স্থানীয়দের সাথে ক্যার্বোল বাহিনীর সংঘর্ষ হলো। এক সময় ক্যার্বোল কামান দিয়ে আক্রমণ শুরু করতে থাকে কালিকট বন্দরে। অবশেষে জামোরিনের বাহিনীর সাহসিক নৌযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ক্যার্বোল তার জাহাজ নিয়ে পালিয়ে গেল।
কিন্তু পর্তুগিজরা থামার পাত্র নয়। ১৫০২ সালে আবারো তারা অভিযান চালালো। এবারের অধিনায়ক হলেন আমাদের ইতিহাসের নায়ক ‘ভাস্কো দ্য গামা’। ২০টি জাহাজ ও ৮০০ সুশিক্ষিত সামরিক সৈন্য নিয়ে কালিকট দখল করতে রওনা হলেন। শুরু হলো ভাস্কো দ্য গামার বিভীষিকাময় ধ্বংসযজ্ঞের এক কলঙ্কিত অভিযান। ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেই যে জাহাজেরই দেখা পেলেন তিনি, সেগুলো লুটপাট ও ধ্বংস করতে লাগলেন। জলদস্যুর মতোই তার নিষ্ঠুরতা ও নৃশংস অত্যাচার অব্যাহত গতিতে চলতে লাগলো। সব থেকে নির্মম কাজটি তিনি এই সময়েই করে বসলেন। মক্কা থেকে হজযাত্রীদের নিয়ে কয়েকটি নিরস্ত্র জাহাজ ফিরে আসছিল। জাহাজগুলোকে ভাস্কো দ্য গামা আটক করে মালামাল সব লুট করে নেন। সৈন্যদের প্রতি তার কঠিন আদেশ ছিল, জাহাজ থেকে যেন কোনো মানুষকে তুলে আনা না হয়। তারপর সেগুলোতে আগুন দেয়া হয়। জাহাজের সকল যাত্রী পুড়ে কয়লা হয়ে যেতে লাগলো। তাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু ছিল। কেউ কেউ আবার সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। ডুবে মরলো অনেকেই। আর যারা ভেসে ছিলেন, তাদেরকে সৈন্যরা কুপিয়ে কুপিয়ে মারলেন। ভাস্কো দ্য গামা পরম আনন্দে সেই দৃশ্য উপভোগ করলেন! কালিকটে পৌঁছানোর আগেই ভাস্কো দ্য গামার নির্মমতার খবর নগরময় ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মনে পর্তুগিজদের সম্পর্কে ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি হলো। কালিকটে পৌঁছে ভাস্কো দ্য গামা রাজাকে জানান, শহর থেকে সকল মুসলিমকে বের করে দিতে হবে। রাজা তাতে রাজি হলেন না। ফলশ্রুতিতে উপকূলে রাজার সাথে যুদ্ধ বাধলো। ভাস্কো দ্য গামার কামানের গোলার মুহুর্মুহু আঘাতে শহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। তারা কিছু ভারতীয় জাহাজ আটক করে কর্মীদের নাক, কান ও হাত কেটে অপমানের প্রতিশোধস্বরূপ রাজা জামোরিনের কাছে পাঠালেন। ভাস্কো দ্য গামার অত্যাচার বেশিদিন টিকলো না। এরপর কালিকটের হিন্দু বণিক, আরব বণিক সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজার পেছনে এসে দাঁড়ালো। পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে তাদের এই ঐক্য ও দৃঢ় সংকল্প শেষদিন পর্যন্ত টিকে ছিল। রাজা জামোরিন বুঝতে পারলো, এই যুদ্ধ কেবল একদল বণিকের বিরুদ্ধে নয়, স্বয়ং পর্তুগিজ রাজার বিরুদ্ধে। তারপরও কালিকটের বণিকরা সকলে একত্রিত হয়, সেখানে বসবাসকারী আরব বণিকরাও একজোট হয় রাজার পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। কালিকটের নৌ-সেনাপতি কাশিম ঠিক করলেন কৌচিনের কাছেই তাদের মোকাবিলা করতে হবে। শুরু হয় এক অসম লড়াই কামানের বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ারের। একের পর এক কালিকটের জাহাজ পর্তুগিজ কামানের গোলায় আক্রান্ত হতে লাগলো। কিন্তু হাল ছাড়লো না তারা। সেদিন নৌ-সেনাপতি কাশিমের রণচাতুর্য ছিল অসামান্য। তিনি ছোট ছোট ক্ষিপ্রগতির জাহাজগুলো এমনভাবে পরিচালনা করতে লাগলেন যাতে ভাস্কো দ্য গামার কামানের গোলা কিছুতেই লক্ষ্য ভেদ না করতে পারে। এমন অভিজ্ঞতা ভাস্কো দ্য গামার কখনো হয়নি। অবশেষে তিনি যুদ্ধ ক্ষান্ত দিয়ে পালিয়ে গেলেন। এরপরও কালিকট ও ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারেনি। পরে মিশরসহ অনেক আরব দেশ তাদেরকে সহায়তা করলেও পর্তুগিজরা বছরের পর বছর চেষ্টা করে কালিকটের আশপাশের রাজ্য কোচিন, গুজরাট, গোয়া, মুম্বাই বিজয়নগর দখল করলেও তারা কালিকট দখল করতে পারেনি। আশপাশের সকল রাজ্য পর্তুগিজদের সহায়তা করেছিল, কিন্তু কালিকটের হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও দেশপ্রেমের কাছে বারবার মার খেয়েছে পর্তুগিজরা।’
: তুমি কি জান, তোমার আসাদ মিরণ মামার এ গল্পটি একটি বড় পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?
: জানি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ১ অক্টোবর ২ হাজার ১৬ সালে।
: ‘বাহ বাহ! তোমার স্মরণশক্তি তো খুব প্রখর’। স্মরণশক্তির প্রশংসা শুনে নাবিলের মুখ লজ্জায় রাঙা টম্যাটোর মতো দেখায়। লাজরাঙা মুখে নাবিল বলে: ‘পুর্তগিজরা না পারলেও তাদের দেখানো পথেই তো পরে ইংরেজরা এসে আমাদের এই দেশটা দখল করেছিল।’
: ঠিক তাই।
৪.
নাবিল ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে চলছে। নিচে সবুজ শস্যক্ষেত ওপরে নীল আকাশ। সে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বাতাসে দূষণের চিহ্নমাত্র নেই। এমন নির্মল বায়ু গাঁও-গ্রামেও এখন পাওয়া দুষ্কর। অথচ রাজধানী ঢাকায়। সে আর ভাবতে পারছে না।
: ‘কী ব্যাপার নাবিল, কী ভাবছো? ’ নাবিলের টাইমমেশিন ঘোড়া প্রশ্ন করে?
: কেন শুধু শুধু জানতে চাচ্ছো? তুমি তো সব জানো।
: এখন তুমি দেখছো ১৭৫৭ সালের ঢাকা।
: তাই তো বলি, এত নির্মল বায়ু, স্বচ্ছ পানি আর সুনীল আকাশ।
: তোমাদের এ যুগের মতো সেই সময়ে এত কলকারখানা ছিল না। মানুষ নদীর পাড় দখল করতো না। পানিকে নোংরা করতো না।
: তা এখন আমরা যাচ্ছি কোথায়?
: জিঞ্জিরা প্রাসাদে।
নাবিলের কানে মিষ্টি বেহালার মিষ্টি সুর ভেসে আসে। খুব দূরে নয় ঝলমলে প্রাসাদটা। ঐ প্রাসাদ থেকেই আসে সুরের লহরি। প্রাসাদের বিশাল সিংহ দরজায় চার-পাঁচজন সিপাহি পাহারা দিচ্ছেন। নাবিলকে দেখে তারা সালাম দিয়ে দরজা খুলে দিলো। নাবিল ভেতরে প্রবেশ করতেই দু’জন সিপাহি এসে তাকে সাদরে ভেতরে নিয়ে যায়।
: আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছো মহাকাল ভ্রমণকারী নাবিল জামান। একজন রাজপুরুষ নাবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন।
: আপনি আমাকে চেনেন, তোমাকে চিনবো না, তুমি এত সময়ের পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এসেছো, শিকড়সন্ধান করতে।
: আমি তো আপনাকে চিনলাম না।
: আমি মোগল সুবাদার ইবরাহিম খান।
: ‘এই প্রাসাদের বাসিন্দা এবং এই অঞ্চলের সুবাদার। চলো বিদেশি মেহমানদের সম্মানে জলসা চলছে। আজ তুমি আমাদের সম্মানিত মেহমান।’ ইবরাহিমের সাথে সাথে নাবিল জলসায় প্রবেশ করে। গজলের আসর চলছে। বেশ কয়েকজন বিদেশি মেহমান। গজল শুনছে।
: ওনারা কারা?
: সাত সাগর তেরো নদীর পার হয়ে ইউরোপ থেকে আসা মেহমান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক।
: দিল্লি স¤্রাট ফররুখ সিয়ার তাদেরকে একটি ফরমান ও দু’টি হুকুমনামা দিয়ে এই সুবে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার বিশেষ সুবিধা ও সনদ লাভ করেছে। তারা এখন আমাদের সুবে বাংলার মেহমান। তাদের খাতির যতœ না করলে বদনাম হবে। তাই তাদের সম্মানে এখানে মাঝে মাঝে জলসার আয়োজন করি। তারাও এর বিনিময়ে তাদের ব্যবসার লাভের কিছু অংশ আমাদের জন্য খরচ করেন।
: বিদেশিদেরকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া কি ঠিক। এরা তো এভাবে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করার অনুমতি নিয়ে পরে দেশটাই দখল করছে।
: এটা মোগল সা¤্রাজ্য, এর দিকে হাত বাড়ানোর সাহস বণিকরা দূরের কথা, স্বয়ং মহারানী এলিজাবেথও পাবেন না। আর তুমি তো জান স¤্রাট ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য কলকাতার আশপাশে ৩৮ গ্রাম কেনার অনুমতি দিয়েছেন।
: এর পরের ইতিহাস আপনি না জানলেও আমি জানি
: তুমি মহাকাল ভ্রমণকারী তুমি তো জানবেই, তা কী সেই ইতিহাস
: আপনাদের স¤্রাটের এই লোভের খেসারত এই বাংলা শুধু নয় গোট ভারতবর্ষকে দিতে হয়েছে ২ শত বছর ধরে।
: স¤্রাটের কী দোষ। দেশে দেশে বাণিজ্য সম্পর্ক করা কি অপরাধ।
: না, তা অপরাধ নয়, তাই বলে নিজ দেশের জমি নয় দেশের কোন কোম্পানির কাছে বিক্রির অধিকার কোন স¤্রাটের নেই।
: স¤্রাট মানে তোমাদের যুগের গণতান্ত্রিকভাবে কয়েক দিনের জন্য নির্বাচিত কোনো প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট বা সরকারপ্রধান নন, তিনি সব কিছুর মালিক।
: ভুলটা তো আপনাদের ওখানে। কোনো মানুষ কোনো মানুষের বা জমিনের মালিক হতে পারেন না। আসমান জমিনের মালিক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা। রাজা, বাদশাহ, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টরা তাঁর প্রতিনিধি মাত্র। তারা মালিক নন তার শাসিত অঞ্চলের জনগণের খাদেম মাত্র। এক খাদেম জমিন বিক্রির ক্ষমতা পায় কোথায়?
: তুমি তো খুব কঠিন কঠিন কথা বলছো, এত ছোট বয়সে এত কিছু জানো কিভাবে?
: মানুষ হিসেবে একজন মানুষের কাজ কী। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলে দিয়েছেন। রাসূল সা.-এর হাদিস আছে। আছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের গবেষণা এ সবের সাথে ইতিহাসের শিক্ষাকে মিলিয়ে দেখলে এই সত্য যে কেউ বুঝতে পারবে।
: আচ্ছা তুমি যে বললে এই ভুলের খেসারত তোমাদের দু’শত বছর দিতে হয়েছে।
: আপনি তো জানেন, ১৬০০ সালে ২১৮ জন ইংরেজ বণিক নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করেন।
: হ্যাঁ, ওদের কাছ থেকে জেনেছি। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের নিকট থেকে ১৫ বছরের সনদ নিয়ে ওরা ভারতে বাণিজ্য করতে এসেছে।
: মাত্র পনেরো বছরের জন্য এলে ওদের জমি কেনার দরকার কি?
: ওরা পরে মেয়াদ বাড়িয়ে নিবে।
: কারণ
: এই দেশে ওদের ভালো লাগে। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ওরা লাভবান হচ্ছে।
: এই লাভই পরে লোভে পরিণত হয়।
: বুঝলাম না।
: এই কথা বুঝতে একটু পেছনের ইতিহাস জানতে হবে।
: এই ভারতবর্ষের প্রতি ওদের লোভ একদিনে সৃষ্টি হয়নি।
: আপনি তো জানেন, ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে বাণিজ্যকুঠি বানানোর জন্য ক্যাপ্টেন হকিন্স ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের একটি সুপারিশপত্র নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ভারতবর্ষের ব্যবসায়ী ও পর্তুগিজদের বিরোধিতার কারণে ক্যাপ্টেন হকিন্স ব্যর্থ হন। কুঠির নির্মাণ না করেই ব্যবসা চালিয়ে যান। এ নিয়ে পর্তুগিজদের সাথে ইংরেজদের বিরোধ চলতে থাকে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে স¤্রাটের কান ভারী করতে থাকে।
বিরোধ চরম আকার ধারণ করলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্যাপ্টেন বেস্টের নেতৃত্বে পর্তুগিজ নৌবহরের ওপর হামলা করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই হামলা গোটা পর্তুগিজ বাণিজ্যবহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইংরেজরা সুরাট বন্দরে অবস্থান করে। ক্যাপ্টেন বেস্ট স¤্রাট জাহাঙ্গীরকে বোঝাতে সক্ষম হন পর্তুগিজরা তার সা¤্রাজ্যের জন্য হুমকি। অন্যদিকে ইংরেজরা তার ভালো চায়। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১৩ সালে এক ফরমান দ্বারা সুরাটে ইংরেজদের বাণিজ্যকুঠি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন। ১৬৫১ সালে বঙ্গদেশের সুবেদার শাহ সুজা বার্ষিক তিন হাজার টাকা শুল্ক প্রদানের বিনিময়ে ইংরেজদের এদেশে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ প্রদান করেন। ১৬৭২ সালে আওরঙ্গজেব নিযুক্ত বাংলার গভর্নর শায়েস্তা খান ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন।
: মোগলরা ইংরেজদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়া অন্য কোনো কিছু করেননি। তুমি কি জান দিল্লি স¤্রাট ফররুখ সিয়ারের অনেক আগে ১৬৩৯ সালে ফ্রান্সিসড নামে জনৈক ইংরেজ চন্দ্রগিরি নামক ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজার নিকট হতে করমন্ডল উপকূলে কিছু জমি নিয়ে মাদ্রাজ শহরের গোড়াপত্তন করেন। এখানে একটি বাণিজ্য কেন্দ্র ও সেন্ট জর্জ দুর্গ স্থাপন করেন। এর অনেক পরে ১৬৯০ সালে জন চাইল্ড ভাগীরথী নদীর তীরে কালিকট, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রাম খরিদ করে কলকাতা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।
: জানি তবে ঐতিহাসিকদের কারণে হিন্দু রাজা চন্দ্রগিরির এ ঘটনার চেয়ে দিল্লি স¤্রাট ফররুখ সিয়ারের কাহিনীই বেশি বেশি প্রচার হয়েছে।
আমি আরো জানি গোল্কুন্ডার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র মসলিপ্ট্রম, পুলিকটোর নিকটবর্তী আমারগর, হরিহরপুর, কাশিম বাজার, পাটনা, ঢাকা, রাজমহল ও মালদাহ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। সপ্তদশ শতকের দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা তাদের আসল রূপ দেখায়। তারা শান্তির নীতি পরিত্যাগ করে যুদ্ধনীতি গ্রহণ করে। ১৬৬৮ সালে তারা ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের অনুমতি লাভ করে। এই অনুমতি লাভের পরই বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় কোম্পানির বণিকরূপী দস্যুদের সাথে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও আঞ্চলিক শাসকদের সংঘর্ষ বাধে। ইংরেজদের এই রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের কারণে মোগল স¤্রাট আওরঙ্গজেব মুম্বাই আক্রমণের নির্দেশ দেন। জন চাইল্ড পরাজিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কোম্পানি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দেড় লক্ষ টাকা এবং তাদের অধিকৃত অঞ্চলগুলো সম্রাটকে ফেরত দিয়ে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু গোপনে গোপনে তারা তাদের তৎপরতা ঠিকই চালাতে থাকে।
১৭০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম নামে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র কলকাতা হতে কোম্পানি স্থানীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলা-বিহার উড়িষ্যা অঞ্চলের সরকারি কর্মকর্তা ও ধনিকশ্রেণির সাথে সখ্য গড়ে তুলে নিজেদের শক্তি বাড়াতে থকে। তাদের এ সকল কার্যকলাপ দেখে বাংলার দিওয়ান মুর্শিদকুলী খানের সাথে তাদের বিরোধ শুরু হয়। মুর্শিদকুলী খানের পর আলিবর্দী খানের সাথে ইংরেজদের বিরোধ বাধে। তিনি ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্য ও দুর্গ নির্মাণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। পরে এক সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে তিনি ইংরেজদের দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। এর পরের পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ প্রতারণার মাধ্যমে তরুণ দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়, গ্রেপ্তার আর শাহাদাতের করুণ কাহিনী তো কারো অজানা নয়।
: ‘আমাকে কি তুমি সন্দেহ করছো?’ ইবরাহিম নাবিলের কাছে জানতে চায়।
: না, তবে আপনার মতো সম্ভ্রান্ত লোকদের এমন খাতির যতœ ওদের সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর আপনাদের ব্যবহার করেই ওরা দেশের নিরীহ ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের সাহস দেখায়। আপনাদের মতো জিঞ্জিরা প্রাসাদের মালিকরা সতর্ক থাকলে কোনো পরাশক্তিই আমাদের পরাধীনতার জিঞ্জির পরানোর সাহস দেখাবে না। সিরাজউদ্দৌলারা তেজি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নাঙা তলোয়ার হাতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে যুগ যুগ ধরে। বুকের রক্ত ঢেলে শহীদ হবে। তবু মাথা নত করবে না
: ‘আজ তাহলে আসি।’ নাবিল বিদায়
: আল্লাহ হাফেজ। আবার আসবে।
৫.
মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে। খোলা জানালার পাশে একটি পাখি ডাকছে। ভোরের মিষ্টি হাওয়া এসে লাগছে নাবিলের চোখে মুখে। নাবিল তার টাইমমেশিন ঘোড়াটাকে বলে সামনের মসজিদে কাছে তাকে নামিয়ে দিতে।