২০০২ সাল। ঈদুল ফিতরের আগের দিন। বিশ্বের সর্বোচ্চ পেট্রোনাস টুইনটাওয়ার দেখার উদ্দেশে মালয়েশিয়া রওনা হই। ঈদের নামাজ পড়ার মানসে সাথে নিয়েছিলাম পাজামা পাঞ্জাবি ও নতুন টুপি। সকালে গিয়ে নতুন বিমানবন্দর অবতরণ করি। মালয়েশিয়া মুসলিম দেশ। ইচ্ছে ছিল, মালয়েশিয়ার সর্ববৃহত্তম মসজিদ শাহ আলমে ঈদের নামাজ আদায় করা। ভোরবেলা অবতরণ করেই শুনি ঈদের নামাজ আগের দিন হয়ে গেছে। সেপাং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুয়ালালামপুর ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ। ৪৫ কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে ঈদ উৎসবের কোনো চিহ্নই দেখলাম না। কুয়ালালামপুর পৌঁছার কয়েকদিন পরই ছিল থার্টিফার্স্ট নাইট। আকাশজুড়ে আতশবাজিসহ রাতভর তোলপাড় দেখেছি থার্টিফার্স্ট নাইটে।
২০২২ সাল। রমজান মাসে সুইডেন। খ্রিষ্টানপ্রধান দেশ। ঘুরতে গিয়ে মাঝে মধ্যে চার্জ (গির্জা) চোখে পড়লেও মসজিদ চোখে পড়ে না। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করার ইচ্ছা প্রকাশ করে জানতে পারি, আমার অবস্থানকৃত স্থান থেকে অনুমান ২০ কিলোমিটার দূরে অ্যারাবি এলাকায় ঠধীলড় গড়ংয়ঁব-নামে একটি মসজিদ রয়েছে। সেখানেই হবে ঈদের নামাজ। ২ মে ঈদুল ফিতর। নাঈম নিয়ে যাবে। ঈদের দিন নাঈম ছুটি পায়নি। সংখ্যালঘুদের পর্বের জন্য ঐচ্ছিক ছুটি। ছুটি চাইলে ছুটি দিতে হয়। ছুটি না চাওয়ার কারণ, নাঈমের কার্যালয়ে আরো একজন মুসলমান আছে। প্রায় একই প্রকারের কাজে একই সময়ে দুই জনকে ছুটি দেবে না। তাই, ঈদের দিন সকালে আমি, মল্লিকা ও অনিকা বাসযোগে রওনা হই। দুই বাস বদল করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই অ্যারাবি এলাকায়। অ্যারাবি আরবি নাম। এলাকার নামও অ্যারাবি। এই নাম থেকেই বুঝতে পারি, এখানে মুসলমানদের প্রাধান্য বেশি। বড়সড় স্থান নিয়ে মসজিদ এলাকা। পশ্চিম দিকে মসজিদ, পূর্বদিকে মাঠ। মাঠের পরে বাউন্ডারি দেয়াল, এর পর রাস্তা। নামাজিরা মসজিদ পেছনে রেখে পূর্বদিকে মুখ করে বসতে শুরু করেছে। খতিবের খুতবার আসনটিও পূর্বদিকেই স্থাপিত। নামাজ আদায় শেষে দেখা গেল, পুরুষদের পেছনে অনেক নারীও ঈদের নামাজ আদায় করতে মসজিদে উপস্থিত। তবে মহিলারা আমাদের সাথে জামাতে শরিক হয়েছিল কি-না জানা যায়নি। (ইউরোপের চার দেশ, পৃষ্ঠা-১৮০)
৪ নভেম্বর ২০০৫ সাল। ঈদুল ফিতর। আমরা বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপালের পোখারা ভ্যালিতে। অমুসলিম দেশে ঈদের নামাজ অনিশ্চিত। তাই পাঞ্জাবি-পাজামা নেয়া হয়নি। পোখারায় সাংগ্রি-লা হোটেলের যে কক্ষে ছিলাম সে কক্ষের বারান্দায় দাঁড়ালে পুবের পাহাড় ও আকাশ দেখা যায়। সন্ধ্যায় হোটেলে পৌঁছে পাহাড় দেখেছি। পাহাড়ের ওপরে মানুষ বাস করতে পারে এটি ছিল আমার কল্পনাতীত। অন্ধকার তারাজ্বলজ্বল রাতে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কোনটি আকাশের তারা আর কোনটি বিদ্যুতের বাতি- পার্থক্য করা দায় হয়ে পড়ল। আকাশ থেকে ভূমি পর্যন্ত তারা ও বাতি মিলে একাকার হয়ে গেছে। এত উঁচু পাহাড়ের ওপর ওঠা-নামাসহ বসবাস করা আমার কাছে যত কঠিন মনে হয়েছিল তাদের কাছে তত কঠিন ছিল না। পিঁপড়া নিজ ওজনের চেয়ে বেশি ওজনের দ্রব্য নিয়ে যেমন তর তর করে খাড়া ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে পারে, পাহাড়িরাও তেমন পারে। কাঠমা-ু থেকে পোখারা আসতে চারপাশে শত শত পাহাড় দেখেছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রাপথে চোখ এক মুহূর্তও পাহাড়ের বেষ্টনী থেকে মুক্তি পায়নি। এখন পাহাড়ের চূড়া থেকে গোড়া পর্যন্ত বৈদ্যুতিক আলো জ্বলতে দেখে ধারণা হচ্ছে- প্রত্যেক পাহাড়েই মানুষ বাস করে। একেকটি পাহাড়ই একেকটি গ্রাম। গ্রাম মিলে ইউনিয়ন, থানা ইত্যাদি। দেশটিই পাহাড়ের দেশ। আমি অন্যদের চেয়ে কম ঘুমাতাম। আমার মতে ঘুমানোর জন্য বাড়ি আর দেখার জন্য বিদেশ। তাই যতক্ষণ পারি ততক্ষণ দেখি। শেষ রাতে ঘুম ভাঙলে দেখার জন্য বের হয়ে যাই।
অন্ধকারে বিদেশের তারা দেখি, তারাভরা আকাশ দেখি ও বিজলি বাতি দেখি। দেখে দেখে পার্থক্য বের করি। এগুলোর মধ্যেও পার্থক্য আছে। নেপালের চন্দ্রবিহীন আকাশ যত কালো আমাদের আকাশ তত কালো নয়। ওখান থেকে তারাগুলো যত উজ্জ্বল দেখায় আমাদের এখান থেকে তত উজ্জ্বল দেখায় না। আমাদের রাতের সাথে ওদের রাতের পরিবেশে তুলনা করতে করতে সকালের আলো সুস্পষ্ট হতেই অস্পষ্ট হতে থাকে রাতের তারারা। তারার দল আস্তে আস্তে চলে যায় চোখের অন্তরালে। এমন সময় টেলিফোন বেজে ওঠে। এত সকালে আবার কে ডাকতে যাবে! ফোন ধরতেই ওপার থেকে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে আসে, বলে-
-আজ ঈদ মনে আছে তো। সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে সকাল ৭টার মধ্যে রিসিপশনে চলে আসবেন। ৮টায় ঈদের জামাত শুরু হয়ে যাবে।
ঈদের পোশাক হিসেবে গতানুগতিক প্যান্ট-শার্টের ওপর কালো রঙের একটি কোট চাপিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। এবার একটি টুপি হলে দিব্যি চালিয়ে দেয়া যাবে।
রাস্তায় অনেকের মাথায় টুপি দেখেছি। নেপালি টুপি। নেপালিরা অমুসলিম। অমুসলিমদের টুপি মাথায় দিয়ে মুসলিমদের নামাজ হবে কি না আমার জানা নেই। না জেনে না বুঝে নেপালি টুপি মাথায় দিয়ে নামাজে দাঁড়ালে- যদি জামাত থেকে বের করে দেয়, তাহলে মানসম্মান থাকবে না। ভাবতে ভাবতে রিসিপশনে পৌঁছেই দেখি, সবার মাথায় টুপি, পরনে লম্বা পাঞ্জাবি-পাজামা। জানতে পারলাম, এখান থেকে মসজিদ অনেক দূর। আসা-যাওয়া ট্যাক্সি ভাড়া ৬০০ টাকা। আমাদের রিজার্ভ করা পর্যটনের গাড়ি আসবে ৯টায়। ৯টার গাড়িতে মসজিদে গিয়ে ৮টার জামাত পাওয়া যাবে না। ঠিক হলো ট্যাক্সি করেই যাব। হোক না অতিরিক্ত ব্যয়- আল্লাহ কি দেখবে না! অতিরিক্ত ব্যয়ের ফজিলতও অতিরিক্ত পাওয়া যাবে। দুই ট্যাক্সি এসে হাজির। ৩০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম মসজিদের পাশে। আমরা যে মসজিদে গেছি, সে মসজিদের সামনে বামদিকে একটি বটগাছ। বটগাছের গোড়া গোলাকার করে পাথর দিয়ে বাঁধানো। বাঁধানো পাথরের ওপরে পাঁচ-সাত জন অস্ত্রধারী পুলিশ। কারণ হিসেবে জানা গেল, এ দেশে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ হিন্দু, ৮ শতাংশ বৌদ্ধ, অবশিষ্ট ৫ শতাংশ মুসলিম, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য জাতি- মুসলমান মোটেও ছিল না। রাজা রতœাপাল ভারত থেকে অনেক মুসলমানকে ব্যবসায় করার জন্য আহ্বান জানান। নেপালি সেনাদের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা দেয়ার জন্যও ইন্ডিয়া থেকে কিছু মুসলমান নেপাল যায়। তারা শ্রম, শিল্প, কৃষি ও ব্যবসায়ে জড়িত হয়ে ওখানেই রয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে তারা নাগরিকত্ব লাভ করে। তাদের অনুপাত ২.৭ শতাংশ। স্থানীয় জনসংখ্যার তুলনায় তাদের সংখ্যা এতই নগণ্য যে, স্থানীয়রা তাদের অস্তিত্ব আমলেই আনে না। আমেরিকার টুইনটাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে মুসলিম সম্প্রদায় লাইমলাইটে চলে আসতে শুরু করে। নড়েচড়ে বসে সবাই। নতুন করে মূল্যায়ন শুরু হয় তাদের। লাদেনি ছুরতের কাউকে দেখলে আতঙ্কিত হয়ে- পাশে বসতেও চায় না। নেপালে সংখ্যালঘু মুসলমানরা খুবই নিরীহ, তাই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তাদের সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখত। এখন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। জঙ্গিবাদের সাথে কোনো না কোনোভাবে ওদের সম্পর্ক-যোগাযোগ আছে কি না খতিয়ে দেখে। আজ ঈদ উপলক্ষে মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ কয়টি স্থানে জমায়েত হচ্ছে। সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝির ফলে কিছু একটা হয়ে গেলে এর দায়ভার সরকার এড়াতে পারবে না- সেসব দিক চিন্তা করেই প্রত্যেক মসজিদ ঈদগাহে মুসলমানদের নিরাপদ রাখতেই অস্ত্রধারী পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করেছে সরকার।
পোখারা ভ্যালি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মিয়া পাঠান মসজিদ। কারুকার্যখচিত আট মিনারবিশিষ্ট ছিমছাম ছোট মসজিদ। সামনে তিন ফুট উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপরে দু’ফুট গ্রিল। মসজিদের দক্ষিণ দিকে ওপরে আরবি ও হিন্দি অক্ষরখচিত টপযুক্ত কলাপসিবল গেট। গেট দিয়ে ঢুকতেই বামদিকে উঁচু করে নির্মিত আজানের মিম্বর। মিম্বরের ওপর ছোট একটি গম্বুজ, সব মিলিয়ে মিয়া পাঠান এক নয়নাভিরাম মসজিদ। কলাপসিবল গেটের বাইরে একপাশে দু’জন দাড়িওয়ালা লোক। একজনের দাড়ি সাদা, অপরজনের কালো। দু’জনের গায়েই পুরোনো কালো কোট ও জীর্ণশীর্ণ উলেন জামা। একজনের মাথায় বাদামি বর্ণের রুমি টুপির ওপর পুরোনো রুমালের বাঁধা পাগড়ি। অন্যজনের মাথায় নেপালি টুপি। যাই হোক, নেপালি টুপিতে মুসলমানের নামাজে বাধা নেই। ওদের কাছে জানতে চাই।
-ইয়ে টুপি কাঁহা মিলেগা?
-ওধারসে মিলেগা
লোকটি যে ধারসে দেখালো ওধারসে তিনটি দোকান। দুটো দোকান খোলা। খোলা দোকানের দোকানদারের কাছে টুপি চাইতেই ইশারায় বন্ধ দোকানটি দেখিয়ে দেয়। রাস্তায় দাঁড়ানো এক লোকের সহায়তায় বাড়ি থেকে দোকানদারকে ডেকে আনা হয়। দোকানদার একজন মহিলা। মহিলা দোকান খুলে জানতে চায়। ক্যায়সা টুপি চাহিয়ে, ঢাকা কা টুপি অর নেপালি টুপি?
-নেপালি টুপি চাহিয়ে।
আমরা আরো কয়েকজন নেপালি টুপি খরিদ করি। নেপালি টুপি মাথায় দিতেই ঈদ ঈদ অনুভূতি লাগতে শুরু হয়। আমাদের দেখে আশপাশের বেশ কিছু লোক জমায়েত হয়। আগত লোকদের কাছে জানতে পারি ঈদের জমায়েত আরম্ভ হবে সাড়ে ১০টায়। নামাজ শুরু হতে হতে ১১টা বেজে যায়। বিলম্বের কারণ হিসেবে জানা যায়, সারা পোখারায় দুটো মাত্র মসজিদ ও ঈদগাহ। এর মধ্যে একটি মিয়া পাঠান এলাকায়; অপরটি সুফিনোডোঙ্গা মান্দারপুর এলাকায়, নাম চিপলে ডোঙ্গা ঈদগাহ। ২০-২৫ কিলোমিটার দূর থেকে মুসলমান সম্প্রদায় এখানে নামাজ পড়তে আসে। এক জমায়েতেই শেষ হয় ঈদের নামাজ, তাই নামাজ বিলম্বে পড়া হয়। নামাজের এখনো তিন ঘণ্টা বাকি। ভাড়া করা ট্যাক্সি। এতক্ষণ রাখলে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দিতে হবে। হোটেল রিসিপশনিস্টের প্রতি সবাই রাগ করলাম। ওই বেটা নামাজের সময়টা বললে প্রাইভেট গাড়ির জন্য এক হাজার ২০০ টাকা বাড়তি খরচ হতো না। ওরা এসব কাজে পারসেন্টেজ পায়। ১০ কিলোমিটার রাস্তা আসা-যাওয়ার জন্য ট্যাক্সিপ্রতি ৬০০ টাকা ভাড়া হতেই পারে না- এখান থেকে পারসেন্টেজ পাবে হোটেল রিসিপশনিস্ট। কী আর করা, খালি মাথায় বের হয়ে টুপি মাথায় দিয়ে আবার হোটেলে ফিরে আসি। এর মধ্যে আমাদের সঙ্গীয় নারী ও শিশু পর্যটকরা ঈদের সাজে সজ্জিত হয়ে রয়েছে। সালাম কালাম করার মতো বেটা পুরুষ পাচ্ছে না। আমাকে সামনে পেয়ে পা ছুঁয়ে…
-দুলাভাই সালাম।
বলেই দাঁড়ায় সালামির জন্য। সালামিসহ ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। এর মধ্যে আমাদের নির্ধারিত পর্যটনের গাড়ি এসে হাজির হয়। পোখারার বিশেষ বিশেষ স্থান দেখব আজ। নামাজে অর্ধেক দিন অতিবাহিত হলে টার্গেটকৃত সব জায়গা দেখা সম্ভব হবে না। সম্ভব না হলেও ঈদের নামাজ বন্ধ রাখা যাবে না- এ বিষয়ে একমত হই সবাই। ঠিক হয়, মহিলা-শিশুরাও আমাদের সাথে যাবে। পাশে গাড়িতে বসে তারাও দেখবে অমুসলিম দেশের মুসলিমদের ঈদ জমায়েত।
সাড়ে ১০টায় আবার পৌঁছলাম মিয়া পাঠান। আমার ধারণা ছিল, মসজিদের ভেতরেই ঈদের নামাজ হবে। সকালের চিত্র থেকে মনে হয়েছে ক’জনই বা মুসলমান হবে ঈদের জামাতে! এখন দেখছি ভিন্ন চিত্র। মসজিদ সংলগ্ন পশ্চিম দিকে প্রকা- মাঠ, মাঠের দক্ষিণ দিকে দুই ফুট উঁচু পাকা দেয়াল। দেয়ালের ভেতরে মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণে পৃথকভাবে দেয়াল দিয়ে ঈদগাহের নির্ধারিত স্থান। কাঁচা চুনা অপরিপক্ব হাতে দেয়ালে লাগানো হয়েছে।
ইমাম সাহেবের ডান ও বামদিকের দেয়ালে টানানো হয়েছে রঙিন কাগজ। ইমামের সামনে দেয়ালের কিছু অংশ সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। সাদা কাপড়ের দু’পাশে দুটো মখমলের রঙিন জায়নামাজ। যার একটির ওপরে রাখা হয়েছে মাইকের লাউডস্পিকার। নির্ধারিত ঈদগাহ ভরে বাইরের মাঠ লোকজনে ভরতে শুরু করেছে। ছিমছাম পাতলা চেহারার কম বয়সের একজন মাওলানা বয়ান করছেন। হিন্দি ও আরবিমিশ্রিত বয়ানরত হুজুরের নাম মাওলানা একরাম উদ্দিন। নামাজ পড়াবেন পেশ ইমাম মাওলানা শের আলী। আমি নেপালি টুপি পরে নামাজ পড়তে সঙ্কোচ বোধ করেছিলাম। আর এখন দেখছি মাওলানা সাহেবের মাথায়ও নেপালি টুপি।
সকালে এসে মসজিদ ও ঈদগাহের দক্ষিণ দিকে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটি ড্রেন দেখেছিলাম। এখন দেখছি, ড্রেনের দুধারে বসে মুসল্লিরা অজু করছে। আসলে ওটি ড্রেন ছিল না। কাঠমা-ু থেকে পোখারা আসার পথে পাশের পাহাড়ে বহু ঢাল-খাল গিরিখন্দ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে দেখেছি। পাহাড়িরা গড়িয়ে পড়া এসব পানি ইচ্ছেমতো এদিক-ওদিক নিয়ে সেচকার্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অপরাপর সমস্যার সমাধান করে থাকে। পানির গতির তীব্রতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে। নামাজে বসে কথা হলো এক প্রৌঢ় নেপালি মুসলমানের সাথে। মুসলমান লোকটি জানায়, এ দেশে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। মিয়া পাঠান মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। আমেরিকার টুইনটাওয়ার ধ্বংসের জন্য মুসলিমদের দোষারোপ করে। তখন থেকে এখানকার মুসলমানরা অস্বস্তিতে আছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঈদগাহের নির্ধারিত স্থান লোকজনে ভরে গিয়ে পেছনের মাঠও লোকজনে ভরে যায়। নামাজ শুরু হয়। নামাজ শেষে খুতবা পাঠের সময় একজন অশীতিপর বৃদ্ধ বসা থেকে ঢলে পড়ে যায়। পাশের লোকজন ধরতে না ধরতেই দৌড়ে আসে ক’জন পুলিশ। পুলিশ ধরাধরি করে লোকটিকে বাইরে নিয়ে যায়। নামাজ ও দোয়া শেষ করে বের হওয়ার সময় দেখি, অনেক ভিক্ষুক। ওরা রাস্তার দু’ধারে থালা-বাটি পেতে সাহায্য চাইছে। আরো দেখি সম্পূর্ণ গেরুয়া (হলুদ ও কমলা রঙ) পোশাকে সজ্জিত হয়ে একইভাবে ১০-১২ জন লোক সাহায্য ওঠাচ্ছে। জানা গেল, ওরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক। সাহায্য দাতারা উভয় সম্প্রদায়ের সাহায্যপ্রার্থীদের সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে।
রাস্তার গাড়িতে আমাদের মহিলা ও শিশু পর্যটকরা ছিল। এক সাথে এত বেশি পর্যটক দেখে অনেকে জিজ্ঞাসা করে-
-মুল্লুক কাঁহা
-বাংলা মুল্লুুক।
-ও আচ্ছা, ঢাকা কা আদমি হ্যায়।
বুঝতে পারলাম বাংলাদেশের চেয়ে, ঢাকা নামটি তাদের কাছে বেশি পরিচিত।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক, E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com