে। প্রথমেই বলেছি আজ সামান্য হলেও কিছুটা তাত্ত্বিক দিক আলোচনা করবো। যারা এই বিষয়টিতে আগ্রহী তারা কয়েকটি পরিভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া করুন। যেমন অলিগার্ক, ক্রনি ক্যাপিটাল, ইলেক্টোরাল অটোক্র্যাসি, ফ্যাসিজম ও অথোরটারিয়ানিজম ইত্যাদি। এইগুলো বাংলাদেশকে চতুর্দিক দিয়ে গ্রাস করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তো এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। যারা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দোহাই দেন তারা শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনীটি মনোযোগ দিয়ে পড়বেন। একেবারে যাকে বলে, রিড বিটুইন দি লাইনস। তাহলে দেখবেন, এই সম্পদের পাহাড় গড়া তথা পুঁজিবাদের উত্থান শেখ মুজিবের মোটেই কাম্য ছিল না। আমি এই বইটি একাধিকবার পড়েছি এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো মার্কার দিয়ে দাগিয়েছি। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন এই গ্রন্থটিতে বিধৃত হয়েছে। সর্বত্র দেখা যায়, সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য শেখ মুজিবের প্রবল বিশ^াস এবং আপ্রাণ প্রচেষ্টা। আমরা জানতাম, শেখ মুজিব কমিউনিস্ট ছিলেন না। কিন্তু ধনিক শ্রেণীর লুটপাট বন্ধের জন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা একাধিকবার বলেছেন। অন্তত ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব এমন কোনো লুটেরা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাননি যা আজকে বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে। (দৈনিক ইনকিলাবের সৌজন্যে) Email: journalist15@gmail.com