বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় থাকা গভীর নি¤œচাপটি ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে দুই নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এটি গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১২২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মোখা ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে’ বলে ধারণা করছেন আবহাওবিদরা। ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো: এনামুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখা হতে পারে সুপার সাইক্লোন’। ঘূর্ণিঝড়টি টেকনাফ এবং মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গতিপথ কোনদিকে: আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্তমান গতি প্রকৃতি অনুযায়ী এগোলে বা দিক না পাল্টালে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোখা ১৪ মে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। বিভিন্ন গ্লোবাল মডেল বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল পলাশ বলছেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগ ১৪ মে সকাল ৬টার পর থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলে আঘাত করার আশঙ্কা রয়েছে। ঘুর্ণিঝড় কেন্দ্র দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ও পিছনের অংশ সন্ধ্যা থেকে ১৫ মে সোমবার ভোর পর্যন্ত উপকূল অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে।’
‘এটি স্থলভাগে ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত করার সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বলোচ্ছাসের উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোও ঝুঁকিতে রয়েছে‘ বলে মন্তব্য করেন পলাশ।এছাড়া ভূমিধসের আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন এই আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ। অন্যদিকে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলছেন, এখন যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে আসছে ঘূর্ণিঝড়টি। ‘বাংলাদেশে কক্সবাজার অ লে কিছু প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে এটা টেকনাফের ওপর দিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে যে গতিপথ দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশটা টেকনাফ ছূঁয়ে যাবে। হয়তো টেকনাফের একটু দক্ষিণ দিক অতিক্রম করে মিয়ানমারের দিকে চলে যেতে পারে,’ বলছিলেন কর্মকার।
মোখা’র সম্ভাব্য শক্তি: বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের দু’টি মৌসুম রয়েছে। একটি বর্ষার আগে অর্থাৎ এপ্রিলের শেষ থেকে মে মাসে এবং আরেকটি বর্ষার পড়ে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে।
সমরেন্দ্র সরকার বলছেন, ‘এই দুইটা সময়ে সি সার্ফেসের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। বায়ুম-লের বিন্যাস এই সময়ে ফেভারেবল থাকে। সূর্য যখন এক গোলার্ধ থেকে যখন আরেক গোলার্ধে যায় তখন এই সময়টায় বঙ্গোপসাগরের ওপরে থাকে। ফলে বঙ্গোপসাগর অতি উত্তপ্ত হয়ে যায়।’ এ কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে যে পানিটা আছে সেটা সুপ্ত তাপ নিয়ে বায়ুম-লে প্রবেশ করে। এটা বায়ুম-লে যত প্রবেশ করবে ঘূর্ণিঝড় তত শক্তিশালী হয় এবং এ কারণে এই সময়ে ঘূর্ণিঝড় বেশি শক্তিশালী হয় বলে উল্লেখ করেন সমরেন্দ্র কর্মকার। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর মার্চ ও এপ্রিল মাসে মধ্য ও উত্তর বঙ্গোপাসগরে কোনো নি¤œচাপ লঘুচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়নি। চলতি বছরে সর্বপ্রথম এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সে কারণে পুরো মৌসুমটায় সূর্য থেকে আগত রশ্মি পুরোটাই বঙ্গোপসাগরের পানি উত্তপ্ত করেছে, ফলে প্রচুর শক্তি সি ত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের পানিতে।
গত কয়েক বছর ধরে যে কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে এ ঘূর্ণিঝড়টি সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পানির মধ্যে। এবং এখন বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার যে মানচিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে বুঝা যাচ্ছে, যত উত্তর দিকে ঘূর্ণিঝড়টি অগ্রসর হবে তত বেশি এটি উত্তপ্ত পানির সংস্পর্শে আসবে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি ধরে রাখার জন্য যে তিনটি প্রধান শর্ত প্রয়োজন তার তিনটিই আছে এবারের ঘূর্ণিঝড়ে। সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রির ওপরে এবং সমুদ্রে সি ত শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে আছে, ফলে ঘূর্ণিঝড়টি আকারে বড় হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত করার সময় এটি অত্যন্ত তীব্র ঘূর্ণিঝড় কিংবা তীব্র ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।
একগুচ্ছ নির্দেশনা: ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় কন্ট্রোল রুম খুলেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বৈঠক করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ মে) পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুমের নম্বর ০১৩১৮-২৩৪৫৬০ এবং গ্রিন রোডে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুমের মোবাইল নম্বর ০১৭৭৫-৪৮০০৭৫। এসব নম্বরে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও সেবা পাওয়া যাবে। য়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ও সচিবের রুটিন দায়িত্বে মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে আগাম প্রস্তুতিমূলক সভা হয়। দেশের দক্ষিণা ল, দক্ষিণ-পশ্চিমা ল এবং দক্ষিণ-পূর্বা ল এলাকায় ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার আশঙ্কা থাকায় সভায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কবলিত জেলার নাজুক এলাকা চিহ্নিত করে দ্রুত এলাকাবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হবে। জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় রেডক্রিসেন্ট ও ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা নিতে হবে বলে সভায় নির্দেশনা দেওয়া হয়। সভায় আরও নির্দেশনা দেওয়া হয়, ঘূর্ণিঝড় কবলিত জেলার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ চিহ্নিত করে ওই এলাকায় পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োজিত করতে হবে। ওইসব এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারকে প্রকল্প এলাকায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশনা দিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় মজুত জিও ব্যাগ/সিনথেটিক ব্যাগের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অন্যান্য জেলা থেকে জিও ব্যাগ সংগ্রহ করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বাঁধ ভেঙে এলাকায় পানি প্রবেশ করলে বাপাউবোর পক্ষ থেকে বোতলজাত পানি এবং শুকনো খাবার সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার এবং নৌযান প্রস্তুত রাখতেও বলা হয়েছে।
সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের এলাকায় বাপাউবোর সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাইট পরিদর্শনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার জেলা-উপজেলার সব পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সার্বক্ষণিকভাবে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কোনো অবস্থাতেই কর্মস্থল ত্যাগ করা যাবে না বলেও সভায় জানানো হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার নির্বাহী প্রকৌশলীরা স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন, যাতে প্রয়োজনের সময় জনবলসহ পর্যাপ্ত সহায়তা পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সংসদ সদস্য পর্যায়ে অবহিত করতে হবে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ফলে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও বৈঠকে উল্লেখ করা হয়।