মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠনের ১০০ দিন পেরোতে না পেরোতেই আবারো সরকারে অস্থি’রতার গুঞ্জন উঠেছে। বিরোধী জোট পেরিকাতান ন্যাশনালের প্রধান শরিক দল পাসের প্রধান আব্দুল হাদি আওয়াং বলেছেন, যেকোনো সময় বর্তমান সরকার ভেঙে পড়তে পারে। সরকার পক্ষ হাদির এই কথাকে গুরুত্বহীন হিসেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তবে এর মধ্যে বিরোধী জোটের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা শুরু হয়েছে। মহিউদ্দিন দাবি করেছেন তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর হাদি আওয়াং দাবি করেছেন সরকার পতনের জন্য যেকোনো প্রচেষ্টা চালানোর অধিকার বিরোধী জোটের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম মাস চারেক আগে মালয়েশিয়ার শাসক সুলতানদের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে বৃহৎ জোট গঠনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সরকার তৈরির জন্য সম্ভব সব রকম উদ্যোগ নেন। তিনি পাকাতান হারাপানের সাথে উমনুর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনাল এবং সাবাহ ও সারওয়াকের আঞ্চলিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি করেন জোট সরকার গঠনের জন্য। সরকারে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব কারা করবেন সেটি দলগুলোর ফোরামে নির্ধারণ করা হয়। কোন দলের এমপিরা যাতে বিচ্ছিন্ন হতে না পারেন তার জন্য দলের সিদ্ধান্ত অমান্য বা দল থেকে বের হয়ে গেলে সংসদ সদস্য পদ হারানোর আইনও প্রণীত হয়। এসব আয়োজনে ধারণা করা হয়েছিল পাকাতান-বারিসান জোট সরকারের পতন ঘটানোর মতো নতুন কোনো ‘শেরাটন মুভ’ এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে যেকোনো পথে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা একটি চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। এ কারণে আগের বার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণের আগেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী পদে তিন দফা পরিবর্তন হয়। নতুন মেয়াদেও একই লক্ষণ দেখা দিচ্ছে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। ২০২২ সালের শেষার্ধে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যে ফলাফল আসে তার মধ্যেই এক ধরনের অস্থিরতার বীজ রোপিত ছিল বলে অনেকের ধারণা। এই নির্বাচনে পাকাতান হারাপান একক বৃহত্তম জোট হিসেবে আভির্ভূত হলেও তাদের আসন সংখ্যা আগের তুলনায় বেশ কমে যায়। আসন কমে যায় উমনুর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনালেরও। সে তুলনায় বিস্ময়করভাবে ভালো ফল করে আব্দুল হাদি আওয়াং-এর নেতৃত্বাধীন ইসলামিক দল পাস। তাদের আসন সংখ্যা ১৮ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯ এ। তাদের জোট অংশীদার হিসাবে বারাসাতুও মোটামুটি ভালো ফল করে। প্রধানত এই দুই দলের সমন্বয়ে গঠিত পেরিকাতান ন্যাশনাল মহিউদ্দিন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী করতে উমনু এমপিদের কাছ থেকে গোপন হলফনামা নিয়ে সরকার গঠনের তৎপরতা চালায়। কিন্তু মহিউদ্দিনের রাজার সাথে বিরোধ দেখা দিলে পেছনের দরজা দিয়ে সরকার গঠনে তার এই উদ্যোগ সফল হয়নি।
এ সময় মালয় সুলতানদের সভায় পাকাতান ও বারিসান জোট সরকার গঠনের উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানানো হয়। এ জোটের সাথে পরে সাবাহ ও সাবওয়াকের প্রধান দলগুলোও সংযুক্ত হয়। সংসদে এ সরকারের আস্থা ভোটে ১১২ জনের ন্যূনতম সমর্থন প্রয়োজনের স্থলে ১৪২ জন এমপির সমর্থন মিলে। তবে মুহিউদ্দিন ইয়াসিন ও আব্দুল হাদি আওয়াংরুর জোট আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনকে শুরু থেকে মেনে নিতে পারেননি। তারা সরকারের পতন ঘটানোর উদ্যোগ নেন শুরু থেকেই।
সরকারের ১০০ দিনের মেয়াদ পূর্তির সময়ে হাদি আওয়াংয়ের সরকারের যেকোনো সময় পতন ঘটার ঘোষণা এরই একটি অংশ বলে মনে হয়। মুহিউদ্দিন-হাদি ছাড়াও এই প্রচেষ্টার সাথে এক সময়ের আনোয়ারের সহযোগী ও এখনকার বারাসাতু নেতা আজমিন আলি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উমনু নেতা হিশামুদ্দিন হোসেন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরির যুগসূত্রতা রয়েছে বলে মনে করা হয়। যতদূর জানা যায়, মুহিউদ্দিন-হাদির পরিকল্পনা হলো উপপ্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদিকে প্রধানমন্ত্রী করার টোপ দিয়ে বারিসান ন্যাশনালকে সরকার থেকে বের করে আনা। বারিসান সরকার থেকে বেরিয়ে এলে জোটের অন্য অংশীদারদের সমর্থন পাওয়া যেতে পারে বলে পরিকল্পনাকারীরা মনে করেন। আনোয়ার সরকারের পতন ঘটানোর এই পরিকল্পনা এখনই পরিণত হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। আনোয়ারের সরকার প্রাথমিক ১০০ দিনে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ভিত্তি তৈরিতে যথেষ্ট কাজ করে গেছেন। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের সরকারের সময় রিংগিতের মান ও শেয়ার বাজারে যে অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল তার পরিবর্তন ঘটেছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা এখনো পুরোপুরি সফল না হলেও দাম বৃদ্ধির প্রবণতা এখন নেই। জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর প্রতীকী উদ্যোগ হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিম পুত্রজায়া লাইন ১৬ মার্চ খোলার দিন থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব ব্যবহারকারীর জন্য ভাড়া না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ধরনের আরো কিছু উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। তবে এর পাশাপাশি বিরোধী জোটের দলগুলো নৃতাত্ত্বিক সংবেদনশীলতাকে উসকে দিয়ে নির্বাচনে সাফল্য অর্জনের যে কৌশল হাতে নিয়েছিল সেটি রোধে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে সরকার এখনো সফল হয়নি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি হবে ছয়টি রাজ্যের আঞ্চলিক নির্বাচনে। আগামী আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে কেলানতান, তেরেঙ্গানু, কেদাহ, নেগেরি সেম্বিলান, সেলাঙ্গর ও পেনাং-রাজ্যে নির্বাচন হবার কথা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিনটি রাজ্যে বিরোধী জোটের সরকার রয়েছে। শেষোক্ত তিন রাজ্যে রয়েছে সরকারি জোটের সরকার। প্রথম তিনটি রাজ্য হলো মালয়প্রধান। এর মধ্যে কেলানতান ও তেরেঙ্গানুতে নিশ্চিতভাবে বিরোধী পক্ষের জয়ী হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে কেদাহতে একসময় পাকাতান হারাপানের সরকার ছিল। রাজ্যের চিফ মিনিস্টার ছিলেন ড. মাহাথির মোহাম্মদের পুত্র মুখরিজ মাহাথির। পাকাতানের ফেডারেল সরকারের পতন ঘটার পর সেখানেও পাকাতান সরকারের পতন ঘটে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে এই রাজ্যে পেরিকাতান প্রার্থীরা বেশি সাফল্য পেয়েছেন। পেরিকাতান ন্যাশনালে (পিএন) যোগ দিতে মুখরিজের দলের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে পিএন হাইকমান্ড।
প্রধানমন্ত্রীর আভাস অনুসারে সামনের রাজ্য নির্বাচন ক্ষমতাসীন জোট সরকারের দলগুলো একসাথে করলে পূর্বাঞ্চলীয় কেলানতান ও তেরেঙ্গানুতে সরকার গঠনের মতো না হলেও সরকার পক্ষের আসন সংখ্যা বাড়তে পারে। আর কেদাহতে সরকার গঠন করার মতো একটি অবস্থান সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ পেনাং সেলাঙ্গর ও নেগরি সেম্বিলানে ভালো করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা শুরু করেছে। মিশ্র জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য থাকা এই সব রাজ্যে সরকারের সাফল্য পাওয়া স্বাভাবিক। এর যে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে বিরোধী পক্ষের ফেডারেল পর্যায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা জোরালো হতে পারে। এদিকে মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। মুহিউদ্দিন তার পার্টি বেরসাতুর ঘুষের ২৩২.৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত (৫১.৪ মিলিয়ন ডলার) পেতে তার ক্ষমতার অপব্যবহারের চারটি এবং ১৯৫ মিলিয়ন রিংগিত (৪৩ মিলিয়ন ডলার) অর্থ পাচারের দুটি অভিযোগ এনেছে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি)।
কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন মালয় ঠিকাদারদের অর্থনৈতিক উদ্দীপনা কর্মসূচির বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এমএসিসি মুহিউদ্দিনকে তলব করার পরে এই অভিযোগগুলী আসে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জামিনে মুক্তি পাওয়ার আগে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে, মুহিউদ্দিনকে প্রতিটি দুর্নীতির অভিযোগের জন্য ২০ বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং অর্থ পাচারের প্রতিটি ঘটনার জন্য ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদ- ভোগ করতে হবে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব দেয়া মুহিউদ্দিন এখন অফিস ছাড়ার পর অভিযুক্ত দেশটির দ্বিতীয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অফিসে থাকা প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ওয়ানএমডিবি দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার জন্য ১২ বছরের কারাদ- ভোগ করছেন।
মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার প্রাক্কালে এই অভিযোগ আনা হয়। মুহিউদ্দিন সাংবাদিকদের কাছে তার গ্রেফতারকে ‘নিপীড়ন’ এবং আসন্ন রাজ্য নির্বাচনের আগে তার পেরিকাতান ন্যাশনাল (পিএন) বিরোধী জোটকে বাধা দেয়ার জন্য পরিকল্পিত একটি ‘বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই হিসেবে, অভিযোগগুলো এই বছরের রাজ্য নির্বাচনে রাজনৈতিক তাপ বাড়াতে পারে। আর এতে পেরিকাতান ন্যাশনাল জোটের দুই অংশীদার বারসাতু ও ইসলামিক দল পাস জাতিগত মালয় অস্থিরতার বিষয়ে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়বে। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের প্রচার হলো আনোয়ারের বহু-জাতিগত জোট মালয়েশিয়ার সমাজে মালয় বিশেষাধিকার এবং ইসলামের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে আগ্রহী।
আনোয়ারের জোট সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো সংখ্যাগুরু মালয়দের আস্থা অর্জন করা। আনোয়ারের নিজ দল পিকেআর এবং তার জোট পাকাতান হারাপান মালয় অধ্যুষিত অঞ্চলে ভালো করতে পারেনি। মালয়দের মধ্যে আনোয়ারের সমর্থন বেশি নয় বলে মনে করা হয়। যদিও ১৫তম সাধারণ নির্বাচনের পরে দ্বিতীয় মাসে পরিচালিত মারদেকা সেন্টারের একটি জরিপে সরকারের পক্ষে ইতিবাচক রেটিং পাওয়া যায়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এই জরিপ অনুসারে এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের রেটিং ছিল ৬৮ শতাংশ আর সরকারের অনুমোদন হার ছিল ৫৪ শতাংশ। তবে এই জরিপের তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হলো, ৬৭ শতাংশ জাতিগত ভারতীয়, ৬৫ শতাংশ জাতিগত চীনা, ৪২ শতাংশ মালয়দের কাছ থেকে সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। মারদেকা সেন্টারের সাম্প্রতিক এই জরিপে বোঝা যায়, জাতিগত মালয়রা বর্তমান সরকারকে কম সমর্থন করেন।
এক সময় সংখ্যাগুরু ৬৩ ভাগ জনগোষ্ঠী মালয়দের প্রতিনিধিত্বশীল প্রধান দুই দল ছিল উমনু এবং পাস। উমনু স্বাধীনতার পর থেকে মালয়েশিয়ার সরকারে নেতৃত্ব দিয়েছে। পাকাতান হারাপানের প্রথম সরকার গঠন পর্যন্ত উমনু ক্ষমতায় ছিল। অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং মাহাথিরের নেতৃত্বে বারাসাতু নামে নতুন দল গঠন করে বিরোধী পাকাতান হারাপানের সাথে নির্বাচন ও সরকার গঠনের পর মালয় দল হিসেবে সমর্থন উমনু ও বারাসাতুর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এ বিভক্তিতে অন্য মালয় দল পাস মালয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক সমর্থন তৈরিতে সক্ষম হয়। বিগত নির্বাচনের ফলাফল এরই প্রতিফলন।
মালয় জনগোষ্ঠীর দল হিসেবে উমনুর প্রভাব কমার পেছনে বারাসাতু চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন ইয়াসিনের সরকারে যোগদানকেও দায়ী মনে করা হয়। আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপানের সাথে বারিসানের যোগদানের পেছনে এটিকে প্রধান যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। এ ব্যাপারে জাহিদ-হাসান সমর্থকদের যুক্তির সামনে ইসমাইল সাবরি ও হিশামুদ্দিনের যুক্তি দলের মাঠ নেতাদের সামনে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। এর ফলে দলের নীতি নির্ধারকদের বৈঠকে উমনু প্রধান জাহিদ হামিদী ও দলের উপপ্রধান মোহাম্মদ হাসানের পক্ষ উমনুর তৃণমূল নেতৃত্বের সমর্থন লাভ করে। পরবর্তীতে উমনুর নেতৃত্ব নির্বাচনে দলের প্রধান ও উপপ্রধান পদে ভোট অনুষ্ঠান না করার প্রস্তাবে জাহিদ-হাসানের প্রতিপক্ষ সাবরি-হিশামের বিরোধিতা ব্যর্থ হয়। দলের অন্যান্য পদে সাম্প্রতিক নির্বাচনেও ভিন্ন মতাবলম্বী সাবরি-হিশামপন্থী হিসেবে পরিচিতরা সাফল্য লাভ করেনি। এমনকি তারা ঐক্য সরকারের এই সময়ে উমনু এমপিদের একটি অংশকে পক্ষ ত্যাগে সংগঠিত করার একটি উদ্যোগ নিয়েও খুব একটা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি।
এই পটভূমিতে মহিউদ্দিন-হাদির নতুন সরকারের পতন পরিকল্পনা উমনুর মূলধারার সমর্থন কতটা পাবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যেতে পারে। যদিও মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন শরৎকালের মেঘের আনাগোনার মতোই। কখন কি হয় আভাস দেয়া মুশকিল। তবে উমনু আবারো যদি ‘শেরাটন মুভ’-এর মতো কোনো উদ্যোগে যুক্ত হয়ে যায় তবে মালয় জনগোষ্ঠীর দল হিসেবে তারা পাস-বারাসাতু অক্ষের কাছে প্রাসঙ্গিকতা আরো হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি অবশ্য দৃঢতার সাথে আশ্বস্ত করেছেন যে বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) এর সাথে নতুন উমনু নেতৃত্ব ফেডারেল পর্যায়ে জোট সরকারকে সমর্থন ও শক্তিশালী করা অব্যাহত রাখবে। প্রশ্ন হলো, এসব বাস্তবতার পরও আনোয়ার ইব্রাহিমের সরকার কি সত্যি সত্যি কোনো পতন আশঙ্কার হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ প্রশ্নের জবাব হলো জোরালো কোনো হুমকি এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মালয়দের আস্থা অর্জন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। এর মধ্যে ড. মাহাথির এই বয়সে আবার একটি সক্রিয়তাবাদী মালয় বলয়ে যোগ দিয়েছেন। তিনি আনোয়ারের চার মাসের সরকারকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছেন। এ নিয়ে অবশ্য শতবর্তী এই নেতাকে সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ ট্রলের শিকার হতে হয়েছে।
আনোয়ারের রাষ্ট্র পরিচালনার একটি দর্শন আছে যেটি এখনো মালয় জনগোষ্ঠীর বড় অংশ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। সেটি হলো মালয়েশিয়াকে এগিয়ে যেতে হলে দেশটির সব জাতিতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে এগুতে হবে। সব জনগোষ্ঠীর জন্য ভারসাম্যমূলক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মালয় নেতাদের বড় অংশ মনে করে মালয়েশিয়া হলো মূলত মালয়দের। চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা পরে এখানে বসতি শুরু করেছেন। ফলে মালয়েশিয়ার আদিবাসী হিসেবে মালয়দের বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মতো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও মালয়রা হারাবে। মালয় শাসকদের অধিকাংশই এই মতোই সমর্থন করে বলে মনে হয়। এ কারণে আনোয়ার ইব্রাহিম ক্ষমতার একেবারে কাছে গিয়ে বার বার ছিটকে পড়েছেন। এবার চীনা বংশোদ্ভূতদের দল ডিএপির ভূমিকা সরকারে গৌণ। আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব প্রক্রিয়ার মালয়দের প্রাধান্য রয়েছে। কিন্তু এরপরও পাসের একটি বড় প্রচারণা হলো মালয় স্বার্থ এখন ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পাসের কিছু এনজিওকে নির্বাচনপূর্ব সময়ে ভোটে কাজে লাগানোর ব্যাপারে আনোয়ারের সমলোচনাকে পাসের নেতারা মালয়বিরোধী মনোভাব হিসেবে প্রচার করছেন। মালয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব দূর এবং নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে ফেলার ব্যাপারে আনোয়ার সফল হলে এসব প্রচারণা খুব একটা কাজ করবে না। আগামী রাজ্য নির্বাচনগুলোতে এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। ছয় রাজ্যের আসন্ন এই নির্বাচনে শাসক জোটের যেকোনো ব্যর্থতা নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সরকারের উত্থান পতনের এই ধরনের অস্থিরতা মালয়েশিয়াকে আবারো দুর্বল করার দিকে ঠেলে দেবে। দেশটির মালয় শাসকদের, বিশেষ করে গভীর ক্ষমতা বলয়ের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে একটি বড় সিদ্ধান্তকারী পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে। এবার সরকারে আনোয়ার ইব্রাহিমের সাফল্য পাকাতানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ দফায় ক্ষমতার চক্র থেকে ছিটকে পড়লে আনোয়ারের নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও যথেষ্ট তমশাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারে।