শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ন

অপপ্রচার কাঙ্ক্ষিত নয়

মো. সাখাওয়াত হোসেন :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৫ মে, ২০২৩

রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী বিরোধী দল সরকারের বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক বিশ্বে এটি একটি চিরায়ত রীতি। এই রীতির অনুশীলন এ দেশেও হয়ে থাকে। কিন্তু সরকার ও দেশ বা রাষ্ট্রের বিরোধিতা এক নয়। তাছাড়া যখন বিরোধিতার সঙ্গে মিথ্যাচারের মিথষ্ক্রিয়া দেখা যায়, তখন সেটি রাজনীতির সংস্কৃতিতে অশোভন চর্চার আবির্ভাব ঘটিয়ে থাকে। বেশ কয়েক বছর ধরে নিরপেক্ষ জায়গা থেকে যদি কেউ অবলোকন করেন, তাহলে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের মধ্যকার অপ্রীতিকর ও গ্রহণযোগ্য নয় এমন আচরণের বহিঃপ্রকাশ রাজনীতির মাঠকে একটি অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। এত দিন বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, সত্যের সঙ্গে মিথ্যার অপলাপ এবং সেই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে আরো কতকসংখ্যক উপযাজক যোগ করে ব্যাপারটিকে পর্যায়ক্রমে অত্যুক্তির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এ ধরনের কর্মকা- দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশের সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যে পরিবেশিত হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে বিরুদ্ধাচরণ, বাদানুবাদ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। শুধু বিরোধিতা করার জন্যই বিরোধিতা করা কাম্য নয়। আবার কারো কারো মধ্যে পাকিস্তানপ্রীতি লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তান দেউলিয়া ঘোষণার পরেও এ দেশের কেউ কেউ পাকিস্তানের প্রতি তাদের প্রেম নিবেদন করছেন। এর বিপরীতে অনেকেই কথা বলছে না, কিংবা নীরব থাকছে। এ ধরনের দুঃসহ সংস্কৃতি বাংলাদেশের সমাজে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরনের পরিস্থিতি কোনোক্রমেই কাম্য নয়।
অপপ্রচারের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, মিথ্যা ও বানোয়াট বিষয়টিকে প্রচার করা, যাতে কারো বদনাম হয় বা অপযশ হয় এবং একশ্রেণির মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ সহজতর হয়। বাংলাদেশে কিছুদিন যাবত এই অপপ্রচারের একটি ট্রেন্ড চলে আসছে, যেখানে দেখা যায় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতেও একটি গোষ্ঠী দ্বিধাবোধ করছে না। অপপ্রচারের বিষয়টি নানাবিধ কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে, যেমনÍব্যক্তিগত জিঘাংসা ও হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টা, স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার হীন চেষ্টা, দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের উদিগরণ, রাজনৈতিক মেরুকরণ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা, সরকারকে বিভিন্ন খাতে অপদস্ত করা, জনমনে সরকারবিরোধী প্রচারণার ইন্ধন জোগানো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভাগ বসানোর দুরভিসন্ধি প্রভৃত কারণে সাধারণত অপপ্রচার করা হয়ে থাকে। অপপ্রচারের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। হুজুগে বিশ্বাসী কিংবা বিজ্ঞাপনে বিশ্বাসী এমন শ্রেণির মানুষের সংখ্যা এ দেশে রয়েছে, যারা এ ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়। সত্যি কথা বলতে, একটা ব্যাপারে শেষাবধি সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সত্য-মিথ্যার মিশেল যাচাই-বাছাই করার পরই এ ব্যাপারে ভূমিকা পালন করা উচিত। এ দেশে এমন নাগরিক রয়েছেন খুব কমই, যারা খবরের পেছনের খবরকে সত্যানুসন্ধান করে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চেষ্টা করেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যা শোনেন কিংবা সংবাদমাধ্যমে যেভাবে প্রচারিত হয়, তা মুখ বুজে বিশ্বাস করার মানুষের সংখ্যাই এ দেশে বেশি।
আর যদি অপপ্রচারসংক্রান্ত সংবাদটি কোনো আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। খবরের বিষয়বস্তু ও শিরোনাম সম্বন্ধে অবগত না হয়েই ব্যাপারটি নিয়ে একটি হুলস্থূল কা- বেঁধে যায়। এ ধরনের সংবাদে বিরোধী পক্ষরা ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। তারা মনে করে, সংশ্লিষ্ট অপপ্রচারকে জনগণের সামনে নিয়ে আসতে পারলে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা তথা সরকারবিরোধী জোট গঠন করা সম্ভব হবে। তারা জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করে, বিশ্ব মিডিয়ায় নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশিত হয়ে থাকে। কেননা, এ দেশের জনসাধারণ মিডিয়া জগতের অভ্যন্তরীণ কালচার নিয়ে ততটা অবগত নয়। এই অবগত না হওয়াটাকে সুযোগ হিসেবে তারা কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং কিছু ক্ষেত্রে অল্প সময়ের জন্য হলেও এই পলিসিতে তারা সফল হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে গুজবের ন্যায় অপপ্রচারগুলো যখন আবিষ্কৃত হয়ে সত্য উদ্ঘাটিত হয়, তখন অপপ্রচার ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিন্তু এই বিষয়টাকে জোরের সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোতে যে ব্যাপারগুলোতে কম গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়, এমন আইটেমেই বিশ্ব মিডিয়া যখন ধারাবাহিকভাবে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে, তখন অনুসন্ধান করে দেখতে হবে এই সংবাদের ভেতরে অন্য কিছু লুক্কায়িত আছে কি না। অন্য কিছু বলতে, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ইন্ধন ও সংবাদের পেছনে একটি বিরাট অঙ্কের টাকা লগ্নি করাকে বোঝানো হয়। মিডিয়া জগতের মাফিয়া তথা মিডিয়া গ্যাংয়ের কথাও বলা হয়ে থাকে, যদিও বেশির ভাগ মিডিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রযোজ্য নয়। তবে এ ধরনের প্রভাবশালী একশ্রেণির গোষ্ঠী বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছানুযায়ী শাসকগোষ্ঠীকে জিম্মি করা তথা বেকায়দায় ফেলার মানসে মিডিয়া হাউজগুলো পরিচালনা করা থাকে বলে অভিযোগ নতুন নয়।
যারা বিশ্ব মিডিয়া, বিশ্বরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে খোঁজখবর রাখেন এবং জানেন, তারা নিশ্চিয় অবগত আছেন যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সঙ্গে কতিপয় মিডিয়ার মালিকও জড়িত। দুঃখজনকভাবে এবং মিডিয়া সন্ত্রাসবাদসহ মানি লন্ডারিং, হোয়াইট কলার ক্রাইম, ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, মানবপাচার, মাদক পাচারসহ ভয়াবহ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত মর্মে ইতিপূর্বে সংবাদ বেরিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশসংক্রান্ত খবরাখবর বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশের ব্যাপারে যেসব অনুঘটক ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার অবহিত হওয়ার জন্যই সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের জনসাধারণ কোনো ধরনের গুজব, মিথ ও অপপ্রচার সম্পর্কে ভেবেচিন্তে যাচাইবাছাই সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সুযোগ পাবে। অপপ্রচারের সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত থাক, তাদের পূর্বের ইতিহাস উদ্ঘাটন করলে দেখা যাবে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কোন না কোন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক কাজে লাগিয়ে অপপ্রচারকারীদের প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটনের প্রয়োজন রয়েছে। পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এসংক্রান্তে দায়ীদের পরিচয় নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনে তাদের রাজসাক্ষী করে প্রকৃত বিষয়টার সুরাহা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তা না হলে এই অপপ্রচারের নষ্ট সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। আসলে আমাদের গোড়ায় হাত দেওয়া উচিত। এ দেশে এখনো অনেকেই আছে, যারা অপপ্রচারকে শুধু বিশ্বাস করেই বসে থাকে না, অপপ্রচারকে উপজীব্য করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে কাজ করে থাকে এবং এতে অনেকে ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে।
অতএব, এদেশীয় যেসব লোক গুজব বা অপপ্রচার তৈরিতে সহযোগিতা করে, তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগগুলো সামনে এনে বিচারকাজ ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। বিচারের মাধ্যমে অন্যদের কাছে বার্তা যেমনভাবে পৌঁছানো যায়, ঠিক তেমনিভাবে কারোর বারংবার অপরাধ করার প্রবণতা থেকে নিবৃত করা যায়। সুতরাং, অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে অপপ্রচার অনেকাংশে লাঘব করা সম্ভব হয়।
পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতালাভের পর থেকেই এ দেশের ওপর শকুনের চোখ পড়েছে। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে দেশটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে, কোনো ক্ষেত্রে তারা কিয়দংশ সফল হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী কোনো অপপ্রচার প্রচারিত হলে এর একটা রেশ কিছুদিন হলেও থেকে যায়। এই সাপেক্ষে যুক্তি খ-াতে সময়ের প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিষয়গুলোতে তেমন নজরদারি প্রদান করেন না। অপপ্রচারের কারণে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, কূটনৈতিক সম্পর্কে অনাস্থার সৃষ্টি হয়। মোদ্দাকথা হচ্ছে, অপপ্রচারকারীদের যত শিগিগর সম্ভব চিহ্নিতকরণ সাপেক্ষে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তবে বাংলাদেশ সরকার অপপ্রচারকারীদের স্বার্থ হাসিলের আগেই কূটনৈতিক দক্ষতায় সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা দিয়ে যথাযথ জবাব দেওয়ায় অপপ্রচার তেমন কোনো কাজে আসছে না। বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে এবং নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছেন। অপপ্রচার সত্ত্বেও বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্যাপী। সর্বোপরি, অপপ্রচার রোধকল্পে এবং অপপ্রচারকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার তাগিদে ইন্টেলিজেন্সি উইংকে কাজে লাগিয়ে তদন্তকাজ সম্পন্ন করে জনগণের সামনে দেশবিরোধী চক্রের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে। লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com