‘এক খান চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভইরা চলিতেছে / মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্ত্রী বানাইয়াছে’- আবদুর রহমান বয়াতি তার লেখা বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় এই গানে দেহের ভিতরের এমন একটা ঘড়ির কথা বলেছেন, যেটি এক মুর্হূতের জন্য বন্ধ হলে মৃত্যু নিশ্চিত। মানবশিশু মায়ের জঠরে আসার পর থেকে নিয়ে এই পৃথিবীর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ঘড়ি সচল থাকে। বয়াতি রূপক অর্থে যাকে ঘড়ির সাথে তুলনা করেছেন তা আসলে কোন সাধারণ ঘড়ি নয়,এটি মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হার্ট বা হৃদপিন্ড। গুরুত্ব বিবেচনা করেই হার্টের অসুখকে খুবই মারাত্মক বলে মনে করা হয়।
উপমহাদেশের চিকিৎসা-জগতে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ভারতে নন-ইনভেসিভ কার্ডিওলোজি হৃদরোগ চিকিৎসাপদ্ধতির প্রবর্তক ডা. বিমল ছাজেড় বাংলাদেশ সফরে এসে প্রতিবেদকের সাথে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাক্ষাৎকালে এ প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি তার পকেটের বলপেনটি হাতে নিয়ে বলেছিলেন, এরমধ্যে একটি স্প্রিং বা রিং আছে এর দাম কত? বড়জোর এক টাকা থেকে পাঁচ টাকা। কিন্তু যখন কেউ আপনাকে বলবে আপনার কোন প্রিয় জনকে বাঁচাতে হলে আমার কাছে যে রিংটি আছে তা লাগবেই। কত আপনি এটির দাম কত টাকা দিতে রাজি হবেন? আমি যা চাইব্, আপনি অবশ্যই আপনার সর্বস্ব বিক্রি করে হলেও দিতে রাজি হবেন। ক্রাণ এর সাথে আপনার প্রিয় মানুষটির জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। তিনি আরো জানান, এক শ্রেণির চিকিৎসক এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিক মানুষের জীবন নিয়ে এভাবেই ব্যবসা করছে। তিনি তার দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূল্যে হার্টের একটি রিং আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু এক শ্রেণির চিকিৎসক এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিক তাদের ব্যবসার ক্ষতির আশংকায় রোগীর অভিভাবকদের বুঝাতেন,‘এর মান খুব খারাপ। কয়েক মাস পরেই নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি…। সূত্রে প্রকাশ,বর্তমানে বছরে অসংক্রামক রোগের কারণে যে-সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে দেশে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ হৃদরোগী। অন্যদিকে প্রতি বছরই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। চিকিৎসা নিয়েও চলছে এমন বাণিজ্য। যা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন মনে করলেও দুঃখজনক হলেও সত্য,কেউ এ ধারায় পরিবর্তন আনতে পারেছেন না।
এ ধারা এখনো চলেছে: এ ধারা এখনো বন্ধ হয়নি বলে একটি সহযোগী দৈনিকের সাংবাদিককে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক। জাতীয় দৈনিকটির সূত্রে প্রকাশ,বাজারে তিন ধরনের রিং পাওয়া যায়। এগুলোর দাম ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। এগুলোর মান প্রায় একই রকম। রোগীকে নিয়ে উদ্বেগে থাকা স্বজনরা রিং যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যে না গিয়ে বিষয়টি ডাক্তারদের ওপরই ছেড়ে দেন। আবার অনেকেই ‘ভালো হবে’ মনে করে বেশি দামের রিং পরাতে রাজি হন। অনেক সময় রোগীর হার্টের অবস্থা ভালো থাকলেও কর্তৃপক্ষের চাপে ধানমন্ডির ওই হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে রিং বসানোর তাগিদ দেন।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোন কোন হাসপাতালে হার্টের চিকিৎসার জন্য ভালো বিশেষজ্ঞ না থাকলেও অর্থের লোভে সার্জারি চিকিৎসক দিয়ে হার্টে রিং পরানো হয়। এটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং আইনের পরিপন্থী। এ হাসপাতালের মতোই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এমন অনৈতিক রিং বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে সেখানকার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা হার্টের চিকিৎসা ঘিরে বাণিজ্য সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।
হৃদরোগ ছাড়াও এসব হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা ভুল চিকিৎসা ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসার অবহেলায় রোগীর মৃত্যু, বেশি বিল আদায়, বিলের জন্য মরদেহ আটকে রাখা, রোগ নির্ণয়ে নিম্নমানের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ ইকো মেশিন, ক্যাথল্যাবে যন্ত্রপাতি সংকটসহ বহু অভিযোগ এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ক্যাথল্যাবে ভেন্টিলেশন সুবিধা না থাকা, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ও পরীক্ষাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এসব বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাপ দিয়ে সমঝোতা করা হয়। আবার অনেকেই আইনি ঝামেলায় যেতে চান না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত। এজন্য সরকারের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, কমিশন বাণিজ্য ডাক্তারদের স্বভাব নষ্ট করে দিয়েছে। আগে কেবল ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল টেস্ট থেকে কমিশন দেওয়া হতো, ওষুধ কোম্পানি থেকে দেওয়া হতো গিফট। এখন একশ্রেণির কার্ডিওলজিস্ট রীতিমতো রিং থেকেও কমিশন খান, যা শুনে আমরাই লজ্জিত। প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। এসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিপুলসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ায় কিছু কিছু অভিযোগ আসে। তারা অভিযোগগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেন। গ্রিনলাইফ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মাইনুল আহসান বলেন, সরকার নির্ধারিত দামেই রিং বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকে আমাদের লাভ নেই। চিকিৎসকদের কমিশনের ব্যাপারে আমরা অবগত নই।
ডলারের দাম বাড়ার অজুহাত: ডলারের বাড়তি দাম দেখিয়ে কয়েকটি কোম্পানির রিং ও পেসমেকারসহ প্রতিটি সরঞ্জামের দাম ১৪ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) অনুমোদনের ভিত্তিতে তা কার্যকর হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কার্ডিয়াক কেয়ার লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডলার সংকট ও দাম বৃদ্ধির কারণে এতদিন লোকসান দিয়েই আগের দামই নেওয়া হচ্ছিল। এখন বাধ্য হয়ে বাড়াতে হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২৫টি প্রতিষ্ঠান ৪৭ ধরনের রিংয়ের নিবন্ধন সরবরাহের অনুমতি নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল মালেক বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ থাকলে আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসা সেবার পরিসর অপর্যাপ্ত: জনসংখ্যার তুলনায় হৃদরোগ চিকিৎসাসেবা পরিসর খুবই অপর্যাপ্ত। জাপানের কারিগরি সহায়তায় ১৯৮১ সালে দেশে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। জন্মগত সেকান্ডাম টাইপ আট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (হৃৎপিণ্ডের ওপরের কক্ষে ছিদ্র) আক্রান্ত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এক কলেজ শিক্ষার্থী এ সার্জারির প্রথম সুবিধাভোগী। বর্তমানে বছরে অসংক্রামক রোগের কারণে যে-সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে দেশে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ হৃদরোগী। অন্যদিকে প্রতি বছরই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। এসব রোগীর মধ্যে বিশেষ করে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমে আক্রান্তদের বেশি মৃত্যু ঘটে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে না পারার কারণে।
দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা সুবিধার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার বিষয়টি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা ও প্রকাশনায় উঠে এসেছে। এমনই একটি গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে। ‘ফোর ডিকেডস অব কার্ডিয়াক সার্জারি ইন বাংলাদেশ: আ নোবেল জার্নি দ্যাট স্ট্যাটেড উইথ দ্য হেল্প অব জাপান’ শীর্ষক এ গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে কার্ডিয়াক সার্জারি শুরু হলেও বর্তমানে যে সুবিধা রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। ১৭ কোটি মানুষের জন্য এ অপর্যাপ্ত সুবিধা জনগণের চিকিৎসা চাহিদা মেটাতে পারছে না। যদিও শুরুর পর তুলনামূলকভাবে কার্ডিয়াক সার্জারি ও চিকিৎসা কেন্দ্র বেড়েছে। ১৯৯৭ সালে দেশে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় দুইশর বেশি। ২০১৬ সালে এসে তা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং ২০১৯ সালে প্রায় ১৩ হাজারে দাঁড়ায়। এসব কার্ডিয়াক সার্জারির মধ্যে করোনারি আর্টারি বাইপাস গ্রাফট (সিএবিজি) ৬৭ শতাংশ, ভালভ প্রতিস্থাপন ১২ শতাংশ ও জন্মগত সমস্যার কারণে ২০ শতাংশ। ২০১৭ সালে দেশে হৃদরোগে অস্ত্রোপচারের সুবিধা ছিল ২৫টি চিকিৎসা কেন্দ্রে, যা ২০২২ সালে ৩২টিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে চারটি সরকারি, একটি সেনাবাহিনীর ও একটি স্বায়ত্তশাসিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৬টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সুবিধার ৯৫ শতাংশই রাজধানী কেন্দ্রিক। ঢাকা বিভাগের ২৪টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিভাগের চারটি হাসপাতাল, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেট বিভাগে একটি করে হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা রয়েছে।
ওই গবেষণার মুখ্য গবেষক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসাইন বলেন, ‘আমাদের দেশে হৃদরোগী কম তা ভাবার সুযোগ নেই। অসংক্রামক রোগে যারা মারা যান, তাদের তিনজনের একজনই হৃদরোগী। সারা বিশ্বেও তাই। আমরা সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারছি না। যারা দরিদ্র তারা হৃদরোগের চিকিৎসার কথা চিন্তা করতে পারেন না বা এসব রোগ নিয়ে ভাবেন না। আমাদের দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের বিপরীতে ৬২টি কার্ডিয়াক সার্জারি হয়ে থাকে। সুবিধার অভাব ও আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে কার্ডিয়াক সার্জারি কম হয়।’
জানা যায়, দেশের সর্বোচ্চসংখ্যক কার্ডিয়াক অস্ত্রোপচার করা প্রতিষ্ঠানের নাম ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। যেটি সরকারি নয়। কার্ডিয়াকে সর্বোচ্চ অস্ত্রোপচার এখানেই হয়। ২০১৯ সালে মোট অস্ত্রোপচারের ২২ শতাংশই হয়েছে এ হাসপাতালে। এরপর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) হয়েছে ১১ শতাংশ এবং বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতাল করেছে ১০ শতাংশ। ঢাকার বাইরে হৃদরোগের অস্ত্রোপচার ২০০৪ সালে প্রথম শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনূস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২৫০ জন কার্ডিয়াক সার্জারি রয়েছেন। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এনআইসিভিডি ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয়।
এনআইসিভিডির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘দেড় থেকে দুই দশকে দেশের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হৃদরোগের চিকিৎসা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনো মাধ্যমিক পর্যায়ের হাসপাতালে এসব সেবা নিশ্চিত করা না গেলেও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে সেবা দেয়া হয়। তবে সরকারি চারটি প্রতিষ্ঠানে কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয়। শুধু গত বছরই সারা দেশে ১ লাখ ৪ হাজারের বেশি হৃদরোগের বিভিন্ন প্রসিডিউর হয়েছে। ধীরে ধীরে দক্ষ লোকবল তৈরি হচ্ছে। যত এনজিওগ্রাম হবে তত সংখ্যক কার্ডিয়াক সার্জারি করা যাবে। কার্ডিয়াক সার্জারি একটি সমন্বিত কাজ। কার্ডিয়াক সার্জারি করতে একটি টিম প্রয়োজন হয়। তাতে কার্ডিয়াক সার্জন, কার্ডিওলজিস্ট, অ্যানেসথিওলজিস্ট, টেকনোলজিস্ট থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ দল প্রয়োজন হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স মেডিসিন বলছে, কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি বা হার্ট সার্জারি হলো হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে জড়িত যেকোনো অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি। হার্টের সমস্যার চিকিৎসার জন্য কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি সব সময় প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসকরা হার্ট অ্যাটাক, রক্ত জমাট বাঁধা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, সরু ধমনী খোলা, রিং ও ভালভ প্রতিস্থাপন, জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যার জন্য অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিতে পারেন। কার্ডিওভাসকুলার সার্জারির জন্য কার্ডিওলজিস্ট, কার্ডিয়াক সার্জন, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও অন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে প্রকাশিত অপর একটি গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে কার্ডিয়াক সার্জারিতে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। ভারতে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে অস্ত্রোপচার হচ্ছে ১১৩টি, পাকিস্তানে ১০৯টি, শ্রীলংকায় ২৬৮টি এবং নেপালে ৬৯টি। সেখানে বাংলাদেশে প্রতি ১০ লাখে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় ৬৮টি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘হৃদরোগ চিহ্নিত করার জন্য রোগ নিরীক্ষার সুবিধা বা প্রাথমিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা, তা আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। তবে এ বিষয়ে আমাদের কোনো গাইডলাইন নেই। করোনারি সিনড্রোম বা হার্ট অ্যাটাকের রোগী এলে প্রথমেই কী করতে হবে, তা নিয়ে আমরা গাইডলাইন তৈরি করতে চাচ্ছি। এ বিষয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ যারা আছেন তাদের সাহায্য নিয়ে এটা তৈরি করা হবে। এতে আমাদের চিকিৎসকরা বুঝতে পারবেন ওই মুহূর্তে কী করা উচিত। হার্ট অ্যাটাক যেকোনো সময় হতে পারে। মানুষ ঠিকমতো হাসপাতালেও পৌঁছতে পারে না, ওষুধ পায় না। ওই ব্যবস্থাগুলো আমরা নেয়ার চেষ্টা করব।’
চলতি মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন ২০২০-এ বলা হয়েছে, হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্তদের মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৯ সালে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৬০২ জন অ্যাকুইট মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন বা হার্ট অ্যাটাকে (হৃৎপিণ্ডের একটি অংশ পর্যাপ্ত রক্ত পায় না) আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০২০ সালেও এ রোগে মারা গেছেন সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৬৪ রোগী।
এনআইসিভিডির কার্ডিয়াক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম মনজুরুল আলম বলেন, ‘হার্ট অ্যাটাক হলে এনজিওগ্রাম করা হয়। এতে ব্লক ধরা পড়লে যদি দেখা যায় সেখানে রিং লাগানো যাচ্ছে না, রক্তনালির গোড়া বন্ধ বা একটা নালিতে অনেকগুলো ব্লক যাতে রিং কাজ করবে না। সেক্ষেত্রে আমরা বাাইপাস সার্জারি করি। এনজিওগ্রাম ছাড়া বলার কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন ধরনের কার্ডিয়াক সার্জারি রয়েছে। তবে হৃদরোগ মানেই সার্জারি করতে হবে তা নয়।’ বাংলাদেশ জার্নাল অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থরোসিক অ্যানেসথিওলজির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে সারা দেশে ১১ ধরনের কার্ডিয়াক সার্জারি হয়েছে, সংখ্যায় যা নয় হাজারের বেশি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থরোসিক অ্যানেসথিওলজিস্টের (বিএসিএটিএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এটিএম খলিলুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে যারা বুকে ব্যথা নিয়ে আসছেন, তাদের সঠিক রোগ নিরীক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে সিংহভাগই কোনো না কোনো হৃদরোগে আক্রান্ত। সে অনুযায়ী, আমাদের চিকিৎসার সুবিধা কম। একই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও কম। যারা নতুন চিকিৎসক তৈরি হচ্ছেন তাদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।’
চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ‘হৃদরোগের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ অন্যতম। এ রোগগুলো নিজেও একটা রোগ আবার বিভিন্ন রোগকে প্রভাবিতও করে। ডায়াবেটিস রোগীদের চার গুণ বেশি হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, স্থূলতাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কার্ডিয়াক সার্জারি বা বিশেষায়িত সেবাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। তবে শুরু থেকেই হৃদরোগ কমিয়ে আনা যায়। প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকলে চিকিৎসা পর্যন্ত যাওয়া লাগবে না।’ তিনি আরো বলেন,‘আমাদের স্বাস্থ্যের বাজেট অপ্রতুল। এ বাজেটের ৩ থেকে ৫ শতাংশও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় খরচ করা হচ্ছে না। এটা বাড়ানো উচিত।’ পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, সিন্ডিকেট বাণিজ্য ভাঙতে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর সাথে সাথে বিরোধী দল, চিকিৎসক, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া মানুষের জীবন নিয়ে অসাধু চক্রের খেলা বন্ধ করা সম্ভব নয়।