কিছু চলে যাওয়ার কোনো সান্ত¡না হয় না। শোক জানাবারও কিছু থাকে না। ভাষা সেখানে পরাস্ত, পরাজিত। শুধু নতশির নীরবতাই হতে পারে সত্যিকারের শোকের অভিব্যক্তি। এমনই একটি চলে যাওয়া ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। তাকে চিনি নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে। সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছিলাম কোনো একটি অনুষ্ঠানে। আমার পত্রিকার পরিচয় পেয়ে খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অনেক রিপোর্টারের মধ্যে আলাদা করে কথা বলেছিলেন আমার সাথে। কিছু কথা এখনও মনে আছে। বলেছিলেন, আপনাদের থেকে আমার চিন্তা একেবারে আলাদা। আমি ভাই, নারী-পুরুষকে আলাদা করে ভাবতে পারি না। নারীরা সব কাজ পারে না, তাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা হতে হবে এটাও মানি না। তাদের আমি সব কাজে পুরুষের সমান ভাবি, সেভাবেই তাদের নিয়ে কাজ করি।
আমি তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলিনি। কারণ, যে পত্রিকার প্রতিনিধিত্ব করছি তার অবস্থানের বিপরীতে কিছু বলা অসঙ্গত হতো। আমার নিজের মত জাহির করাটাও সঙ্গত মনে করিনি। নিজেকে অত বিজ্ঞ বা যোগ্য কখনও ভাবিনি। শুধু বললাম, আপনি যেটা করছেন সেটা তো বিপ্লবাত্মক। না, নিছক খুশি করার জন্য বলিনি। সত্যিকারের বিশ্বাস থেকেই বলেছি। ততক্ষণে তিনি দেখাচ্ছিলেন তার প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালাচ্ছে নারীরা। গেটে পাহারা দিচ্ছে নারীরা, একটি সেকশনে কাঠে র্যাঁদা মেরে ফার্নিচার বানাচ্ছে মেয়েরা। কামারের কাজও করছে। সবাই নীল রঙের হাওয়াই শার্ট আর নিট ওয়্যারের পাজামা আর জুতা পরা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আরো কী কী করছে সব দেখা হয়নি। আমার জবাবে তিনি শুধু মৃদু হেসেছিলেন।
আমি তাকে ওই সময় থেকেই অনুসরণ করেছি। তার কর্মকা-ের খবর রেখেছি, সাফল্যের, অর্জনের খবরে পুলকিত হয়েছি। কোথাও বক্তৃতা করবেন শুনলে যাবার চেষ্টাও করেছি কখনো। রাজনৈতিক বা নিছক স্পষ্ট কথা বলার কারণে তাকে যখন হেনস্থা করা হয়েছে, তার প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়েছে, মামলা দিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে ব্যথিত হয়েছি। কারণ, তার মতো সৎ মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।
তাকে এমন একজন মানুষ মনে হয়েছে যার মনে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণচিন্তা ছাড়া যার অন্য কিছু কখনো ছিল না। একেবারে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুর মুহূর্তেও একই চিন্তা ছিল তার সঙ্গী। শেষ মুহূর্তে জীবন বাঁচাতে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে যাবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্যেও দেশের প্রতি তার আনুগত্য ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। নিজের প্রতিষ্ঠানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিলাতে ডাক্তারি পড়া শেষ না করেই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আগরতলায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। সেখানেই গড়ে তোলেন ৪৮০ শয্যার ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। সেখানে রোগীদের সেবার জন্য অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেন। সাধারণ নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োগের এই পদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি যা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চালু করেছিলেন, সেটি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বহির্বিশ্বে তার পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।
শুধু নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সব ধরনের কাজে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যে সম্ভব সেটি হাতে-কলমে দেখিয়েছেন ডা: জাফরুল্লাহ। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন বিভাগ আছে যেগুলো পুরোপুরি নারীদের পরিচালিত। উচ্চ পদ থেকে শুরু করে গাড়ি চালক, এমনকি কার্পেন্টার পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেখার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়া বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ছিলেন তিনি ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। এই কেন্দ্রে এতটাই ন্যূনতম মূল্যে মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হয় যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। কত অসহায় মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিয়েছেন ইয়ত্তা নেই। দেশে চিকিৎসাসেবা যখন অত্যধিক মুনাফা অর্জনের গলাকাটা ব্যবসায় পরিণত সেই সময়ে এই দৃষ্টান্ত বিরলতম। স্বাভাবিকভাবেই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাসপাতালটি গরিবের হাসপাতাল এবং ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী গরিবের ডাক্তার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। ডা: জাফরুল্লাহ যে অসংখ্য বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন তার প্রত্যেকটির জন্যই হয়তো তিনি আলাদা করে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। শুধু গণস্বাস্থ্যের মতো একটি এনজিও গড়ে তোলাই হতে পারে তাকে স্মরণ করার সেরা উপলক্ষ। ’৮২-র ওষুধ নীতি হতে পারে আরেকটি। নারীদের স্বাবলম্বী করা তথা নারীর ক্ষমতায়নের সামাজিক কর্মসূচিও তেমনই আরেক মাইলফলক হয়ে থাকবে। এমন অসংখ্য কাজ আছে যেগুলো শুধু স্মরণীয় নয় বরং পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা ও অনুসরণের চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী যখন লন্ডনে পড়তে যান তখন তার জীবনযাপন ছিল রাজকীয়। সবচেয়ে দামি গাড়ি ব্যবহার করতেন। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে। আর মুক্তিযুদ্ধই তার জীবন পুরোপুরি পাল্টে দেয়। তিনি সব রকম বিলাস ব্যসন ত্যাগ করলেন। মানুষের জীবন পাল্টানোর ব্রত নেন। নিজের জন্য বেছে নেন একেবারে সাধারণ মানুষের মতো সহজ সরল জীবন। নিজের জন্য তার আর কোনো চাওয়া ছিল না। এতটাই নির্মোহ হয়ে পড়েন যে, বাড়ি, গাড়ি, ফার্নিচারও সবই ব্যবহার করতেন পুরনোগুলোই। পোশাকও। ৩০ বছরের পুরনো প্যান্ট বা শার্ট তার প্রতীক হয়ে ওঠে। নিজের প্রকল্পগুলো নিয়েছেন শুধুই মানুষের উপকার কতটুকু হবে সেই ভেবে। সেগুলোকে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করার কথা কখনো ভাবেননি। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা পুরস্কার বিজয়ী। পেয়েছেন রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, সুইডেনের বিকল্প নোবেল খ্যাত রাইট লাইভলিহুড এবং দেশে-বিদেশে আরো অনেক পুরস্কার। কিন্তু পুরস্কারের জন্য কখনো তদ্বির করেছেন কেউ বলতে পারবে না। এ দিক থেকে তিনি নোবেল না পেলেও নোবেল জয়ীর চেয়ে অনেক অনেক বেশি উঁচুশির। দেশ ও জাতির প্রকৃত কল্যাণকামী হিসাবে তার যে সামাজিক রাজনৈতিক ভূমিকা সেটিও অনেক অনেক বড়। যা বিশ্বাস করতেন অকুণ্ঠচিত্তে সেটাই জোরগলায় প্রকাশ করতেন। কারো মন জুগিয়ে কথা বলতেন না। এটি তার সততার অন্যতম দৃষ্টান্ত। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে চিন্তা ও কর্মের পাশাপাশি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিরোধ কমিয়ে এনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা চেষ্টার জন্যও প্রশংসিত হয়েছেন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আর সে জন্যই আজ মৃত্যুর পরই কেবল নয়, বরং বেঁচে থাকতেই পেয়েছেন আপামর জনগণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মানুষের হৃদয় জয় করার চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে?
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের হীন মনোবৃত্তির কারণে মানসিকভাবে কষ্ট পেয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠানে হামলা করেছে দলীয় গু-ারা, মাছ চুরির মতো মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করেছে। কিন্তু তিনি মুখ ফিরিয়ে নেননি। যখনই দরকার মনে করেছেন সরকারের উদ্দেশে যথাযথ পরামর্শ বা আহ্বান ঠিকই জানিয়েছেন। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের সময় করণীয় বিষয়ে এবং তার গবেষণা কেন্দ্রের উদ্ভাবিত করোনা টেস্ট কিটের লাইসেন্স ইত্যাদি নিয়ে সরকারি দফতরের আচরণে হয়তো ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু হতাশ হননি। হতাশা তাকে কখনো গ্রাস করেছে এমন মনে হয়নি। সব কিছুর পরও নয়া দিগন্তে প্রকাশিত একাধিক নিবন্ধে তিনি সরকারের জন্য দ্বিধাহীন মনে পরামর্শ তুলে ধরেছেন। যদিও আমার জানা মতে, সেগুলো গ্রহণ করা তো দূরের কথা, বিবেচনায় নেয়ারও ন্যূনতম প্রয়োজন তারা বোধ করেননি। সেসব নিবন্ধ ছাপতে গিয়ে কখনো এমন কথাও মনে এসেছে যে, আহা, ডা: সাহেব কি সরকারি আনুকূল্য পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন! কিন্তু তাকে যারা কাছে থেকে জানেন, ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছেন তারা জানেন, ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যক্তিস্বার্থে একটি পা-ও কখনো কোথাও বাড়াননি কিংবা একটি শব্দও লিখেননি। আর হতাশার কারণগুলো উপেক্ষা করার মতো উদারতাও তার ছিল।
ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, প্রকৃত বীরদের কথা বিশ্ব কখনোই জানতে পারে না। তারা সবার অগোচরে থেকেই নীরবে মানবকল্যাণে কাজ করে যান। এখন সে যুগ নেই। এখন মিডিয়ার যুগ। কেউ নীরবে কাজ করলেও মিডিয়া নিজের প্রয়োজনেই তাকে খুঁজে নেয়, ফলাও করে পাঠককে জানায়। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীও সেভাবেই প্রচারণার পাদপ্রদীপের নিচে এসেছেন। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাপ্তাহিক বিচিত্রা তাকে নিয়ে, তার কর্মকা- নিয়ে দুইয়ের অধিক কভার স্টোরি করেছে বিভিন্ন সময়। চিকিৎসা বিষয়ক বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা সাময়িকী ল্যানসেটে তার পেপার ছাপা হয়েছে। হয়েছে অন্যত্রও।
আমাদের জাতিগত দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত আনুগত্যের বাইরের কারো অবদানের স্বীকৃতি আমরা প্রায়ই দিতে পারি না। ডা: জাফরুল্লাহও তার বাইরে নন। তার মেধা, মনন, মানুষের জন্য দরদ, দেশের জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে যাবার এমন অদম্য মনোবলের যথাযথ মূল্যায়ন আমরা করে উঠতে পারিনি। মহৎপ্রাণ মানুষের মর্যাদা বুঝে ওঠার মতো যোগ্যতারও আমাদের অভাব আছে। সে জন্যই দেখতে পাই, সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে তাকে ন্যূনতম শ্রদ্ধা জানাতেও কুণ্ঠিত কিছু মানুষ। সে প্রসঙ্গ থাক।
আমরা এই বন্ধুপ্রতীম মানুষটির প্রতি সকৃতজ্ঞচিত্তে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কামনা করি তার পারলৌকিক মুক্তি ও কল্যাণ। আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিব্বুল আফওয়া- (হে আল্লাহ, তুমি ক্ষমাকারী, তুমি ক্ষমা করতেই ভালোবাসো)। mujta42@gmail.com