শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪২ অপরাহ্ন

পাট ও পাটপণ্যের গুরুত্ব

মোহাম্মদ শাহজালাল
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

প্রতি বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ) উদ্বোধনকালে একটি পণ্যখাতকে ‘বর্ষপণ্য’ হিসেবে নির্বাচন করা হয়ে থাকে। ইতোপূর্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, কৃষি ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য এবং তথ্য প্রযুক্তি সেবা খাতকে যথাক্রমে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২২ সালের জন্য বর্ষপণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বর্ষপণ্য ঘোষণার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, একটি নির্দিষ্ট পণ্য বা সেক্টরের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা। এর উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে পণ্যটি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ এবং টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। ডিআইটিএফ-এর ২৭তম সংস্করণের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের বর্ষপণ্য হিসেবে ঘোষণা করেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সোনালি আঁশকে কৃষিপণ্য হিসেবে গণ্য করে বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশিত হয়। এভাবেই উন্নয়ন ও বৈচিত্র্যায়নের জন্য পাটপণ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে নেতৃস্থানীয় পাটকলের মালিকানা মূলত বাওয়ানী, আদমজী, ইস্পাহানি ও দাউদ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন সরকারি পর্যায়ে অনেক ছোট ছোট ইউনিটও ছিল। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালে সরকার এসব পাটকল সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিজেএমসি প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে দেশে অন্তত ২২০টি বেসরকারি পাটকল চালু রয়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশের বাজারে রপ্তানি করার জন্য অনেক কোম্পানি পাটজাত পণ্য তৈরি করছে।
আমাদের স্কুল জীবনে শিক্ষকগণ বাংলাদেশের সোনালি আঁশের উপর অনুচ্ছেদ বা প্রবন্ধ লিখতে বলতেন। পরীক্ষার জন্য তা মুখস্থও করতে হতো। রপ্তানির বিপরীতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হওয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হিসাবে বিবেচিত হতো পাট। অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি শিক্ষামূলক গুরুত্বও ছিল বিধায় পাট পণ্যকে সুন্দর একটি নাম ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ মূল্যবান পণ্যটির রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে না। সারাবিশ্বে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে প্লাস্টিকের উত্থান পাটজাত পণ্যের অবস্থানকে ম্লান করে চলেছে। এই ধারা চলতে থাকলে আমরা স্বাস্থ্য, পরিবেশ বিপর্যয়সহ রপ্তানিতে দুর্বল টার্নওভার থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে পারব না।
পাটের সবকিছুই কোন না কোনভাবে ব্যবহার উপযোগী। পাট পাতা, ছাল ও পাট কাঠি এতটাই প্রয়োজনীয় যে গ্রামাঞ্চলে তা কারোর অজানা নয়। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ হতে পাট থেকে উৎপাদিত পণ্যের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ। পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজারের আকার ২০২২ সালে ২.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ১৪.৩% বার্ষিক চক্রবৃদ্ধির হারে ২.৫৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে মর্মে এক বাজার পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। করোনা মহামারির পর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবুও পাটজাত ব্যাগের বাজারের আকার ২০২৭ সালে ১০.৪% হারে বেড়ে ৩.৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে (ঔঁঃব নধমং এষড়নধষ গধৎশবঃ জবঢ়ড়ৎঃ-২০২৩)। বাংলাদেশের জিডিপিতে পাট শিল্পের অবদান ১% এবং সামগ্রিক রপ্তানি আয়ে এর অবদান ৩%। আমাদের দেশে সাদা পাট এবং তোষা পাট (গাঢ় রঙের) উভয় ধরনের পাটই জন্মে। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রথম অবস্থানে রয়েছে (২০২২)। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২০২১ পর্যন্ত যথাক্রমে ৯৫, ১০৮, ১৪৬, ১৩৩, ৭২, ৫৯, ৩১০ হাজার মেট্রিক টন পাট উৎপাদিত হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমঘন হওয়ায় এ খাতে উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনে কর্মসংস্থানের পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশ পাট থেকে ২৮৫টি পণ্য উৎপাদন করে এবং সেগুলো বিশ্ববাজারে রপ্তানি করছে। প্রধান প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে কাঁচা পাট, পাটের হেসিয়ান, ব্যাগ, বস্তা, দড়ি, জুট টুয়াইন, জুট ইয়ার্ন, কার্পেট, ক্যাপ, ম্যাট, কার্পেটের ব্যাকিং কাপড়, প্যাকিং সামগ্রী, মোড়কীকরণ কাপড়, ট্যাপেস্ট্রি, ফলের ঝুড়ি, ওয়ালেট, কলমদানি, মানিব্যাগ, পর্দা, চেয়ারের আচ্ছাদন, পাটের চাদর, পাটের সুতার বর্জ্য, তারপলিন, ক্যানভাস, হাইড্রোকার্বন মুক্ত পাটের কাপড়, জিওটেক্সটাইল, পাল্প ও কাগজ, গৃহস্থালী পণ্য এবং নন-ওভেন টেক্সটাইল ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলে পাট কাঠি জ্বালানির একটি বড় উৎস। পাট পাতা থেকে তৈরি স্বাস্থ্যকর পানীয় এখন একটি রপ্তানি সম্ভাবনাময় পণ্য, যার উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে এ পানীয় কার্যকর মর্মে ইতোমধ্যেই পাথমিকভাবে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে পাট দিয়ে শাড়ি, শার্ট, পাঞ্জাবি, জুতা, স্যান্ডেল, ব্রিফকেস, ফাইল, ফোল্ডার, ডায়েরি ইত্যাদিও তৈরি হচ্ছে।
পাটজাত যে কোনো দ্রব্য এর ব্যবহারকারীকে দেয় প্রকৃতির ছোঁয়া। প্রকৃতিকে ভালবাসার অনুভূতি জাগায়। কচি চারাগুলো অত্যন্ত কোমল এবং সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। স্বাদ ও ঔষধি গুণ বিবেচনায় এ সব্জিটি বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। পাটের ব্যাগ এবং দড়ি খুব শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী পণ্য। পচনশীলতা ও জীবাণুবিয়োজ্যতা গুণসমৃদ্ধ হবার কারণে পাট মৃত্তিকা-বান্ধব এবং পাটজাত পণ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য। পাট গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এদের অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হয় না। পাটের তৈরি ফ্যাশনেবল পণ্য মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করে। পাট চাষের মৌসুমে এক হেক্টর জমির পাট ১১ টন পর্যন্ত অক্সিজেন নির্গত করে বায়ুকে বিশুদ্ধ করে। এটি মাটির গুণমান উন্নত করে এবং কীটপতঙ্গ ও রোগের ঝুঁকি কমায়। পাট চাষে খুব বেশি সার, ভেষজনাশক ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। ভবিষ্যতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, অধিক ও উন্নত উৎপাদনের জন্য শুধুমাত্র শস্যাবর্তন প্রক্রিয়ার সুপারিশ করা হয়ে থাকে। পাট দিয়ে তৈরি চমৎকার স্যুভেনির দেশ-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়।
এবার দেখা যাক, কেন প্লাস্টিকের পরিবর্তে পাটের সাথে আমাদের সম্পর্ক নিবিড় করা উচিত। গবেষণা বলছে, প্রতি বছর প্লাস্টিকজাত ব্যাগ তিমি, ডলফিন, কচ্ছপ এবং পেঙ্গুইনসহ প্রায় ১ লক্ষ জলজ প্রাণীকে হত্যা করছে। ভুলবশত তারা খাবার হিসেবে প্লাস্টিকের ব্যাগ গিলে ফেলে। প্লাস্টিকের ব্যাগ বায়োডিগ্রেডেবল নয়। এটা সম্পূর্ণভাবে পচতে ২ হাজার বছর সময় লাগতে পারে মর্মে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। এর অর্থ হলো আমাদের পরবর্তী ২০ প্রজন্মের জীবদ্দশায়ও কোন প্লাস্টিক পণ্যকে পচতে দেখা যাবে না। প্লাস্টিক তৈরি করতে ৬০-১০০ মিলিয়ন ব্যারেল তৈল লাগে, যা প্রতিনিয়ত পেট্রোলিয়ামের বৈশ্বিক মজুদ হ্রাস করছে। প্লাস্টিকের মাধ্যমে বিষাক্ত রাসায়নিক ছড়ানোর ফলে আলসার, হাঁপানি, মস্তিষ্কের প্রদাহ, স্থূলতা, হৃদরোগ এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে। প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকের ব্যাগ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে এবং বায়ু, পানি ও মাটিকে দূষিত করে। প্লাস্টিক পণ্য প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খলের ক্ষতিসাধান করে। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের বর্জ্য বেশি হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্লাস্টিক পরিহার করা উচিত। ৬৭.৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে, আনুমানিক ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্রতি বছর মহাসাগরে প্রবেশ করছে। ভয়ঙ্কর খবর হল, ১০টি মহাসাগরের প্লাস্টিক দূষণকারীর মধ্যে ৯টি দেশই এশিয়ার। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ বিস্তৃত পরিসরে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে থাকে। পাট এবং পাটজাত পণ্যের প্রধান রপ্তানি যথাক্রমে ৫৩০৩, ৫৩০৭, ৫৩১০, ৫৬০৩ এবং ৬৩০৫ এইচ.এস কোডসমূহের অধীনে সম্পাদিত হয়ে থাকে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছর থেকে শুরু করে গত ৫ বছরে এসব কোডের বিপরীতে রপ্তানি আয় অর্জিত হয় যথাক্রমে ১২৮৯.৯৫, ১০৭৮.৮০, ১১২৯.০৩, ১৫৩৭.০২ এবং ১৬০১.৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উৎপাদন, স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায়ী পরিমন্ডলে অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হলে এ আয় বহুগুণে বৃদ্ধি করা অত্যন্ত যৌক্তিক বিষয়।
বাংলাদেশ হতে বিশ্বের ১০০টিরও বেশি গন্তব্যে পাটজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। সিংহভাগ আমদানিকারক দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, চীন, জিবুতি, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, আইভরি কোস্ট, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, পাকিস্তান, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভিয়েতনাম। বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক অংশীদার হচ্ছে ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত মিজুরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম এবং অরুণাচল প্রদেশ। ভারত সরকার কর্তৃক নতুন করে আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক এসব গন্তব্যে রপ্তানির উপর কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে মর্মে বাজার বিশ্লেষকগণ মনে করেন। আশা করা যায়, এ সমস্যার সমাধানে উভয় দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপ কাক্সিক্ষত ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে। পাট ও বহুমুখী পাটজাত পণ্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ খাতের রপ্তানি উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ২০২১-২০২৪ সালের রপ্তানি নীতিতে সংশ্লিষ্ট খাতটিকে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পাটজাত পণ্যকে জনপ্রিয় করতে এবং এ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে বিদেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে পাটপণ্যের মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। ইপিবি’র নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাধারণ এবং পণ্য-ভিত্তিক মেলায় অংশগ্রহণ বিদেশি ক্রেতা সন্ধানের একটি বলিষ্ঠ প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে থাকে। রপ্তানি নীতি অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারকদের অনুকূলে কম সুদের হার/সার্ভিস চার্জে ঋণ মঞ্জুর করতে উৎসাহিত করবে। উৎপাদন, বৈচিত্রায়ণ এবং রপ্তানি প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গৃহীত ও পরিচালিত হতে পারে। এর মাধ্যমে এ খাতের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং সেগুলো হতে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা সহজতর হবে। সরকার বৈচিত্র্যময় পাটজাত পণ্যের নকশা কেন্দ্র (ফবংরমহ পবহঃৎব) স্থাপনে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পাট চাষের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও ব্যবহারে সহায়তা প্রদান করা হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য সরকারিভাবে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। সোনালী আঁশকে (পাট)-কে কৃষিপণ্য হিসাবে ঘোষণা করার ফলে এ পণ্যের কাস্টম সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতায় এর উপযুক্ত শ্রেণিবিন্যাসকরণে অস্পষ্টতা দূরীভূত হবে। বাণিজ্য, পাট ও বস্ত্র, কৃষি মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/সংস্থা নানামুখী কর্মপরিকল্পনা, সমীক্ষা, কর্মসূচি, প্রকল্প, সেমিনার, কর্মশালা, মেলা এবং প্রচারমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে যাতে আরও বেশি পাট চাষে জনসচেতনতা তৈরি হয়। পাট পণ্য একদিকে দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করবে অন্যদিকে রপ্তানি অব্যাহত রাখবে। রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের সোনালি আঁশের গৌরবময় ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে অভিন্ন মিশন নিয়ে কাজ করা সময়ের দাবি।
২০১০ সালে পাটের জিনোম বা জীবন-নকশা আবিষ্কৃত হলেও পাটের জাতে আধুনিকায়নের বিষয়টি এখনও ব্যাপকতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে পাটের ফলন ও আঁশের মান উন্নতকরণ করা অত্যন্ত জরুরি। পাটজাত পণ্য উৎপাদন খাতের আকার অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং তা আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নয়। মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নত বাজারের জন্য উচ্চ মূল্যের পণ্য উৎপাদিত হয় না। আমাদের উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পাটপণ্যের বাংলাদেশি ব্র্যান্ড বিকাশে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়নি। বিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় বিপণনের আন্তর্জাতিক মাধ্যমসমূহের সাথে অনেক উদ্যোক্তাই পরিচিত নন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রামীণ এলাকায় উৎপাদনশীলতা প্রায়ই কমে যায়। কিছু উদ্যোক্তা সার, সেচ, বীজ, কীটনাশক ও পরিবহনের বর্ধিত ব্যয়কে এজন্য দায়ী করেন। আবার কিছুসংখ্যক পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়াকে এ শিল্পের অনগ্রসরতার কারণ হিসেবেও দেখছেন। প্রতিনিয়ত বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনে যাওয়াও সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ যাই হোক না কেন, জাতীয় স্বার্থে পাটের উৎপাদন ও পাটজাত পণ্য নিয়ে আমাদের ব্যবসায়ের বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে অনেক গবেষণা হওয়া সত্ত্বেও পাট চাষি এবং মধ্যস্বত্বভোগী-বিপণনকারীদের মধ্যকার বিস্তর ব্যবধান এখনও স্পষ্ট। বিভিন্ন গবেষণার সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রায়শই দীর্ঘমেয়াদী বিষয় হিসাবে প্রতীয়মান হয়।
জাতীয় পাট নীতি-২০১৮ এর মাধ্যমে কিছু কৌশলগত অগ্রাধিকারের ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে; যেমন, মানসম্পন্ন পাটের উৎপাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটজাত পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, পাটকলের আধুনিকায়ন এবং পাটজাত পণ্যের বাজার অন্বেষণ ইত্যাদি। এর মাধ্যমে পাটের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণ এবং বিশ্বব্যাপী নতুন বাজারে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হতে এবং নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পাটজাত পণ্য রপ্তানির বিপরীতে এখন ৭% হতে ২০% পর্যন্ত নগদ সহায়তা/ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। উক্ত নীতিমালায় টেকনোলজি আপগ্রেডেশন ফান্ড গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব বিষয়কে সামনে রেখে প্রান্তিক পর্যায়ে এখন আমাদের উৎপাদকবৃন্দকে অধিক পরিমাণে পাট চাষের পদক্ষেপ নিতে এবং ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে একটি অনুকূল ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা সুফলদায়ক হতে পারে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো সম্ভাব্য ক্রেতা ও বাজার সম্পর্কে তথ্য প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। (সমাপ্ত) লেখক: পরিচালক, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com