(শেষাংশ)
মসজিদে নববী সম্বন্ধে রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে এক রাকাত সালাত পড়বে, সে ৫০ হাজার রাকাত সালাতের সওয়াব পাবে।’ হজ করতে গেলে হজের আগে বা পরে মদিনা শরিফে মহানবী সা:-এর রওজা শরিফ ও মসজিদে নববী জিয়ারত করে এলে তাতে সওয়াব আছে। মনে রাখতে হবে-১. পবিত্র মক্কা-মদিনার কোনো অসুবিধার প্রতি কিংবা সেখানকার অধিবাসীদের কোনো দোষ-ত্রুটির কথা আদৌ খেয়াল করবেন না। পরনিন্দা ও পরচর্চা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন। নিজের কারণে কারো সাথে ঝগড়া বা তর্ক হলে আগেই মাফ চেয়ে নিন। ২. হজের পর নেক আমলের প্রতি অধিকতর যতœবান হওয়া একান্ত কর্তব্য। কেননা হজের পর নেক আমলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়া হজ কবুলের অন্যতম আলামত। ৩. মক্কা শরিফে ও মদিনা মুনাওয়ারায় সর্বদা অজুর সাথে থাকুন। ৪. মক্কা শরিফে মসজিদুল হারামে এবং মদিনা শরিফে মসজিদে নববীতে বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করুন আর ভাবুন, এখানে আসার এমন সৌভাগ্য আর নসিব হবে কি? ৫. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির, তাওবাহ-ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিল এবং কুরআন তিলাওয়াত ও দ্বীনী বই- পুস্তক অধ্যয়ন করে অতিবাহিত করুন।
আরো কিছু সাবধানতা : আরাফাতের ময়দানে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে খাবার, জুস, ফল ইত্যাদি দিয়ে থাকে। ওই সব খাবার আনতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়, তাই সাবধান থাকবেন।
মুজদালিফায় রাতে থাকার জন্য প্লাস্টিকের পাটি পাওয়া যায়। মক্কায়ও কিনতে পাওয়া যায়। হজ মন্ত্রণালয় মিনার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে (যেখানে হজযাত্রীদের সহজে চোখে পড়ে) ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে বিশ্বের প্রায় ১৮টি ভাষায় বিভিন্ন জরুরি দিকনির্দেশনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রচার করে। যেখানে বাংলা ভাষাও রয়েছে।
বেশির ভাগ সময় হাজীদের মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়। তাই মিনাকে এক হিসেবে তাঁবুর শহর বলা যায়। চার দিকে তাঁবু আর তাঁবু। সব তাঁবু দেখতে একই রকম। মোয়াল্লেম নম্বর বা তাঁবু নম্বর জানা না থাকলে যে কেউই হারিয়ে যেতে পারেন। বিশেষ করে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের বড় অংশ বৃদ্ধ বয়সে হজ করতে যান। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাথে রাখেন না। অনেকে হারিয়ে ফেলেন গন্তব্য। বাংলাদেশের পতাকা অথবা ভাষা শুনে প্রবাসী বাংলাদেশী হজকর্মীরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। এ সমস্যা এড়ানোর জন্য আপনি যে তাঁবুতে অবস্থান করবেন, সে তাঁবু চিহ্নিত করে নিন।
মোয়াল্লেম অফিস থেকে তাঁবুর নম্বরসহ কার্ড দেয়া হয়, তা যতেœ রাখুন। বাইরে বের হওয়ার সময় সাথে রাখুন।
মক্কা-মদিনায় প্রচুর বাংলাদেশী হোটেল আছে। এসব হোটেলে ভাত, মাছ, গোশত, সবজি, ডাল ইত্যাদি সবই পাওয়া যায়। হোটেল থেকে পার্সেলে বাড়িতে খাবার নিয়ে দু’জন অনায়াসে খেতে পারেন। মক্কা-মদিনায় প্রচুর ফল ও ফলের রস পাওয়া যায়। এগুলো কিনে খেতে পারেন। মক্কা-মদিনায় অনেক বাংলাদেশী কাজ করেন। তাই ভাষাগত কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কেনাকাটার সময় দরদাম করে কিনবেন।
হজের সময় প্রচুর হাঁটাচলা করতে হয়, পকেটে টাকা থাকলেও যানবাহন পাওয়া যায় না। মিনায় চুল কাটার লোক পাওয়া যায়। নিজেরা নিজেদের চুল কাটবেন না, এতে মাথা কেটে যেতে পারে। মিনায় কোনো সমস্যা হলে হজযাত্রীদের সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ হজ মিশনের তাঁবুতে যোগাযোগ করবেন।
মক্কা-মদিনা থেকে বাংলাদেশে কম খরচে ফোন করা যায় (কোনো বাংলাদেশীকে বললে দেখিয়ে দেবেন)। সৌদি আরবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে চাইলে সাথে সেট নিয়ে যাবেন, ওখানে (হজ প্যাকেজ) মোবাইল সিম কিনতে পাওয়া যায়।
মক্কায় কাবা শরিফ ছাড়াও জাবাল-ই-রহমত (আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত), জাবাল-ই-নূর, মিনায় আল-খায়েফ মসজিদ, নামিরা মসজিদ, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা, জাবাল-ই-সাওর প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরে দেখা যায়।
হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য রক্ষার কিছু টিপস: সৌদি আরব বেশ গরমের দেশ। দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩০-৩৫ ডিগ্রির বেশি, আর্দ্রতাও থাকে বেশি। আবার রাতের বেলা তাপমাত্রা বেশ কমে যায়। তাপমাত্রা বেশি বলে ডায়রিয়া, হিটস্ট্রোক ও ইনফ্লুয়েঞ্জার সমস্যা দেখা দেয় খুব। একটু সচেতন হলে এ সমস্যা থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া যায়। নিচের বিষয়গুলো লক্ষ করুন-
যাত্রার আগেই চিকিৎসকের মাধ্যমে পুরোপুরি চেকআপ করিয়ে নিন। হজে তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়া পর্বতের মধ্যে সায়ি ছাড়া আরো অনেক আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় হেঁটে। এ ক্ষেত্রে হজে যাওয়ার আগে থেকে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। অনেকক্ষণ ধরে বিমানে বসে থাকার ফলে হার্ট, ফুসফুস, ক্যান্সার রোগীসহ অন্যদের পায়ে পানি জমে যেতে পারে বা পা ফুলে যেতে পারে। প্রতি ঘণ্টায় কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ান ও হাত-পা নাড়াচাড়া করুন। পায়ের উপর পা তুলে বসবেন না।
ডায়াবেটিস রোগীরা হজে যাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার ওষুধ বা ইনসুলিন নিলে তার ডোজ পরিবর্তন করতে হবে কি না জেনে নিন। হজে থাকার সময়ও নিয়ম করে ওষুধ সেবন করুন বা ইনসুলিন নিন। সবসময় মধু বা মিষ্টিজাতীয় খাবার সাথে রাখুন। যদি আপনার অতিরিক্ত দুর্বলতা, অতিরিক্ত ঘাম, প্যালপিটিশন বা অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন হয় তাহলে দ্রুত মিষ্টিজাতীয় খাবার খান। উচ্চ রক্তচাপের জন্য ওষুধ খাওয়া বাদ দেবেন না।
হজের সময় হাজীরা হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন বেশি এবং এ কারণে তাদের মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। হিটস্ট্রোক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একটানা শারীরিক পরিশ্রম করবেন না বা লম্বা সময়ের জন্য হাঁটবেন না। হজের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সময় পেলেই ঠা-া জায়গায় বসে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করুন। হিটস্ট্রোকের উপসর্গ দেখা দিলে ভিড় থেকে সরে যান। সুতি কাপড়-চোপড় পরিধান করতে হবে।
কিছু কিছু ওষুধ সাথে নিন। এগুলো হতে পারে কাশির ওষুধ, অ্যালার্জির ওষুধ যেমন- লোরাটিডিন, হিস্টাসিন, ডায়রিয়ার ওষুধ যেমন খাবার স্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিক-জাতীয় ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক অয়েন্টমেন্ট, কাটাছেঁড়ার জন্য পভিডন আয়োডিন, স্যাভলন, ব্যান্ডেজ, কটন, প্যারাসিটামল ও কিছু ব্যথানাশক ওষুধ যেমন- ডাইকোফেনাক, কিটোরোলাক, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ওমিপ্রাজল। আপনি যেসব ওষুধ নিয়মিত সেবন করেন সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশ থেকে নিয়ে যান। আপনার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র সাথে রাখুন। কোনো সমস্যা হলে হজ এজেন্ট ও সৌদি মেডিক্যাল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করুন।
পরিশেষে বলব, হজের সফরে সর্বদা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ওপর ভরসা রাখুন। অব্যাহতভাবে দোয়া চালিয়ে যান। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রত্যেকের হজকে হজে মাবরূর হিসেবে কবুল করুন। আমিন! লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক