ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে তার ছিঁড়ে গেছে। ফলে গত রবিবার থেকে বুধবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন রয়েছে শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন। পাশাপাশি খাবার ও পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনও সহায়তা না পৌঁছানোয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ। এখানে তিনটি ওয়ার্ডে বসবাস করছেন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষজন। এর মধ্যে আট হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চার দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। বেশিরভাগ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সেগুলো এখনও মেরামত করা হয়নি। অধিকাংশ পরিবারে দেখা দিয়েছে খাবার ও পানির সংকট।’ তবে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন, তাদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখার তা-বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া ও পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পপাড়া। শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ায় বসবাস করেন মো. সালাম। তার পরিবারে চার সদস্য। পাশেই থাকেন দুই মামা মো. ইউনুছ ও মো. আলম। বোন জায়েদা বেগম ও চাচা আমান উল্লাহর পরিবারও একই পাড়ায় থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাদের কারও ঘরে খাবার নেই, রয়েছে পানির সংকট। গত মঙ্গলবার বিকালে জালিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে কথা হয় সালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। এলাকায় বিদুৎ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। খাবার নেই, পানির সংকট। কী করবো, বুঝতেছি না।’ সালামের মামা মো. ইউনুছ বলেন, ‘আট সদস্যের পরিবার আমার। ঝড়ে ঘরবাড়ি তছনছ হয়ে গেছে। থাকার জায়গা নেই, ঘরে খাবার নেই, এলাকায় পানির সংকট। তিন দিন ধরে নেই বিদ্যুৎ। ঘরবাড়ি মেরামত করতে পারছি না।’ শাহপরীর দ্বীপের ডেইলপাড়ার আশ্রয়কেন্দ্রে একদিন একরাত কাটিয়েছেন মোহাম্মদ আলী। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর তছনছ যায় তার বাড়িঘর। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে দেখেন, বাড়িঘরের অস্তিত্ব নেই। রান্নাঘরের সরঞ্জামও খুঁজে পাননি। পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে এখন খাবার ও পানির সংকটে ভুগছেন আলী।
পশ্চিমপাড়া গ্রামের আবদুল আলীম চা দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। তার একমাত্র সম্বল সেই দোকানটি ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে নিজের বসতঘরটিও। এখন তা ঘরেও খাবারের সংকট আছে।
ঘরে খাবার নেই, পানির সংকটে আছি উল্লেখ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের মাঝারপাড়ার বাসিন্দা নুর আয়েশা বেগম বলেন, ‘ছনের ছাউনি দিয়ে ঘরে বসবাস করতাম। ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে। বোনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছি। সকাল থেকে না খেয়ে আছি। খোলা ভিটায় প্রচ- রোদে পুড়ে যাচ্ছি। রিলিফের সন্ধানে যাবো, সেই শক্তি নেই।’ একই অভিযোগ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা আবদুল মালেক বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের আট হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ মানুষের ঘরে খাবার নেই। পানির সংকট, নেই বিদুৎ। খুব খারাপ অবস্থায় আছি আমরা।’ সরকারি ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আবদুল মালেক। তিনি বলেন, ‘যেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সংকট, সেখানে আমাদের মুড়ি দেওয়া হচ্ছে। এটি আমাদের সঙ্গে তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। শুনতেছি, ত্রাণ দেবে, এখনও পাইনি। তবে তার আগে আমাদের পুনর্বাসন করা দরকার।’ আমার ওয়ার্ডে ১২০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমনটি জানিয়েছেন সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (শাহপরীর দ্বীপ) মেম্বার আবদুস সালাম। তিনি বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে এসব মানুষের খাবার ও পানির সংকট রয়েছে। আমরা প্রাথমিভাবে হাজার খানেক মানুষকে সহায়তা দিয়েছি। বাকিদের সহায়তা দেওয়ার কার্যক্রম চলছে।’
মেম্বার আবদুস সালাম আরও বলেন, ‘আগে থেকেই এখানে সুপেয় পানির অভাব ছিল। জালিয়াপাড়া, ক্যাম্পপাড়া ও ঘোলার পাড়ার টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত। দূর-দূরান্ত থেকে পানি আনতে হয়। কিন্তু দূরে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। চার দিন ধরে বিদুৎ নেই। এখানকার মানুষের অবস্থা খুব খারাপ।’ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বুধবার ত্রাণ সহায়তা ও ঘর মেরামতের জন্য ঢেউটিন পাঠানো হয়েছে বলে জানালেন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য তালিকা করেছি উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আজ থেকে কাজ শুরু হয়েছে। সেন্টমার্টিনের ক্ষতিগ্রস্ত ১২০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দাদেরও ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য ঢেউটিন ও নগদ অর্থ দেওয়া হবে।’