বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৯ অপরাহ্ন

পরকিয়ার জেরে আত্মহত্যা, স্ত্রী-স্বামী জেলে অসহায় দুই পরিবারের, সন্তানদের কান্না যেন থামছে না

মোহাম্মদ রাশেদ (সাতকানিয়া) চট্টগ্রাম :
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৩

পরকিয়া প্রেম ও পাওনা টাকা নিয়ে দুইটি পরিবারের মধ্যে শত্রুতার এক পর্যায়ে অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ভয়ে আত্মহত্যা করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন পঙ্কজ চক্রবর্তী। আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলায় কারাগারে রয়েছে পরকিয়ায় আসক্ত জোনাকি ধর ও তার স্বামী সাগর ধর। উভয় পরিবারের অভিভাবকরা নিজেদের কর্মগুলোর ফলাফল ভোগ করলেও এর মধ্যে তাদের পরিবারের ছয় সন্তান এখন অসহায় ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় পঙ্কজের সন্তানরা পিতৃহারা ও স্ত্রী হয়েছেন বিধবা। এতে পঙ্কজের সন্তান ও স্ত্রীর দেখা দিয়েছে মানসিক ও আর্থিক অনিশ্চয়তা। এ দিকে মা-বাবা কারাগারে থাকায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে জোনাকির সন্তানরা। ঘটনাটি ঘটেছে সাতকানিয়া পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড দক্ষিণ রামপুর (বণিক পাড়া) এলাকায়। গতকাল (শনিবার) দুপুরে উভয় পরিবারের অবস্থা জানতে ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর সাথে। এ ব্যাপারে পঙ্কজ চক্রবর্তীর বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে পুষ্পিতা চক্রবর্তী তুষ্টি বলেন, জোনাকিদের সাথে সম্পর্কের আগে বাবা ঘরে ঢুকে দেখলেই আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসত। আমিও হাঁসতাম। বাবা মেয়ের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল। বাবা যখন ওদের (জোনাকি) ঘরে আসা যাওয়া শুরু করে তখন তার (বাবা) মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা দেয়। আগের মত বাবা আমার সাথে কথা বলে না। ঘরে ঢুকে নিজের মত ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে। আবার সকালে ওঠে দোকানে চলে যায়। তুষ্টি আরও বলেন, একদিন জোনাকির ঘর থেকে বাবা যখন মদ পান করে বাড়ি ফিরে আসে তখন আমি বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাবা তুমি এভাবে ঘরে আসছ আর যাচ্ছ, কোনদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছ আমি বড় হয়ে কি হব? আমার ইচ্ছা কি এবং কি হতে চাই বা লেখাপড়া কেমন চলছে? তখন বাবা মাতাল অবস্থায় বলে, তোরা বড় হয়ে মানুষ হবি। ঘর-দুয়ার সব তোদের জন্য। আমারতো একজন ছেলে নাই। সবকিছু তোরা তিন মেয়েই ভোগ করবি। তখন আমি বাবাকে বলি, আমি শিক্ষক হব। তখন বাবা একটু হেঁসে বলে, যদি হও আর কি। তুমি কি এ লেখাপড়ায় শিক্ষক হতে পারবে? তখন বাবা ভাল করে পড়া-লেখা করার পরামর্শ দেয়। এই হল বাবার সাথে কয়েক বছরের মধ্যে আমার দীর্ঘ কথা। তুষ্টি আরও বলেন, ঘটনার দিন জোনাকির ঘরে বাবা গিয়ে মদ পান করে। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমার মাও তাদের ঘরে যায়। সেখানে তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়। এ সময় আমার মা জোনাকির সাথে বাবার যে সম্পর্ক ছিল সেটি সাগরকে বলে দিলে সাগর জোনাকিকে দুইটি লাথি মারে। বিষয়টি বাবা সহ্য করতে পারেনি। এক পর্যায়ে বাবা বাড়ি আসে। তখন সাগর চিৎকার দিয়ে বাবাকে বলতে থাকে- ‘তুই এত ঘর দুয়ার বেঁধে লাভ কি? তুই ফাঁসি দিয়ে মরতে পারস না’। পরে সাগর চলে গেলে বাবা আমাকে বলে, ‘মারে তোরা আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমার পরিবারকে বলিস আমাকে ক্ষমা করে দিতে’। এই কথা বলে বাবা ঘরের দোতলায় উঠতে চাইলে তার গেঞ্জি ধরে আমি অনেক টানাটানি করেছি, কোন কাজ হয়নি। তুষ্টি আরও বলেন, বাবা আমাদের তিন সন্তানের কথা ভাবেনি। মা কিভাবে চলবে সেটাও চিন্তা করেনি। আমাদের অথৈ সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন। আমরা কিভাবে চলব, আমাদের কে দেখবে? আমরা তো এতিম হয়ে গেলাম। এ সময় সেখানে দাঁড়ানো পাড়ার লোকজন নিরবেই চোখের জল ফেলেছেন। এ ব্যাপারে পঙ্কজের স্ত্রী পম্পি চক্রবর্তী বলেন, প্রায় দুই বছর আগে সাগরকে আমার স্বামী বিদেশ যাওয়ার জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা ধার দেয়। এরপর থেকে দোকান থেকে এসে প্রায় রাতে আমার স্বামী তাদের ঘরে আসা-যাওয়ার কারণে জোনাকির সাথে আমার স্বামীর খারাপ সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে তা গভীরে চলে যায়। প্রায় সময় জোনাাকি পঙ্কজকে ফোন দিত। এ বিষয়ে কথা বললে আমাকে স্বামী মারধর করত প্রায় সময়। পম্পি চক্রবর্তী আরও বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার মূল কারণ, জোনাকি ও তার স্বামী সাগর। তারা পরিকল্পনা করে যাতে পাওনা টাকা দিতে না হয়, সে জন্য তাকে মরে যেতে বাধ্য করেছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। পঙ্কজের বড় ভাই পলাশ চক্রবর্তী বলেন, টাকার বিষয়ে এলাকার কাউন্সিলরসহ আমরা মিলে মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বললেও ভাই কথা শুনেনি। সাগরের ঘরে আসা-যাওয়ায় তার স্ত্রী ও পঙ্কজের সাথে খারাপ সম্পর্কের কারণে ঘটনার দিন সাগরের স্ত্রী জোনাকি বলে, কাগজ-কলম করে পঙ্কজকে জামাই নিব। পঙ্কজের সমস্ত কিছুতো খাবই-খাব, পঙ্কজকেও খাব। কান্না বিজড়িত কন্ঠে পলাশ চক্রবর্তী আরও বলেন, ভাইতো মারা গেল। এখন তার ছোট ছোট বাচ্চাদের কে দেখবে? আমরাতো অনেক চেষ্টা করেছি ভাইকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু তারাতো সময় দিল না। এ রকম চলতে থাকলে এভাবেই কত মায়ের বুক খালি, স্ত্রী বিধবা ও সন্তানরা এতিম হবে। আমি প্রশাসনের কাছে নিরপেক্ষ বিচারটা যাতে হয়, সে জন্য আকুল আবেদন জানাচ্ছি। অপর দিকে সাগর ধর ও জোনাকি ধরের বড় মেয়ে দশম শ্রেণি পড়ুয়া ঐশি ধর ও সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া তরি ধর বলেন, আমাদের মা বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমরা কিভাবে চলব? পঙ্কজ চক্রবর্তী নিজে নিজে ফাঁসি দিয়ে মরে গেছে। এখানে আমার মা-বাবার দোষ কি? তারা এখন জেলে, আমাদের এখন কে খাওয়াবে এবং পড়ালেখা কিভাবে করব? আমরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছি। রামপুর বণিক পাড়ার বাসিন্দা পলাশ ধর বলেন, একদিকে বাবা মারা গেছে। অন্য দিকে মা-বাবা জেলে। তাদের ছোট ছোট সন্তান ও স্ত্রী এখন কি করবে? তিনি আরও বলেন, তাদের অপকর্মের বোঝা কি সন্তানরা কাঁদে নিয়ে আজীবন বয়ে বেড়াবে? এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সমাজের মানুষকে সচেতন হওয়া জরুরী। উল্লেখ্য, গত বুধবার (১২এপ্রিল) দিবাগত পৌনে দুইটার দিকে সাতকানিয়া পৌরসভার এক নং ওয়ার্ড দক্ষিণ রামপুর (বণিক পাড়া) নিজ বাড়িতে স্বর্ণ ব্যবসায়ী পঙ্কজ চক্রবর্তী ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে। ঘটনার পর দিন বৃহস্পতিবার সকালে পঙ্কজের বড় ভাই পলাশ চক্রবর্তী বাদী হয়ে জোনাকি ধর ও তার স্বামী সাগর ধরকে আসামী করে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com