শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৫:২৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
বিশ্বমানের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে : রাষ্ট্রপতি রাসূল (সা.)-এর সীরাত থেকে শিক্ষা নিয়ে দৃঢ় শপথবদ্ধ হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে—ড. রেজাউল করিম চৌদ্দগ্রামে বাস খাদে পড়ে নিহত ৫, আহত ১৫ চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ কোরবানির পশু বেশি আছে : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রাজনীতিবিদেরা অর্থনীতিবিদদের হুকুমের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখতে চান: ফরাসউদ্দিন নতজানু বলেই জনগণের স্বার্থে যে স্ট্যান্ড নেয়া দরকার সেটিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার মালয়েশিয়ার হুমকি : হামাস নেতাদের সাথে আনোয়ারের ছবি ফেরাল ফেসবুক হামাসের অভিযানে ১২ ইসরাইলি সেনা নিহত আটকে গেলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অর্থ ছাড় গাজানীতির প্রতিবাদে বাইডেন প্রশাসনের ইহুদি কর্মকর্তার লিলির পদত্যাগ

কেন আজও আল মাহমুদ সেরা

সায়ীদ আবুবকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৫ মে, ২০২৩

কালের নায়ক মূলত কবিরাই। সিনেমার নায়ক নায়িকাদেরকে নিয়ে কিংবা ক্রীড়াজগতের নক্ষত্র কিংবা রাষ্ট্রনায়কদেরকে নিয়ে বিশ্বমিডিয়া নাচানাচি করলেও মানুষ এসব বিখ্যাত মানুষের কথা বেশি দিন মনে রাখে না, এমনকি গল্পকার-ঔপন্যাসিকদের কথাও আমজনতার মস্তিষ্ক থেকে উধাও হয়ে যায়, মনে থাকে কেবল কবিরাই। কারণ মানুষ তার জীবনের সাথে মিলে যায় এরকম কথার উদ্ধৃতি দিতে ভালোবাসে, প্রবাদতুল্য বাক্য বলতে ভালোবাসে। কবিদেরই কাজ এরকম অমূল্য পঙক্তি নির্মাণ করা কারণ তারা অমর কথার নির্মাতা। হোমার গতায়ু হয়েছেন তিন হাজার বছর আগে; এত লম্বা সময় পরও আজও হোমার আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে জরুরি; এখনও হোমার বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের পাঠ্য শুধু নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরও নিত্য সঙ্গী। প্রিয়জন মারা যায়, আমরা কাঁদি, চোখের পানিতে আমাদের বুক ভেসে যায়, এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, অর্ধ দিন, তারপর একসময় ঠিকঠিকই আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হয় ক্ষুধার কাছে হোমারের এই অমর পঙক্তি বলতে বলতে: ঐঁহমবৎ রং ংঃৎড়হমবৎ ঃযধহ ংড়ৎৎড়.ি আবার অনেক সময় আমরা দেখেশুনেও ঠিকমতো দেখি না, ভয়াবহ ভুল করে বসি এইভাবে, হয়তো মানুষ চিনতে না পেরে আমরা ভালো মানুষকেই গলা ধাক্কা দিয়ে বসি আর কোলাকুলি করতে থাকি খুনী-ডাকাত-চোর-বদমাশদের সাথে; তখন আক্ষেপের সাথে আমরা উচ্চারণ করে উঠি সফোক্লিসের এই বাণী:ণড়ঁ যধাব বুবং নঁঃ ুড়ঁ ফড় হড়ঃ ংবব. এইভাবে আড়াই হাজার বছর আগেকার কবি সফোক্লিস আমাদের প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
পঞ্চাশের কবি আল মাহমুদের প্রয়োজনীয়তা কি ফুরিয়ে গেছে আমাদের দৈনন্দিন, সামাজিক কিংবা জাতীয় জীবনে? কোনো ভাষার প্রকৃত কোনো কবির প্রয়োজনীয়তা কখনও ফুরিয়ে যায় না। একজন কবি যদি উৎকৃষ্ট কিছু কবিতা রচনা করতে সক্ষম হন, তিনি আর লিখুন বা না লিখুন, বেঁচে থাকুন কিংবা মারা যান, তার প্রয়োজনীয়তা সবসময়ই থেকে যায় তার জাতির কাছে কিংবা বিশ্বমানুষের কাছে। আল মাহমুদও এর ব্যতিক্রম নন।
বর্ষার দিন। এমন দিনে পিঠাপুলি কার না ভালো লাগে। সুতরাং গরীব বাড়ির ছেলেমেয়ে তাদের মায়ের কাছে আবদার করছে তাদের জন্য যেন পিঠা বানিয়ে দেয়, তারা ঝালপিঠা খাওয়ার আব্দার করছে। জবাবে মা বলছে:
কোথায় পাবো লঙ্কাবাটা,
কোথায় আতপ চাল?
কর্ণফুলীর ব্যাঙ ডাকছে
হাঁড়িতে আজকাল।
এই যে এক জীবন্ত চিত্র আঁকলেন আল মাহমুদ তার কবিতায় ক্ষুধার্ত বাংলাদেশের, এর আবেদন কোনোদিন ফুরাবে না। ফলে আল মাহমুদের প্রয়োজনীয়তাও কখনও ফুরাবে না। তাই অনশ্বর আল মাহমুদ আমাদের জাতীয় জীবনে। জীবন ঘষে যখন আগুন জ্বালান কোনো কবি তার কবিতায়, তখন তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না, জনতার মন তিনি জয় করে ছাড়েনই, রাতারাতি না হলেও, দুদিন পর কি দু’বছর পর।
আল মাহমুদ সেইসব দুর্লভ কবির একজন, যিনি তরল প্রেমের কবিতা লিখে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চাননি কখনও। অত্যন্ত সময় সচেতন এ কবি দেশ, মাটি ও মানুষ নিয়েই মূলত যার কাজ, সব সময় দাঁড়িয়েছেন স্বদেশ ও স্বজাতির পাশে তার দুঃখে ও সুখে। বায়ান্নর সেই ভাষা আন্দোলনের সময়ও ছিলেন কবি-
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।
কোথায় নেই আল মাহমুদ? ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানেও আছেন তিনি অমর পঙক্তির নির্মাতা হয়ে-
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দোর জানালা
তুলবো কেন খিল?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল।
আল মাহমুদ আছেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও। স্বাধীনতার জন্য তিনি দেশ ছেড়েছিলেন, সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। কলমযুদ্ধেও তিনি থেমে থাকেননি এদেশের স্বাধীনতার জন্যে। তার সব অমর পঙক্তি এর উজ্জ্বল সাক্ষী:
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
আল মাহমুদ কখনও কখনও হয়ে ওঠেন ঈশপের মতো মহাকালদর্শী। তিনি বিদ্রোহীর মতো ভাঙতে থাকেন ঈশপের মিথও। ঈশপের মিথ্যাবাদী রাখালের কাহিনী ভেঙে তিনি নির্মাণ করেন নতুন এক মিথ। আত্মভোলা তার জাতিকে তিনি শোনাতে থাকেন তার সেই নতুন মিথের কথা
আমরা কেউ তার শেষ ডাকে সাড়া দেইনি যেদিন
সত্যি এসেছিল বাঘ। মৃত্যুর নখে ছিন্নভিন্ন হলো সেই ডাক।
সেই কাতর অনুনয় এখনও আমার কানে লেগে আছে।
আজ ভাবি, ছেলেটার কি তবে আগাম মৃত্যুর গন্ধ টের
পাওয়ার কোনো অস্বাভাবিক ইন্দ্রিয় ছিলো? যার দুর্গন্ধে
শত তিরস্কার উপেক্ষা করে সে চিৎকার করে উঠতো
বাঘ বাঘ বলে, ঠিক কবির মতো?
আহা, আবার যদি ফিরে আসতো সেই মিথ্যেবাদী ছেলেটা
জনমত ও তিরস্কারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রান্তরের চারণের মতো
বলে উঠতো, মৃত্যু এসেছে, হে গ্রামবাসী
– হুশিয়ার!
আল মাহমুদ তার “মিথ্যাবাদী রাখাল কাব্যগ্রন্থে এই যে নতুন মিথের জন্ম দিলেন, তা তাকে অমর করে রাখবে যুগ যুগ ধরে। যারা মানুষের জন্যে, জাতির জন্যে অমর পঙক্তি রচনা করে যান, তারা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকেন। জাতীয় কবিরা কখনও বিস্মৃত হন না তাদের জাতির কাছ থেকে। আল মাহমুদও হবেন না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com