আম্মার বয়স এখন নব্বই পেরিয়ে। কোনো মতে চলাফেরা করেন। তাও আবার একজনের সাহায্য ছাড়া নয়। তার ইচ্ছে ঈদে সবাই তার কাছে তার সাথে থাকুক। তার ইচ্ছের সাথে তাল মিলিয়ে আমার দুই ছোট্ট নাতি হৈ হৈ রৈ রৈ বাধিয়ে তুলল গ্রামে যাবে বলে। তাদের পরিকল্পনা সাইকেল নিতে হবে, বল নিতে হবে। ফুটবল খেলার বুট জুতো, গ্লাভস ইত্যাদি ইত্যাদি সবই নিতে হবে। তাদের দিন গোনার শেষ নেই। কবে যাবো কবে যাবো করতে করতে দিন এসেই গেল। সবাই মিলে গ্রামের বাড়ি। ঈদ উৎসব পালনের জন্য।
যথাসময়ে শেষ হলো রোজা। এলো ঈদ। এবারের ঈদে গ্রামের কয়েকটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে প্রবলভাবে। প্রথমত, গ্রামের হাটবাজার থানা সদরের বাজার জেলা সদরের বিপণি সর্বত্রই ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। ক্রেতার উপচে পড়া ভিড়। সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দামের উল্লম্ফনতো রয়েছে। ঢাকায় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের কিছু প্রচারমুখী অভিযানের কথা শোনা যায়, টেলিভিশনের পর্দায় কর্মকর্তাদের কর্মতৎপরতার প্রতিবেদন দেখা যায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জেলা সদরে উপজেলার বিপণিবিতানগুলোতে যারা ক্রেতা তাদের দেখার কেউ নেই। বিক্রেতাদের ‘যেমন খুশি দাম চাও’ প্রতিযোগিতায় একে অপরকে টেক্কা মারার প্রবণতাকে রুখবে কে? গ্রামগঞ্জের সাধারণ ক্রেতাদের পাশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাউকেই দাঁড়াতে দেখা যায়নি। ক্রেতারা সেখানে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পিত।
দ্বিতীয়ত, পোশাকে, চলনে বলনে, খাবারের ব্যাপারে বৈচিত্র্যের সমারোহে গ্রামীণ জীবনের আগের চিত্র সামগ্রিকভাবে হারিয়ে গিয়েছে। সর্বত্রই নতুনের জয়জয়কার। আধুনিকতার ছাপ সর্বত্রই। অত্যন্ত আধুনিক ফ্যাশনের পোশাকের বিপুল সমারোহে আকাশচুম্বী মূল্যের আড়ালে হারিয়ে গেছে আগের ঈদের আমেজ। তারুণ্যের দীপ্ত ছটা আর উদ্দাম জীবনের কাছে ঐতিহ্য এবং সামাজিক মূল্যবোধ পরাজিত। ঈদের নামাজে গিয়েও একই অবস্থা। একই চিত্র। তরুণদের সংখ্যাধিক্য আধিপত্য এবং ব্যবস্থাপনায় তাদের দক্ষতা যে কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। খারাপ লাগল নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই হুড়োহুড়ি করে চলে যাওয়া। ভাবখানা এমন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মাত্র ক’বছর আগেও নামাজ শেষে কোলাকুলি আর সালামের যে প্রচলন ছিল এখন তা ক্ষীয়মাণ স্রোতধারায় পরিণত। এটা অবশ্যই দারুণ শঙ্কার বিষয়। ঈদের নামাজ শেষে দল বেঁধে পরলোকগত আত্মীয় পরিজনের জন্য কবরস্থানে গিয়ে দোয়া করার যে রেওয়াজ ছিল, তা এবার খুব একটা চোখে পড়ল না। পাড়া-পড়শিদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেয়া, সালাম করা, সবই অনুপস্থিত। বিকেল হতেই আরেক দৃশ্য। এলাকার উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা কোথাও দল বেঁধে কোথাও যুগলবন্দী হয়ে কোথাও বা একাই ভ্রমণে বেরিয়েছে। তাদের ছোটাছুটি আর কোলাহলে চায়ের দোকানে আড্ডা, বটগাছ তলায় উন্মুক্ত আড্ডা, মোটরসাইকেলে তীব্র গতিতে ছুটে চলা এসবই যেন এখন ঈদ আনন্দ। সেখানে বিলিয়ে দেয়ার, আনন্দ ভাগ করে নেয়ার মনোভাব দৃষ্টিকটুভাবে অনুপস্থিত।
আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। তরুণেরা যেসব মোটরসাইকেল চালায় তা অধিকাংশ অভিভাবকের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তাদের ব্যয়বহুল জীবনযাপনের সংস্থান নিয়ে প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। তাদের বেশির ভাগই বেকার। এরা নিজেদের অজান্তেই বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কাজের সাথে জড়িত। বিভিন্ন নামে অনুষ্ঠানের দোহাই দিয়ে চাঁদাবাজির মাধ্যমে খরচের জোগান চলে শুনলাম। শুনলাম মাদকের অন্ধকার জগতের সাথেও অনেকে জড়িয়ে গেছে ব্যয় সংস্থানের জন্য। এদের রুখবার ক্ষমতা কারোর নেই। এরা স্থানীয় ক্ষমতার আশ্রয়ে লালিত-পালিত। এভাবেই গ্রামীণ তরুণ জনপদের একটি অংশ তাদের জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলছে। তাদের পথ দেখাবার কেউ নেই। এ যেন এক অগস্ত্য যাত্রা।
ঈদের পরের দিন স্থানীয় স্কুলের কয়েকজন এসএসসি পরীক্ষার্থী এলো দেখা করতে।
কথা প্রসঙ্গে তাদের কাছে জানতে চাইলাম তারা বড় হয়ে কী হতে চায়? সবারই একই জবাব ‘জানি না’। শুনে হতভম্ব হয়ে যাওয়ার জোগাড়। যারা এ দেশের ভবিষ্যৎ কা-ারি তারা লক্ষ্যহীনভাবে বড় হয়ে উঠছে। ভাবলে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হতে হয় বৈকি! তারা জানে না এ দেশের রাষ্ট্রপতির নাম, জানে না ঈদ আনন্দ কেন, বলতে পারে না বিজয় দিবসের ইতিহাস, বলতে পারে না বীরশ্রেষ্ঠদের নাম সঠিকভাবে। অথচ সবার হাতে দামি মোবাইলফোন, সারাক্ষণ তারা এটা নিয়েই ব্যস্ত। সামাজিক দায়বদ্ধতা, সামাজিকতা, অতিথি আপ্যায়ন, প্রতিবেশীর সাথে ব্যবহার, তাদের খোঁজখবর নেয়া সবই এদের কাছে দুর্বোধ্য। সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। এ বয়সেই পরিবারে সমাজে বাস করে এরা নিজেরাই আত্মকেন্দ্রিক এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। এদের কাছে স্মার্টনেস মানেই বল্গাহীন জীবনের স্বপ্ন। দামি মোবাইল, মোটরসাইকেল আর ক্ষমতার বলদর্পী আচরণ। এরা কিভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বে? কিভাবে সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টিকে থাকবে? কিভাবে সমাজ ও দেশকে গতিশীল নেতৃত্ব দেবে? ভাবতেও কষ্ট হয়। এদেরকে সৃষ্টিমুখী চেতনায়, জীবনধর্মী দীক্ষায় দীক্ষিত করতে না পারলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ পথচলা দায় হয়ে উঠবে। এদের পাশাপাশি যারা দিন আনে দিন খায় খেটে খাওয়া মানুষ তাদের দুর্গতির কথা কেউ ভাবে বলে মনে হয় না। এদের জীবনে ঈদ এবং অন্যান্য দিন সবই এক। ঈদের আনন্দ ঈদের খুশি তাদের কাছে কোনো আবেদন রাখতে পারে না। এ যেন-
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’
গ্রামীণ জনপদের খেটে খাওয়া মানুষদের অসহায় অবস্থায় পরিবর্তন কি কখনো হবে? কবে ঈদের খুশির মিছিলে তারাও অন্তর্ভুক্ত হবে? লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ Email- shah.b.islam@gmail.com